গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম মিশনে বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধ বিষয়ক যে সমস্ত কথা বলতেন, তারমধ্যে আমি যেটুকু শুনেছিলাম, সেগুলির মধ্যে আবার যেটুকু আমার মনে আছে – সেইটুকুই আপনাদের সাথে শেয়ার করার প্রয়াসে এই লেখা । ভগবান বুদ্ধ যেদিন ভিক্ষাপাত্র হাতে কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন, সেদিন বৃদ্ধ পিতা শুদ্ধোদনের সাথে তাঁর কিছু কথাবার্তা হয়েছিল ৷ রাজা শুদ্ধোদন ভিক্ষাস্বরূপ কপিলাবস্তু রাজ্যটিকেই সন্ন্যাসী পুত্রকে যখন দিয়ে দিতে চাইলেন – তখন ভগবান বুদ্ধ, পিতাকে নিত্য-অনিত্যের জ্ঞান দান করেছিলেন এবং পিতার দান গ্রহণ করে আবার পিতাকেই তাঁর হয়ে রাজ্যপাট সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন (যেহেতু তিনি জানতেন যে পিতা শুদ্ধোদনের পূর্ব পূর্ব জন্মের সংস্কারে_ রাজ্য সামলানোর ব্যাপারটা রয়েছে) । অর্হত্বপ্রাপ্ত পুত্রের অলৌকিক স্পর্শ পেয়ে এবং অসাধারণ অপার্থিব জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে – পিতা শুদ্ধোদন পুত্রের সামনে কখন যেন আপনা-আপনি নতজানু হয়ে গিয়েছিলেন!
সেদিন কপিলাবস্তুতে এই যে বিশেষ লীলাটি হয়েছিল, সেই ঘটনার সাদৃশ্যযুক্ত একটি ঘটনার কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল আগের দিন _যেখানে শ্রীমন্মহাপ্রভুর গর্ভধারিণী জননীর সাথেও শ্রীচৈতন্যদেবের এই ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল। এখানে সেইটাই এখন বিস্তারিত বলা হচ্ছে ৷ অবশ্যই এই ঘটনাটিও গুরু মহারাজের কাছেই শোনা !
শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীবাসের বাড়িতে প্রত্যহ সন্ধ্যাবেলায় যেতেন এবং ভক্তসঙ্গে মহানন্দে নামসংকীর্তন করতেন ৷বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে শ্রীবাসের অঙ্গনের গুরুত্ব অপরিসীম! ওই আসরেই চৈতন্যের প্রধান পার্ষদ নিত্যানন্দের সাথে ওনার প্রথম দেখা হয়েছিল, ওই বিশেষ স্থানেই মহাপ্রভুর সাথে প্রথমবারের জন্য সাক্ষাৎ হয়েছিল সেকালের বিষ্ময়কর বৈষ্ণব ভক্ত হরিদাসের সাথে ! ওই বাড়িতেই শ্রীবাসের মৃত সন্তানকে পাশের ঘরে চাপা দিয়ে ফেলে রেখে, মহাপ্রভুর যাতে আনন্দে ব্যাঘাত না ঘটে তাই শ্রীবাস ভগবানের সঙ্গ দিয়েছিলেন । এই ঘটনাগুলি সবই কোন না কোন সময় ভগবান পরমানন্দ সিটিংয়ে আলোচনা করেছিলেন । সম্ভব হলে এগুলি সবই পরে পরে আপনাদের সাথে শেয়ার করব – যদি ঠিকঠাক পরিবেশন করতে পারি – তাহলে দেখবেন গ্রন্থে পড়া ঘটনাগুলির থেকে গুরু মহারাজের বলা ঘটনা – কতো প্রাণবন্ত কতো হৃদয়গ্রাহী !!
সে যাই হোক, এখন আমরা সেদিনকার শ্রীবাসের অঙ্গনে ফিরে যাই । মহাপ্রভু সন্ধ্যাবেলায় সকলের সাথে সংকীর্তনানন্দে মত্ত হয়ে নিজে আনন্দ করতেন এবং উপস্থিত সকলকে আনন্দ দিতেন ৷ তারপর সংকীর্তন অন্তে শ্রীবাসের একটি বিশেষ ঘরে ঢুকে যেতেন উনি । সেখানে একেবারে অন্তরঙ্গ কয়েকজনের মাত্র প্রবেশাধিকার ছিল – যাদেরকে নিয়ে উনি প্রেম আস্বাদন করতেন ! এই কথাটা তখন নবদ্বীপের ভক্ত মহলে খুবই প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল, আর এই নিয়ে ভক্তদের মধ্যে কৌতূহলও ছিল খুব ! কি হয় সেখানে ??? প্রত্যেকেই চাইতো যদি একদিনের জন্যেও ওই ঘরটিতে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায় ! কথাটি শচীমাতার কানেও উঠেছিল ! ওনার স্নেহের পুত্রটিকে নিয়ে কি যে এক পাগলামি তে মেতেছে নবদ্বীপের বৈষ্ণব সমাজ !
উনি একদিন ওনার বড় ছেলে নিতাইকে (শচীমাতার দুই পুত্র বিশ্বরূপ ও বিশ্বম্ভর বা নিমাই ৷ বিশ্বরূপ ছোটবেলাতেই সন্ন্যাস নিয়ে চলে যান । পরবর্তীতে যখন অবধূত নিত্যানন্দ বা নিতাই ঘুরতে ঘুরতে নবদ্বীপে এসে হাজির হলেন এবং মহাপ্রভুর সান্নিধ্য লাভ করলেন, সেদিনই গৌরাঙ্গ ওকে সঙ্গে করে মায়ের কাছে নিয়ে এসেছিলেন এবং দাদা নিতাই হিসাবে মা কে ওনার পরিচয় দিয়েছিলেন । সেই থেকেই নিতাই হয়েছিল, নিমাই-এর দাদা বা শচীমাতার বড় পুত্র)– ‘শ্রীবাসের ঘরে অধিক রাত্রিতে কি লীলা ঘটে’ তা জানতে চেয়েছিলেন! নিত্যানন্দ পড়লেন মহামুস্কিলে! মা-কে আর কি বলেন ! তবু ঠারেঠোরে বললেন – ” মা ! তোমার ছেলেকে আমরা সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানে ভজন-পূজন করি !” মা চমকে উঠলেন – ” সে কি ! তাহলে তো আমার ছেলের মহা অকল্যাণ হবে !” নিত্যানন্দ হাসতে হাসতে বললেন – ” মা ! তোমার কাছে নিমাই তোমার ছেলে, কিন্তু শ্রীবাসের ঘরের ভিতরে যে ওর মধ্যে পুরুষোত্তম ভাবের প্রকাশ ঘটে । তখন যে সে সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ হয়ে – হয়ে বৃন্দাবনের লীলার কথা বলে ! সে যদি তুমি নিজের চোখে দেখতে মা – তাহলে বুঝতে পারতে !”
এই কথা শুনে শচীমাতা নিতাই-কে ধরলেন _যাহোক করে তাঁকে একবার শ্রীবাসের ওই বিশেষ ঘরটাতে রাত্রিতে নিয়ে যেতেই হবে ! নিত্যানন্দ-প্রভু আর কি করেন ! তিনি শ্রীবাসের সাথে পরামর্শ করে ভগবানের গর্ভধারিণীর ওই ঘরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । স্থির হয়েছিল যে সময় মহাপ্রভু শ্রীবাস-অঙ্গনে নৃত্যরত থাকবেন – সেই সময়েই চুপিসারে শচীমাতাকে ঐ ঘরে ঢুকিয়ে চৌকির নিচে লুকিয়ে রাখা হবে, আর উনি সেখান থেকেই ওনার পুত্রের ‘ভগবৎ’-রূপ নিজের চোখে দেখতে পারবেন ৷
পূর্বনির্ধারিত ব্যবস্থা অনুযায়ী মাতাশ্রী-কে সন্ধ্যার সময় চৌকির নিচে লুকিয়ে রেখে শ্রীবাস-সহ নিত্যানন্দেরা মহাপ্রভুর সঙ্গে সংকীর্তনে অংশগ্রহণ করলেন ৷ শ্রীবাস-অঙ্গনে মহাপ্রভুর ভাবাবস্থায় নৃত্যরঙ্গের কথা এবং সেই অবস্থায় তাঁর মধ্যে ঈশ্বরীয় ভাবে আবেশ হওয়ার কথা লোকমুখে রটে গিয়েছিল ! সেইজন্য শুধু নবদ্বীপ-ই নয়, শান্তিপুর সহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন সেখানে উপস্থিত হতো ৷ ফলে সন্ধ্যার পর ওই স্থানে (শ্রীবাস-অঙ্গনে) লোকের ভিড় উপচে পড়তো ! বহুমানুষ বাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারত না বলে উঠোনের প্রাচীরের বাইরে থেকেই অলৌকিক ভঙ্গিমায় নৃত্যরত মহাপ্রভু কে দর্শন করতো! ভাবাবস্থায় নৃত্যরত মহাপ্রভুকে যে দেখতো – দর্শনমাত্রেই তার মধ্যেও ভক্তিভাবের সঞ্চার হতো, তাদেরও ভাবাবেশ হতো! তাই একদিন যে এই দৃশ্য দেখতো _সে ঐ টানেই পরের দিনেও ছুটে ছুটে সেখানে হাজির হতো ! গুরু মহারাজ এটাকেই বলেছিলেন ‘আকর্ষণী মুদ্রা’ ! ‘কৃষ্ণ’ – শব্দের একটা অর্থ যিনি আকর্ষণ করেন (কর্ষণ করেন-ও হয়)। যে কোন মহাপুরুষের মধ্যেই এই শক্তি প্রকটিত থাকে, কিন্তু ভগবান যখন লীলা করতে আসেন তখন যেন এই গুণ ১০০% প্রকটিত ।
যাইহোক, সংকীর্তন শেষে মহাপ্রভু সেই বিশেষ ঘরে ঢুকলেন এবং নির্দিষ্ট চৌকিতে পেতে রাখা তাঁর আসনে বসতেই তাঁর মধ্যে ‘ভগবৎ’- ভাব প্রকটিত হয়ে গেল ।
কিন্তু সেদিন তিনি সকলকে উদ্দেশ্য করে প্রেমপূর্ণ বাক্য না বলে হুংকার দিয়ে উঠলেন এবং চক্ষু মুদে থাকা অবস্থাতেই বলে উঠলেন – ” একজন অনধিকারী আজ এই ঘরে প্রবেশ করেছে, তাকে আমার সামনে নিয়ে এসো !” মহাপ্রভুর মুখে ঐরকম সিংহগর্জন শুনে ঘাবড়ে গিয়ে নিত্যানন্দ তাড়াতাড়ি মা-কে চৌকির নিচ থেকে বের করে মহাপ্রভুর সামনে আনলেন । আর সাথে সাথে হঠাৎ করে মহাপ্রভু তার দক্ষিণ পদ প্রসারিত করে – শচীমাতার মস্তকের উপর স্থাপন করলেন! আর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন – ” তোমার ‘বৈষ্ণব অপরাধ’ ক্ষমা করা হলো ! আর কখনও কোনও বৈষ্ণবের মনে আঘাত দিও না ৷”
মহাপ্রভুর এ হেন আচরণে ঘরে উপস্থিত সকলেই হতবাক – হতচকিত হয়ে গিয়েছিল !কিন্তু শচীমাতার দু’চোখে অশ্রুর ধারা বইতে লাগলো ! উনি সেই অবস্থাতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং নিত্যানন্দ তাঁকে বাড়িতে দিয়ে এসেছিলেন । এরপর থেকেই শচীমাতার জীবনচর্যা বদলে গিয়েছিল!! [ক্রমশঃ]