শ্রী শ্রী গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বিভিন্ন সময়ে সিটিং-এ ভগবান বুদ্ধ বিষয়ক যেসব কথা বলেছিলেন – তার কিছু কিছু অংশ আপনাদের কাছে পরিবেশন করা হচ্ছিল ! ভগবান বুদ্ধ রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । ওনার গর্ভধারিনী জননী মায়াদেবী সন্তান জন্ম দেবার অব্যবহিত পরেই মারা গিয়েছিলেন, সেইজন্য ওনাকে মানুষ করেছিলেন গৌতমী নামক ধাত্রীমাতা (কেউ বলে ওনার মাসী বা দ্বিতীয় মাতা)। গৌতমীর নাম অনুসারেই উনি গৌতম নামে পরিচিত, পরবর্তীতে আমরা ওনার পরিচিতিতে পাই গৌতম-বুদ্ধ রূপে !
ছোটবেলায় ওনার নাম ছিল সিদ্ধার্থ, পিতা শুদ্ধোদন খুবই সুশাসক এবং প্রজানুরঞ্জক ছিলেন ৷ ইতিহাস থেকে ওনার ছোটোবেলার ঘটনা যা জানা যায়, তাতে দেখা যায় যে ছোটবেলা থেকেই সিদ্ধার্থ সংসারের প্রচলিত ধারার বিপরীতমুখী ছিলেন! উনি একলা থাকতে ভালবাসতেন, রাজকুমার হিসাবে যে ভোগ-ঐশ্বর্য, সুখ-বিলাসের সুযোগ গ্রহণ করার কথা – উনি ছোটবেলা থেকেই এইগুলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন । খুব চিন্তা ছিল পিতা শুদ্ধোদনের, উনি পুত্রকে প্রচলিত ধারায় ফেরানোর জন্য নানারকম চেষ্টা করেছিলেন, সাধারণ বিদ্যাশিক্ষা-অস্ত্রশিক্ষা ইত্যাদি সবরকম শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । ওনার এক সমবয়সী আত্মীয় দেবদত্তের (!) কথাও পাওয়া যায় – যার প্রকৃতি সিদ্ধার্থের ঠিক বিপরীত ছিল ! সে ছিল খুব দুরন্ত প্রকৃতির, নিষ্ঠুর, উশৃঙ্খল । বালক সিদ্ধার্থ ছোটবেলাতে সবসময় চেষ্টা করতেন তাঁর ওই বন্ধুটিকে ঠিকপথে ফিরিয়ে আনতে ! সেই অর্থে _ছোটবেলা থেকেই সিদ্ধার্থ ছিলেন শিক্ষক! অবশ্য অবতার পুরুষেরা শিক্ষক হয়েই শরীর ধারন করেন।
রাজা শুদ্ধোদন কপিলাবস্তু [বর্তমান নেপালের অন্তর্গত(!)]-র রাজা ছিলেন । তিনি ভেবে দেখলেন যে সিদ্ধার্থের যা প্রকৃতি, তাতে ওর সংসারী হওয়া বা রাজ্যপাট সামলানোর ইচ্ছা-ই নাই । তাই তিনি একটু অল্প বয়সেই সিদ্ধার্থের বিবাহ দিয়েছিলেন এক সুন্দরী তরুণী গোপা বা যশোধারার সাথে । কিছুদিনের মধ্যে-ই তাদের একটি সন্তান-ও হয়েছিল, যার নাম ছিল রাহুল ৷
আজকের আলোচনায় এই সমস্ত উপক্রমণিকায় উঠে এল, কারণ গুরু মহারাজের কাছে এনাদের সম্বন্ধে যা শুনেছিলাম, সেগুলি এইবার বলার চেষ্টা করব । গুরুমহারাজ বলেছিলেন – ভগবান বুদ্ধ বছরের বেশিরভাগ সময়েই পরিব্রাজন করতেন । সন্ন্যাসীদের বর্তমানে একটা নিয়ম রয়েছে যে, ‘সন্ন্যাস’ সংস্কার হবার পর ওই ব্যক্তি বারো (১২) বছর স্ব-গৃহে যেতে পারবে না (আমাদের আশ্রমে গুরু মহারাজ এই নিয়ম-টি অনেকাংশে শিথিল করে দিয়েছিলেন । বিশেষত মুখার্জী বাড়ির ছেলে-মেয়েরা যারা ব্রহ্মচারী বা সন্ন্যাসী হয়েছিল, তাদের জন্য উনি এই ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা-ই রাখেননি)। ভগবান বুদ্ধের সময় এই নিয়মটি ছিল কিনা জানি না – তবে গৃহত্যাগের বহু বছর পর, রাহুল যখন বালক (হয়তো ৮/১০ বছর বয়স) সেই সময়ে ভগবান বুদ্ধ একদিন ঘুরতে ঘুরতে সশিষ্য কপিলাবস্তুতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন ৷
সিংহাসনে আসীন রাজা শুদ্ধোদন ততদিনে আরো বৃদ্ধ হয়েছেন, তাছাড়া পুত্রের গৃহত্যাগী হবার শোক এবং ব্যথা-যন্ত্রণার প্রভাবেও তার শরীর আরও দুর্বলতর হয়ে পড়েছিল ৷ হটাৎ করে সেদিন ঐ রাজ্যের রাজকুমার_ মুণ্ডিত-মস্তক, কাষায় পরিহিত, দন্ড ও ভিক্ষাপাত্রধারী হয়ে পিতার সামনে দন্ডায়মান ! সে যে কি দৃশ্য! গুরুমহারাজ তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের কাছে তা পরিস্ফুট করেছিলেন! আমার তো সেই সাধ্য নাই – আপনারা একটু কষ্ট করে কল্পনার জগতে সেখানে ফিরে গিয়ে ঘটনার রস নেবার চেষ্টা করবেন – এই আশা রাখছি !
ওই অবস্থায় পুত্রকে চোখের সামনে দেখে শুদ্ধোদন একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়লেন । সিংহাসন থেকে নেমে এসে জড়িয়ে ধরলেন পুত্রকে!
গুরু মহারাজ বলেছিলেন যে, সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে শুদ্ধোদন এবার পিতা বা রাজার ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং পুত্র (বুদ্ধদেব)-কে উদ্দেশ্য করে তাঁকে দোষারোপ করে বলেছিলেন যে, __’এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ কী ? রাজার বিহনে (যেহেতু রাহুল তখনও শিশু) রাজ্যে অরাজকতা নেমে আসে – তাহলে কপিলাবস্তুর প্রজাদের কি অবস্থা হবে ! শুদ্ধোদন নিজে বৃদ্ধ হয়েছেন – তার এখন বিশ্রাম জীবন বা অবসর জীবন-যাপন করার কথা – কিন্তু শুধুমাত্র তার পুত্রের অবিবেচকের ন্যায় আচরণের জন্য-ই তার এত কষ্ট করতে হচ্ছে !’__এইভাবে পিতা শুদ্ধোদন সন্ন্যাসীরূপী পুত্র বুদ্ধ-কে কাছে পেয়ে একের পর এক অভিযোগের তীর ছুড়তে থাকলেন ।
পিতার সমস্ত অভিযোগ শোনার পর শান্ততার প্রতিমূর্তি গৌতম বুদ্ধ শান্তু এবং দীপ্তকন্ঠে পিতাকে জীবন এবং জগতের রহস্যের জ্ঞান দিয়েছিলেন, তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে, ‘ জীবন এবং জগতের যা কিছু, – সে সবই নশ্বর, তাই একমাত্র ‘অর্হত্ত্ব’লাভ বা ‘বুদ্ধত্ব’ অর্জনই জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত । কত রাজ্য – কত রাজ-সিংহাসন – কত রাজা এই পৃথিবীতে শরীর নিয়েছিল কিন্তু কালের নিয়মে সেই রাজারা এবং তাদের রাজ্যপাট কোথায় হারিয়ে গেছে! সুতরাং কপিলাবস্তু রাজ্যের জন্যও মহাকাল যে ব্যবস্থা করে রেখেছে – তাই হবে, ও ব্যাপারে চিন্তা না করে জীবনের উদ্দেশ্য লাভের চেষ্টায় ব্রতী হওয়াই সকলের কর্তব্য !’
ভগবান পুত্রের এইসব কথা শুনে শুদ্ধোদনের সব অভিমান নাশ হয়ে গেল! তিনি কাঁদতে শুরু করেছিলেন, পুত্রের নিকট নতজানু হয়েছিলেন তিনি। তার সংস্কার-ই যে তাকে রাজ্য ও সিংহাসন ছাড়ার পথে বাধা – তা তো ভগবান বুঝতেই পারছিলেন।
ভগবান বুদ্ধ তাকে আশ্বস্ত করেন যে, যতদিন শরীরে সামর্থ্য থাকবে ততদিন শুদ্ধোদন সিংহাসনে আসীন থেকে রাজ্যপাট সামলাবেন – এতে তার কোনো দায় থাকবে না – তার সমস্ত দায়িত্ব ভগবান বুদ্ধের !
পুত্রের চরণে ক্রন্দনরত নতজানু পিতার যে দৃশ্যের সেইদিন বনগ্রামের সিটিংয়ে ভগবান পরমানন্দ অবতারণা করেছিলেন – তা সেদিন যারাই ওখানে উপস্থিত ছিল, তাদের সকলের-ই স্মরণে রয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস । ভগবান পরমানন্দ এই একই ধরনের একটা সিটিংয়ে একদিন আলোচনা করেছিলেন – ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বা মহাপ্রভুর জীবনের একটি ঘটনা ! এখন সেইটা বলি।
বৈষ্ণব শাস্ত্রে বলা হয়েছে – “বহিরঙ্গ সঙ্গে করে নাম সংকীর্তন / অন্তরঙ্গ সঙ্গে করে প্রেম আলাপন ।৷” মহাপ্রভু শ্রীবাসের অঙ্গনে লম্ফঝম্প করে নামসংকীর্তন করতেন , সেই অনুষ্ঠানে তৎকালীন নবদ্বীপের বহু মানুষ অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু সংকীর্তন শেষে শ্রীবাসের ঘরের মধ্যে কি হতো – তা কয়েকজন অন্তরঙ্গ ভক্ত ছাড়া কেউই জানতো না ! শচীমাতাও ওই ঘটনা লোকমুখে বহুবার শুনেছিলেন ৷ একবার তাঁরও ইচ্ছা হয়েছিল ঐ ঘরে কি ঘটনা ঘটে তা দেখার! আর সেই কৌতূহল নিবারণ করতে গিয়েই ঘটেছিল অঘটন ! এসব কথা এবং ভগবান বুদ্ধের স্বগৃহে গমনের বাকি কথা পরের দিন ৷ [ক্রমশঃ]