গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ মহারাজের বলা কথাগুলো নিয়েই আমাদের এখনকার আলোচনা চলছিল ৷ আমরা কথা দিয়েছিলাম গুরু মহারাজের বলা একটা গল্পের কথা বলবো (এটি অবশ্য সত্য কাহিনী, ভগবান বুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা) – আজ সেইটা দিয়েই শুরু হোক । যে প্রসঙ্গে এই গল্প কথাটি গুরু মহারাজ বলেছিলেন – সেটি ছিল এই জগতে কত সামান্য কারণে কত বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটে !
একবার কোশল রাজ্যের সাথে তার পাশের রাজ্যের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল । দুই পক্ষই তাদের নিজ নিজ সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে দিয়েছিল । এইবার দুই রাজ্যের রাজা তাদের সেনাপতিদের নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ শুরুর আদেশ দিলেই শুরু হবে মরণপণ যুদ্ধ – মারা যাবে নিরীহ লোকজন যারা সেনাবাহিনীতে চাকরি করে ৷ তাছাড়া নষ্ট হবে শস্যক্ষেত্র, গ্রাম, শহর – হয়তো যুদ্ধের তাণ্ডবে মারা যাবে অনেক নিরীহ মানুষজনও।
এদিকে ঘটনা ঘটেছে কি – এই দুই রাজ্যের দুজন রাজাই ছিল ভগবান বুদ্ধের অনুরাগী শিষ্য । আর সেই সময় ভগবান বুদ্ধ ওই অঞ্চলেই কাছাকাছি কোন স্থানে অবস্থান করছিলেন । এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা তাঁর কানে উঠতে দেরি হলো না । একে তো বুদ্ধ অহিংসার পূজারী, আর তাঁর শিষ্যদের কিনা এই অবস্থা ! খবর পেয়েই ছুটলেন তিনি একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে ! ততক্ষণে দু’জন রাজাই যুদ্ধক্ষেত্রে এসে গেছে – যুদ্ধের রণদামামা বাজল বলে ! ঠিক সেই সময় দুই রাজ্যের সৈন্যদলের মাঝখানে ভগবান বুদ্ধ সশিষ্য সেখানে উপস্থিত হয়ে গেলেন ৷
যুদ্ধক্ষেত্রের একেবারে মাঝখানে স্বয়ং ভগবান বুদ্ধকে দেখে – উভয় রাজাই হাতির পিঠ থেকে নেমে সোজা বুদ্ধের চরণতলে এসে পতিত হলো । ভগবান দু’জনকেই বাহুতে ধরে ওঠালেন, তারপর বললেন – ” কি ব্যাপার ? কেন এই যুদ্ধের আয়োজন ?” গুরুদেবের জিজ্ঞাসার উত্তরে কোশলরাজ অন্য রাজার প্রতি নানান দোষারোপ করে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে থাকল। ঠিক তেমনি অন্য রাজাও কোশল রাজের প্রতি নানান বিদ্বেষ-মূলক কথাবার্তা বলতে লাগলো !
ভগবান বুদ্ধ দু’জনকেই চুপ করতে বললেন, তারপর তাদের জিজ্ঞাসা করলেন – ” কিন্তু এই যে যুদ্ধের আয়োজন – এটির কারণ কি ?” ভগবানের কথায় উভয় রাজাই এ – ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল । ওরা জানালো যে ওরা সঠিক কারণ জানে না তবে মহামন্ত্রীরা নিশ্চয়ই জানে। তারপর ওরা উভয় দেশের মন্ত্রীদেরকে ডেকে পাঠালো ‘যুদ্ধের প্রকৃত কারণ বর্ণনা করার জন্য ! কিন্তু একি ! মহামন্ত্রীদ্বয়-ও তো এ – ওর মুখের দিকে তাকায় কিন্তু কোন উত্তর দিতে পারল না ! ভগবান বুদ্ধ আবার জিজ্ঞাসা করলেন – ” তাহলে এই বিশাল যুদ্ধের প্রকৃত কারণ জানে-টা কে ?” মন্ত্রীরা বলল – ” আমাদের সেনাপতি জানে – ওদের কথা মতোই আমরা যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছিলাম ।” ডাকা হল উভয় রাজ্যের প্রধান সেনাপতিদের । তারাও ভগবানের সামনে মাথা চুলকাতে শুরু করল। রাজারা ধমক লাগাতেই ওরা বলে উঠল – “হুজুর নগরকোটালরা সব জানে । ওদের কথামতোই আমরা মহামন্ত্রীর কাছে যুদ্ধের জন্য আর্জি জানিয়েছিলাম ৷” ডাকা হল উভয় রাজ্যের নগরকোটাল-কে ! নগরকোটালদ্বয় হল উভয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী স্থানের সীমান্ত রক্ষীদের কর্তা ! তাদেরকে ডেকে আনতেই প্রকৃত কারণের কথা জানতে পারা গেল ৷
হয়েছিল কি – এক রাজ্যের ঘেসুড়েরা (যারা আস্তাবলের ঘোড়ার জন্য ঘাসের যোগান দেয়) তাদের সীমান্তে ঘাসের অভাব দেখে অন্য রাজ্যের সীমান্তে ঢুকে ঘাস কেটে কেটে নিয়ে আসতো । বেশ কয়েকদিন এমন ঘটনা ঘটতে থাকায় ওই দেশের সীমান্ত রক্ষীদের নজরে এটা পড়ে গেল ৷ শাশ্তিস্বরূপ তারা ওই ঘেসুড়েদের ধরে বেশ কয়েক ঘা লাগিয়ে তারপর ছেড়ে দিল । এই ঘটনায় অপমানিত হয়ে এই রাজ্যের সীমান্তরক্ষীরা ওদের কয়েকজন সীমান্তরক্ষীকে আচমকা ধরে ফেলে _তাদেরকে উত্তম মধ্যম লাগিয়ে দিল। এইভাবে উত্তেজনা বাড়তে থাকল এবং তা সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল । এরপর থেকেই ছোটখাটো মারামারি-গন্ডগোল চলতেই থাকল, ফলে উভয় রাজ্যের নগরপালেরা সেনাপতিদেরকে জানাতে বাধ্য হয়েছিল ৷ সেনাপতিদ্বয় মন্ত্রীদের কানে তুলেছিল, মহামন্ত্রীরা সভাসদ ও রাজার সবকিছু কানে তুলতেই যুদ্ধ-ঘোষণা হয়ে গেল ।
ভগবান বুদ্ধ সমস্ত ঘটনা শুনলেন, শুনল রাজারাও। এরপর ভগবান বুদ্ধ উভয় রাজার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাতেই তারা দুজনেই লজ্জিত হয়ে পুনরায় বুদ্ধের চরণে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো ৷ ভগবান বললেন – ” তোমরা আমার কাছে ক্ষমা না চেয়ে পরস্পরে পরস্পরের প্রতি ক্ষমা চেয়ে নাও৷ রাজ্যের রাজা হয়ে ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে না চেয়ে যুদ্ধ ঘোষনা করে দিলে! তোমরা কি বুঝতে পারছ – অতি সামান্য কারণে কি সাংঘাতিক কান্ড তোমরা ঘটাতে চাইছিলে ? কত অসহায় নিরীহ মানুষের প্রাণ যেতে বসেছিল তোমাদের রাজ-হট্ বজায় রাখতে গিয়ে ! এখন থেকে তোমরা নিজেদের মধ্যে একটা চুক্তি করে নাও – যাতে করে উভয় রাজ্যের ঘেসুড়েরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিনা বাধায় প্রয়োজনমতো ঘাস কেটে ঘোড়াদেরকে খাওয়াতে পারে ৷৷”
উভয় রাজাই ভগবান বুদ্ধের নির্দেশ মেনে নিয়েছিল এবং এই ঘটনার পর থেকে ওই দুই প্রতিবেশী দেশ মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে থাকতে শুরু করেছিল ।
গুরুমহারাজ এই গল্পটা(ঘটনা) বলার পর সিটিং-এ উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন _”জগতে বেশিরভাগ বড় বড় যুদ্ধ – রক্তপাত-হানাহানি-মারামারি ঘটে থাকে, সেগুলোর উৎস খুঁজতে গেলে দেখা যাবে যে __কোন না কোন তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে অত বড় কান্ড ঘটে গেল!!
যে কোন লড়াই ঝগড়ার প্রকৃত কারণ মানুষের sentiment এবং ego অর্থাৎ অভিমান ও অহংকার।। ‘বিরোধ’ মানুষের অন্তঃকরনেই রয়েছে, কিছু না কিছু বাহানা পেলে _সেইটাকে issue করে দুটি মানুষ বা দুইদল মানুষ পরস্পর পরস্পরের সাথে বিরোধ করে, লড়াই করে। হানাহানি – মারামারি – রক্তপাত মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। পশু অবস্থা থেকেই তো জৈবিক বিবর্তনের ফলে ‘মানুষ শরীর’ রুপ পেয়েছে কিন্তু মনোজগতে মানুষ এখনো সেই primitive stage-এই থেকে গেছে , সেখানে কোন বিবর্তন – উদবর্তন হয় নি। তাই সমগ্র পৃথিবী জুড়ে আর্ত জনতার এত হাহাকার, দুর্বলের প্রতি প্রবলের এত অত্যাচার, পারস্পরিক হিংসার এতটা বহিঃপ্রকাশ!!”(ক্রমশঃ)