শ্রী শ্রী গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ ভগবান বুদ্ধের কথা বলতে শুরু করলেই কেমন যেন হয়ে যেতেন ৷ সেই সময় তাঁর চোখে মুখেও যেন বুদ্ধের শান্ততা, সমাহিত ভাব, করুণা-মৈত্রীর সমস্ত লক্ষণ ফুটে উঠতো । একবার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল গুরু মহারাজকে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর পোশাকে (কাশায়া) দেখার । বনগ্রাম আশ্রমের ভক্ত লালবাজারের প্রাক্তন পুলিশকর্মী বিপ্লব দাসের এক দাদা নৈহাটি অঞ্চলে কোয়াক্ ডাক্তারি করতো । ওই ভদ্রলোককে তখন প্রায়ই গুরু মহারাজের কাছে আসতে দেখতাম । যদিও তার পরিবার এবং ছেলে-মেয়ে ছিল তবু বৈরাগ্যের তীব্রতায় লোকটি ব্রহ্মচর্য নিয়ে আশ্রমে চলে এসেছিল ৷ এরপর সেই ভদ্রলোক প্রব্রজ্যায় চলে যায় ৷ কিছুকাল পর শুনেছিলাম যে ওই ব্রহ্মচারী এখন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়ে গেছে ! অনেকদিন পরে ওই সন্ন্যাসী একদিন বনগ্রাম আশ্রমে এসে হাজির ! গুরুমহারাজ ওকে ‘ভান্তে’ – বলে সম্বোধন করেছিলেন, হয়তো বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ভান্তে-ই বলা হয় । বনগ্রাম আশ্রমে এসে ওই সন্ন্যাসী গুরুমহারাজকে একটা বা একজোড়া বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ‘কাশায়া’ বস্ত্র উপহার দিয়েছিল ৷ ‘ভান্তে’-র মনোবাঞ্ছা মেটাতে গুরুমহারাজ একদিন সকালের সিটিং-এ ওই বিশেষ পোশাক পড়ে এসে বসলেন – ওই বেশে ওনাকে দেখে আমরা তো অবাক !( আমার যতদূর মনে পড়ছে ওই পোশাকে ওনার ছবিও তোলা হয়েছিল, যদি কোন সহৃদয় পাঠক বা ভক্তের কাছে এর কোনো কপি থাকে তাহলে তার কাছে অনুরোধ –’ সবার জন্য, সবার কাছে পৌঁছানোর জন্য ছবিটি প্রকাশ করে দিন’!)
বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর পোশাক – গিরিমাটি রং করা (রামকৃষ্ণ মিশনের আগেকার সন্ন্যাসীরা যে রঙের কাপড় পড়তো) দু’খন্ড কাপড়, একখন্ড কোমরে জড়িয়ে পড়তে হয় এবং আর একখণ্ড গায়ে একটা বিশেষ ভাবে জড়িয়ে পড়তে হয় । বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সারাদিনে একবার-ই খায়, খাবার সময় কোন কথা বলে না । আর তাছাড়া ওদেরকে ভাত-ডাল-তরকারি যা আয়োজন হয়েছে – সেই সমস্ত কিছু একবারে দিয়ে দিতে হয় – পরে দিতে চাইলে আর নেবে না ।
এসব প্রসঙ্গ থাক্ – আমরা আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে যাই । গুরুমহারাজ ভগবান বুদ্ধের কথা বলার সময় নিজেই যেন ভগবান বুদ্ধ হয়ে যেতেন ! ভগবান বুদ্ধ শ্বেত পদ্মফুল ভালোবাসতেন – গুরুমহারাজের সবচাইতে পছন্দের ফুল ছিল শ্বেতপদ্ম । গুরু মহারাজের ‘গা’ (শরীর) থেকে যে অপার্থিব সৌরভ বা সুগন্ধ বেরোতো তা শুধু চন্দনের গন্ধ নয়, সেটা ছিল পদ্ম, চন্দন, জুঁই, গব্যঘৃত ইত্যাদির একটা মিশ্র সুগন্ধ !গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “এখনও অমিতাভ বুদ্ধের-ই যুগ চলছে(‘বুদ্ধ’_একটা স্থিতি, কর্মের ধারা বা বিভাগ অনুযায়ী ‘বুদ্ধস্থিতি’-র মহাপুরুষদের বিভিন্ন নামে প্রকাশ করা হয় _যেমন অমিতাভ বুদ্ধ, অবলোক হিতেশ্বর বুদ্ধ ইত্যাদি।), বর্তমান দশনামী সম্প্রদায়ভুক্ত সহ অন্যান্য সন্ন্যাসী পরম্পরাও সৃষ্টি হয়েছে ভগবান বুদ্ধের পর থেকে ৷ সমাজে সেবামূলক কাজের যে প্রবাহ আনলেন স্বামী বিবেকানন্দ তারও উৎস ভগবান বুদ্ধ !” গুরুমহারাজ বলেছিলেন – “স্বামী বিবেকানন্দের যখন ভগবান বুদ্ধের দর্শন হলো – তখন স্বামীজীও ভগবান বুদ্ধ হয়ে গেলেন ৷” গুরু মহারাজ এই কথাটা খুব বলতেন – ” ধর্ম জগতের বেশিরভাগ মানুষই হয় আবেগ সর্বস্ব ! এদের অধিকাংশই ধর্মান্ধ অথবা ধর্মোন্মাদ! ধর্মপ্রাণ বা ধার্মিক আর ক’জন হয় বাবা ! আমার এখানেই যারা আসে তাদের বেশীরভাগকেই তো দেখি হয় বেগকুমার (আবেগপ্রবণ) অথবা বেগকুমারী৷”
গুরু মহারাজ বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে কিভাবে তন্ত্রের প্রভাব ঢুকে পড়েছিল এবং এই ধর্মমতটি জন-মানসে কিভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল – তার বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন ৷ সাধনার ফলে সিদ্ধিলাভ হয় – মহাবিশ্বপ্রকৃতির শক্তির অংশ সাধকের মধ্যে (শরীর এবং মনে) প্রবেশ করার সাধনাগুলি রয়েছে তন্ত্রের বিভিন্ন অভিচার ক্রিয়ায় ! বৌদ্ধ শ্রমণেরা ওইসব শক্তি লাভের জন্য তন্ত্র-কে গ্রহণ করেছিল, সেখান থেকেই তন্ত্রের ‘নারী নিয়ে সাধন’-ও ওদের মধ্যে ঢুকে পড়ে – আর এরফলে ‘অভিচার’ না হয়ে নানান ‘ব্যভিচারে’ মত্ত হয়ে তারা জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে ৷
গুরু মহারাজের সাথে একজন বিখ্যাত বৌদ্ধ শ্রমণের সাথে এইসব ব্যাপারে নানা কথাবার্তা হয়েছিল । সেই সন্ন্যাসী সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ সহ অন্যান্য কয়েকটি দেশেরও (ভারত, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশ) দায়িত্বে ছিলেন ৷ ভগবান বুদ্ধ “আস্তিক না নাস্তিক” অর্থাৎ তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন কিনা – এই বিষয়ে এখনও এরা ধোঁয়াশায় ভোগেন ৷ গুরুমহারাজ ওনার সংশয় নিরসন করেছিলেন । গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “ঈশ্বর আছে কি নেই – এই জিজ্ঞাসার উত্তরে ভগবান বুদ্ধ নীরব ছিলেন । তাই একদল ধরে নিয়েছিল যে বুদ্ধ বলতে চাইছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নাই’ ! কিন্তু তা নয় – কারণ ভগবান বুদ্ধ নিজেই বলেছেন – ‘আত্মদীপো ভবঃ’, অর্থাৎ ‘আত্মা দীপ স্বরূপ’। উপনিষদ বলেছে তুমি নিজেই জ্বলন্ত প্রদীপ হও! আগে তুমি নিজেই তো জ্বলে ওঠো – ফুটে ওঠো, তারপর অপরকে জাগাবে, বা অপরকে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেবে! তুমিই ঈশ্বর হও!’ ভগবান বুদ্ধ তো তাই করলেন, আগে নিজে অর্হত্ব লাভ করে _জগতবাসীকে শান্তি-মৈত্রি-প্রেম-করুনার ললিত বানী শোনালেন!” সেই প্রবীণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গুরু মহারাজের সান্নিধ্য লাভ করে এবং ওনার জিজ্ঞাসা সমূহের উত্তর পেয়ে খুবই সন্তুষ্ট এবং আশ্বস্ত হয়েছিলেন ।
গুরুমহারাজের সাথে যখন হাওড়া শিবপুরে গঙ্গাবাবুর (‘পরমানন্দম’-এর লেখক গঙ্গা নারায়ন ব্যানার্জি) বাড়িতে হাওড়ার নামকরা পণ্ডিত এবং এনাঙ্ক শেখর বাগচীর সাথে গুরু মহারাজের কথা হয়েছিল – তখন এনাঙ্ক বাবু পালি ভাষায় বিভিন্ন বৌদ্ধ শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে গুরু মহারাজের কাছে ফটাফট্ নানা শ্লোক বলছিলেন।
এইটা দেখে গুরুমহারাজ এনাঙ্কবাবুকে বললেন _”আপনার তো বৌদ্ধশাশ্ত্র অনেক পড়া আছে দেখছি!” উত্তরে এনাঙ্কবাবু বললেন _”হ্যাঁ যোগীরাজ! (এনাঙ্কবাবু গুরুমহারাজকে “যোগীরাজ” – বলেই সম্বোধন করতেন।) _ঐ একটু-আধটু পড়েছি।” গুরুমহারাজ তখন গড়গড় করে গোটাকয়েক বৌদ্ধশাশ্ত্র অর্থাৎ ভগবান বুদ্ধ-বিষয়ক কিছু গ্রন্থের নাম উল্লেখ করে ওনাকে বললেন _” আপনি বোধয় এই বইগুলি পড়েছেন!” গুরুমহারাজের exact ঐ বইগুলির নাম বলে দেওয়ায় এনাঙ্কবাবু যৎপরোনাস্তি অবাক হয়ে বললেন _” হ্যাঁ – হ্যাঁ যোগীরাজ! আমি ঐসব গ্রন্থগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি।”
এনাঙ্কবাবুকে আরও অবাক করে দিয়ে এরপর গুরুমহারাজ আবার গোটাকয়েক বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের নাম করে ওনাকে বললেন _”আপনি নিশ্চয়ই এই বইগুলি পড়েন নি। অবশ্য পড়ার কথাও নয় _কারন এই বইগুলি আপনি ভারতে পাবেনও না! এইগুলি পড়তে গেলে আপনাকে তিব্বত থেকে আনিয়ে পড়তে হবে। আপনি চাইলে আমি আনিয়ে দিতে পারি। ওখানকার বিভিন্ন মনেস্টারীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে!”(ক্রমশঃ)