গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ ভগবান বুদ্ধ সম্বন্ধে সিটিং-এ বিভিন্ন সময়ে যে সমস্ত কথা বলেছিলেন, সেইগুলির যতটা আমার স্মরণে রয়েছে এখানে আপনাদের সাথে সেই সব শেয়ার করার চেষ্টা করা হচ্ছিল ৷ গুরুমহারাজ আমাদের কাছে ভগবান বুদ্ধের অর্হত্ত্ব লাভের দিনগুলির কথা বিস্তারিত বলেছিলেন ৷ সেই সব কথা যদি পুরোটা আপনাদের কাছে শোনাতে পারতাম – তাহলে যে কি ভালোই হোত, কিন্তু সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সে চেষ্টা করাটাই বৃথা ! তাই তিনি যেটুকু লেখাবেন সেইটুকুই লিখি ।
“ইহাসনে শুষ‍্যতু মে শরীরং…….” বলে তো ভগবান বুদ্ধ বুদ্ধগয়ায় বোধিবৃক্ষের নিচে বসে পড়লেন (তখন অবশ্য ঐ বৃক্ষটির নাম বোধিবৃক্ষ ছিল না । এই নামটি পরে ভক্তরা দিয়েছিল। পরবর্তীকালে ওই গাছটি নষ্ট হয়ে গেছিল, এখনও ওখানে একটি স্থান নির্দিষ্ট করা আছে ভগবান বুদ্ধের অর্হত্ত্ব লাভের স্থান হিসাবে, এবং একটি গাছও পরবর্তীতে রোপণ করা হয়েছিল, যেটিকে বোধিবৃক্ষ ভাবা হয়) – কিন্তু শরীরের তো ধর্ম রয়েছে, তাই অন্ন-জল পরিত্যাগ করায় তাঁর শরীর ধীরে ধীরে জীর্ণ হতে লাগল ৷ এদিকে কি হয়েছে, ওই স্থানের নিকটবর্তী গ্রামের রাখাল বালকেরা ছাগল-গরু চড়াতে কিংবা খেলা করতে নৈরঞ্জনা নদীর তীরে ওই বোধিবৃক্ষের তলে মাঝে মাঝে আসতো । তারা একদিন হঠাৎ করে দেখলো _এক অপূর্ব লাবণ্য মন্ডিত মানুষ গাছতলায় ধ্যানস্থ হয়ে বসে রয়েছে!
এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখেই তারা দৌড়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে তাদের Team-leader, তাদের সকলের প্রিয় দিদিকে গিয়ে খবরটা দিয়েছিল ৷ ওই দিদি-টিই সুজাতা । গুরু মহারাজ সুজাতা সম্বন্ধে বলেছিলেন – ” গ্রামে অনেক সময় দেখা যায়, এই রকমই এক একটা দিদিকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের একটি দল তৈরি হয় ৷ ছেলের দল নানারকম দুষ্টুমি করে, চুরি করে লোকের গাছে কুল পেড়ে, আম বা পেয়ারা পেরে খায় _ আর কোন বিপদে পড়লেই ছুটে আসে তাদের বিপদভঞ্জন-সর্বংসহা ওই দিদিটির কাছে! ওই ছেলের দল তাদের দুঃখ-আনন্দ বাড়ির বাবা-মা বা পরিবারের অন্যান্যদের সাথে শেয়ার করতে পারে না কিন্তু নিঃসংকোচে পারে ওই দিদি-টির কাছে ।”
এইরকম ‘দিদি’-দের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে সাহিত্য রচনা হয়েছে, দু-একটা ফ্লিম ও রয়েছে। সুজাতা ছিল ওই ছেলের দলের কাছে সেইরকম একটা দিদি ! তাই ওই ছেলের দল ভগবান বুদ্ধকে (তখনকার সিদ্ধার্থ) ওই অবস্থায় নির্জন বনে একাকী থাকতে দেখে – প্রথম খবরটা দিয়েছিল সুজাতাকে । সব শুনে সুজাতা পরের দিন ওই ছেলের দলের সাথে গিয়ে নিজের চোখে ওদের কথার সত্যতা যাচাই করে এসেছিল। নারী মাত্র-ই মায়ের মমতায় পরিপূর্ণ, তা সে ছোট-ই হোক বা বড় । কিশোরী সুজাতা সব কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল – ওই অলৌকিক দর্শন মানুষটি যেহেতু অন্নজল ত্যাগ করে, নির্জন অরণ্যে একাকী তপস্যারত, তাই তাঁকে আগে অন্ততঃ কিছু খাবার ও পানীয় দেওয়া প্রয়োজন ।
এই ভাবনা থেকেই ওই মেয়েটি নিজেদের কালো গাই-গরুর দুধ নিজের হাতে দোহন করে, সুগন্ধি চাল ও ঘরের গুড় দিয়ে তৈরি করল পরমান্ন ৷ গুরুমহারাজ বলেছিলেন ভগবান বুদ্ধ খুব ভালোবাসতেন ‘শবরী কলা’ খেতে ৷ ঐ বিশেষ কলাটির জন্মস্থান হিমালয়ান তরাই অঞ্চলে, কিন্তু বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলেও এই প্রজাতির কলা-র দেখা মেলে ৷ এর বিশেষত্ব হলো এই কলাটি খোসা ছাড়িয়ে গরম খাদ্যদ্রব্যে কুচি কুচি করে দিলেই – এটি ননীর মতো গলে গিয়ে খাদ্যদ্রব্যে মিশে যায় এবং একটা অপূর্ব সৌরভ নির্গত করে ।
সুজাতা গরম পরমান্নে ওই বিশেষ কলাও মিশিয়েছিল ৷ এরপর ওই খাবার ভালো করে ঢাকা দিয়ে, বালক বন্ধুদের কে সঙ্গে নিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটা লাগিয়েছিল বনপথ ধরে সেই দিক পানে, যেখানে নৈরঞ্জনা নদীর তীরে একটি বিশেষ বৃক্ষের তলায় রয়েছেন ধ্যানস্থ বুদ্ধ ! এদিকে ঘটনা ঘটেছিল কি – সেই দিনই ভোর রাতে ভগবান বুদ্ধের সাধনার অন্ত হয়েছে অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে উনি সংকল্প করে ওই গাছতলায় ধ্যানে বসেছিলেন (অর্হত্ত্ব লাভ) – তা সম্পূর্ণ হয়েছে (কারণ, গৌতম বুদ্ধ বোধিবৃক্ষের নিচে ধ্যানে বসার কয়েকদিন পরে ছেলের দলের নজরে আসে তাঁর উপস্থিতি। তারপর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতেও দুই-একদিন কেটে গেছিল – এইভাবে সুজাতার আগমন যখন ঘটেছিল, তার মাঝে বেশ কয়েকদিন কেটে গেছিল ৷)।
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ” জানিস তো ! কোন সাধকের জীবনে জ্ঞানলাভ অথবা সত্যের বোধ যখন হয়, তখন হঠাৎ-ই হয় ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন উদাহরণ হিসাবে বলেছিলেন, ‘ কোন বদ্ধস্থানের হাজার-হাজার বছরের অন্ধকার – হঠাৎ জোরালো আলো জ্বলে উঠলেই পুরো স্থানটি সম্পূর্ণভাবে আলোয় আলো হয়ে যায়, আর কোন স্থানেই অন্ধকার থাকে না । জ্ঞানলাভের ক্ষেত্রেও সেইরকমটাই হয় । সিনেমায় যেভাবে কোন মহাপুরুষের জীবনীতে তাঁর আত্মদর্শনের দৃশ্য দেখানো হয় __অর্থাৎ উঁচু থেকে একটা আলোর রেখা তার কপালের মাঝখানে এসে পড়ছে, তারপর সেই আলোকজ্যোতির মধ্যে থেকে কোন দেব বা দেবীমূর্তি আবির্ভূত হয়ে বলছে, ” বৎস ! আমি এসেছি !” না – এইরকমটা মোটে-ই হয় না ৷ সাধনার গভীরে প্রবেশ করে সেখান স্থিত হতে পারলেই – হঠাৎ করেই জীবন-জগৎ-ঈশ্বরের রহস্য সাধকের কাছে উন্মোচিত হতে থাকে । আধার উপযুক্ত হোলে – তা সম্পূর্ণতা লাভ করে ৷
সিদ্ধার্থের অর্হত্ত্ব লাভের পর-ই তিনি ‘বুদ্ধ’ হলেন। ‘বুদ্ধ’ অর্থাৎ ‘জ্ঞানী’, জগতের সমস্ত জ্ঞান তারমধ্যে আত্মস্থ হওয়াতেই তিনি ‘বুদ্ধ’ বা ‘জ্ঞানী’ হলেন ! যাইহোক, সেই সময়কার বা ঠিক তার পরবর্তী অবস্থার যে অপূর্ব বর্ণনা গুরুমহারাজ দিয়েছিলেন – সেটা আমি আপনাদের কাছে – ঠিক সেই ভাবে বলতে পারছিনা বলে খুবই কষ্ট লাগছে, কিন্তু তবু চেষ্টা করছি ! গুরুমহারাজ বললেন – “গৌতমের অর্হত্ত্ব লাভের পর অর্থাৎ যেইমাত্র তিনি ‘বুদ্ধ’ হলেন –তখন থেকেই ধীরে ধীরে তাঁর শরীরে চেতনা আসতে শুরু করল (এই কদিন নির্বিকল্প সমাধি অবস্থায় শরীরে কোন চেতনা ছিল না), ভোরের দিকে যখন পুবের আকাশ লালিমায় ভরে উঠেছে, দুটি একটি পাখি কানন শাখায় পিকধ্বনির শুভসূচনা করছে, ঠিক সেই সময়েই সদ্য ‘বুদ্ধ’ হওয়া গৌতমের শরীরে ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা’র বোধ জাগল !
সামনে ছল্-ছল্ কল্-কল্ করে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ সলিলা নৈরঞ্জনা নদী – ওই নদীর এক আঁজলা জল গ্রহণ করতে পারলেই এখন এই শরীরটা বাঁচে ! ‘বুদ্ধ’ – পরম আগ্রহে তাঁর এই ক’দিনের সাধন ক্রিয়ায় বসে থাকা ‘আসন’ (পদ্মাসন) এবং মুদ্রা (খেচরী মুদ্রা বা যে কোন মুদ্রা) ত্যাগ করে উঠে যেতে গেলেন নদীর ধারে ৷ কিন্তু হায় ! এতদিনের অব্যবহৃত অঙ্গগুলি(পা, হাঁটু জঙ্ঘা ইত্যাদি) ঠিকমতো কাজ করলো না, তাছাড়া শরীরের অত্যধিক দুর্বলতাও ছিল –তাই তাঁর কৃচ্ছসাধনক্লিষ্ট শরীরটা গড়িয়ে পড়ে গেল। একটু দূরেই জীবনদায়ী, তৃষ্ণানিবারনী, সুশীতল-স্বচ্ছ জল বয়ে যাচ্ছে, মাত্র দু-চার হাত দূরেই ‘এক নদী জল’ _কিন্তু সদ্য বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত রাজকুমার গৌতম তার থেকে এক আঁজলাও গ্রহন করতে পারছিলেন না! [সেইসময়কালীন ভগবান বুদ্ধের শরীর ও মনের অবস্থার কথা গুরুমহারাজ আমাদেরকে বলেছিলেন _সেইগুলি পরের দিন…]
(ক্রমশঃ)