ভগবান শ্রী শ্রী গুরু মহারাজ পরমানন্দ স্বামীর বলা কথা নিয়ে চলছিল আমাদের আলোচনা ৷ এই আলোচনাগুলির বেশিরভাগই ‘কথা প্রসঙ্গে’ নাম নিয়ে বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন থেকে প্রকাশিত ‘চরৈবেতি’ পত্রিকায় অথবা ‘কথা প্রসঙ্গে’ বইগুলির কোনো-না-কোনো খন্ডে প্রকাশিত হয়ে গেছে। তবে হয়তো কিছু কিছু ঘটনা এখানে ‘Extra পাওনা’ হিসাবে পাঠকেরা পেতে পারেন । তাছাড়া ‘কথা প্রসঙ্গে’ লেখাতে লেখকের নিজস্ব স্বাধীনতা খুবই কম – কারণ ওখানে গুরু মহারাজের কথার ব্যাখ্যা করার সুযোগ ওখানে থাকে না, কিন্তু এখানে সেই সুযোগ রয়েছে ! তাই অনেক সময়েই গুরু মহারাজের যে কোন কথার প্রেক্ষিতে একটু আলোচনা করা যায়, প্রয়োজনে গুরু মহারাজের অন্য স্থানে করা আলোচনাও ওই কথার সাথে জুড়ে দেওয়া যায় – তাই স্বাদটা একটু পাল্টায় বই কি !
‘পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা’ – যখন শুরু করা হয়েছিল, তখন লেখক এর উদ্দেশ্য ছিল – গুরু মহারাজের চাল-চলন, ভাব-ভঙ্গি, আচার-আচরণ, তার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তির interaction ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে ! তাছাড়া তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন আশ্রমের ইতিহাস, তাঁর সান্নিধ্যে আসা বিভিন্ন ভক্তদের প্রসঙ্গ – এগুলিও আলোচনা করা হবে ৷
সেইরকমভাবে শুরুও করা হয়েছিল – কিন্তু এ ব্যাপারে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ালো – কিছু পরমানন্দ ভক্ত !! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” মানুষ সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায় ।” এক্ষেত্রেও তাই হল – গুরু মহারাজের কথা বলতে গেলে তো ভগবানের লীলা যাদের সাথে হয়েছিল তাদের কথা বলতেই হবে এবং বলতে হবে সেই সব সত্য ঘটনা__ যেগুলো আমরা তখন ঘটতে দেখেছিলাম । কিন্তু সব মানুষই নিজের সম্বন্ধে বা তার সম্পর্কিত ব্যক্তির সম্বন্ধে কিছু selective কথা এবং ভালো ভালো কথাগুলি-ই মনে রেখে দিয়েছে – বাকি সব কথা ভুলে মেরে দিয়েছে অথবা সেগুলি আর নতুন করে শুনতেই চায় না ! তাই আমি যেইমাত্র সেগুলি বলার চেষ্টা করছিলাম – তারা প্রতিবাদ করতে শুরু করলো! আমাকে ফোনে জানালো – আরো পাঁচজনকে জানালো – বনগ্রাম আশ্রমে গিয়ে মুরারী মহারাজ বা তৃষাণ মহারাজের কাছে গিয়েও আমার নামে Complain জানিয়ে এলো !!
আমার হিতৈষী বন্ধুরা আমাকে পরামর্শ দিল যে – ” আপনি লিখুন, কিন্তু কারো নাম দেবেন না – ‘অমুক-তমুক’ এইভাবে লিখুন – সে চেষ্টাও করেছিলাম ! কিন্তু তাই কি হয় – এতে রসালাপের অসুবিধা হচ্ছিল, লেখার flow নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল – তাই আমি আমার Original জায়গায় ফিরে এসেছি ৷ ‘গুরুমহারাজের মুখের কথা’- লেখার উপরেই তো আমার উপর তাঁর সম্মতি , তাঁর সপ্রেম আশীর্বাদ ! তাই এখানেই ফিরে আসা ! তবে আমার স্থির বিশ্বাস রয়েছে যে, আমি আবার পুরোনো জায়গা থেকে শুরু করবো, আবার বিভিন্ন আশ্রম এবং গুরু মহারাজের বিভিন্ন ভক্তদের নিয়েই লিখবো – যাতে সমস্ত পাঠককুল সেইসব মানুষদের কথা এবং তাদের সাথে গুরু মহারাজের সম্পর্কের কথা জানতে পারবে ৷ ভগবানের কথাই তো বেদ-বেদান্ত ! যে বেদ-বেদান্ত হাজার হাজার বছর আগে অরণ্যে প্রথম উদ্গীত হয়েছিল – রচিত হয়েছিল – সেগুলিই যুগে যুগে ভগবানের অবতারেরা যুগোপযোগী করে নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করে থাকেন । সেই শাশ্বত-সনাতন নিত্য সত্যকেই ভগবান বুদ্ধ একরকম আঙ্গিকে বললেন, ভগবান শঙ্করাচার্য বললেন অন্য আঙ্গিকে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বললেন আর একরকম আঙ্গিকে ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন তাঁর সময়কার যুগোপযোগী আঙ্গিকে, ঠাকুর ভগবান পরমানন্দ সেই সনাতন সত্যকেই প্রকাশ করলেন এ যুগের মতো করে – তাঁর নিজস্ব আঙ্গিকে ৷
এই কিছুদিন হলো – আমার খুব শখ হয়েছিল শ্রীমদ্ভগবদগীতা-কে একটু ভালো করে line-by-line পড়ে তার মানে করার এবং ব্যাখ্যাগুলো ভালো করে বোঝার! চেষ্টাও করলাম – দু-চার পাতা এদিক-ওদিক উল্টেপাল্টে দেখলাম যে – ” ওমা! এগুলো সবই তো আমাদের পরমারাধ্য গুরু মহারাজ করুণাময় ভগবান পরমানন্দ নানাভাবে – বিভিন্ন প্রসঙ্গে, বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করেছিলেন ! তাহলে আর নতুন করে আর কি পড়বো – বরং গুরু মহারাজের কথাগুলোকেই আরো একবার পড়ে ফেলি ৷” পাঠকদেরকে বলছি – জানবেন এই রকমটা সর্বক্ষেত্রেই সত্য ।
যাইহোক, আমরা গুরু মহারাজের বলা ভগবান বুদ্ধ বিষয়ক আলোচনায় ছিলাম, এখন সেখানেই আবার আমরা ফিরে যাচ্ছি । গুরু মহারাজ একবার বলেছিলেন বুদ্ধের সময়কালীন এক বিখ্যাত কোন অঘোরপন্থী কাপালিক অঙ্গুরীমাল বা অঙ্গুলিমালের কথা ! যে নরপিশাচ গভীর কোন জঙ্গলে বাস করত এবং এক একটা মানুষকে মেরে সেই নরমাংস খেতো এবং সাধনার অঙ্গ হিসাবে বা নরহত্যার নিদর্শন হিসাবে সেই মানুষটির একটি করে ‘কড়ে আঙুল’ (কনিষ্ঠ অঙ্গুলি) তার গলায় মালার মতো করে ঝুলিয়ে রাখতো ! আঙ্গুল বা অঙ্গুলি গলায় মালার মতো করে পড়া থাকতো বলেই ওর নাম মানুষ দিয়েছিলে – ‘অঙ্গুলিমাল’!
সেই সময় অঙ্গুলিমাল ছিল ওই অঞ্চলের ত্রাস ! যে জঙ্গলে অঙ্গুলিমাল থাকতো, সেই জঙ্গলটি ছিল দুটি রাজ্যের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ৷ ফলে উভয় রাজ্যেরই শাসনের একটু বাইরে হওয়ায় অঙ্গুলিমাল অবাধে তার এই পিশাচ ক্রিয়ার সাধনার অঙ্গ হিসাবে মানুষ মারার কাজ চালাতে পারতো ! কিন্তু ওই জঙ্গলে ঢুকে যখন একের পর এক লোক মারা পড়তে লাগল – তখন উভয় রাজ্যের রাজাই বারবার সৈন্য পাঠিয়ে ঐ নরপিশাচকে মেরে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলো ৷ কিন্তু অঙ্গুলিমালকে কোনোভাবেই মেরে ফেলা সম্ভব হলো না – সুযোগ পেলেই সে একের পর এক নরহত্যা করেই চলল ৷
অঙ্গুলিমালের সাধনার লক্ষ্য ছিল এক হাজার মানুষকে হত্যা করা – তাই সে তার গলার মালায় কড়ে আঙ্গুলের সংখ্যা প্রায় গুনতো আর দেখতো – আরো কতগুলো মানুষকে হত্যা করলে তার অভিষ্ট পূর্ণ হবে ।
ওই পচা-গলা হাড়ের মালা পড়ে থাকা নরপিশাচ অঙ্গুলিমালের গায়ে সবসময় ভাগাড়ের দুর্গন্ধ বের হতো – সবসময় তার গায়ে মাছি ভনভন করতো – আর তার হাতে সব সময় থাকতো একটা বিরাট খাঁড়া ! এইসব গল্প কথা _তখন ঐ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে ঐ পিশাচের ভয়ে স্থানীয় জনগণ সব সময় সিঁটিয়ে থাকতো ।
যখন অঙ্গুলিমালের আর একটি মাত্র নরহত্যার প্রয়োজন – ঠিক সেই সময় ভগবান বুদ্ধ একদিন ওই জঙ্গলের প্রান্তে এসে উপস্থিত হলেন । বুদ্ধের সহচররা ভগবানকে ওই জঙ্গলের ব্যাপারে সব কথা বলে অঙ্গুলিমালের ব্যাপারে সাবধান করে দিলেন – যাতে ভগবান বুদ্ধ সেখানে বেশিক্ষণ না থাকেন এবং যাতে তাড়াতাড়ি তারা সকলে সেই স্থান থেকে দূরে সরে যেতে পারেন । কিন্তু ঘটনা ঘটেছিল অন্যরকম _সেই ঘটনা পরের দিন। [ক্রমশঃ]