ন’কাকা গুরু মহারাজের কথার পুনরাবৃত্তি করে প্রায়ই বলতেন – ” বাবা ! বৃষ্টি হলো ঈশ্বরের আশীর্বাদ ! বৃষ্টি হোলে সমস্ত জীবজগতের কল্যাণ হয় । গাছ-গাছালি, ঘাস-পালা নতুন করে জীবনী শক্তি লাভ করে। আর ঘাস-পাতা সহ গাছ-গাছালি সবুজ প্রাণবন্ত হয়ে উঠলে সমস্ত জীবজগৎ-ই বেঁচে থাকবে । তাছাড়া বৃষ্টির ধারার সাথে সাথে বাতাসের ভাসমান ধূলি-ধোঁয়া বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে মাটিতে নেমে এসে বাতাসকে বিশুদ্ধ করে । ঠিক তেমনিই মহাপুরুষরাও সমগ্র মানবসমাজকেই কলুষমুক্ত করে তাদের মঙ্গল সাধন করে থাকে ।”
ন’কাকার শরীর ছাড়ার কয়েক বছর আগে হঠাৎ করে আমরা শুনলাম যে ওনার হার্টের (হৃৎপিণ্ড) কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে ! কলকাতার পিয়ারলেস হসপিটালে (প্রাইভেট হসপিটাল) – ন’কাকার সেজদা শ্রী উমাপ্রসাদ প্রসাদ মুখার্জীর ছেলে বিবেকানন্দ চাকুরী করায় – ওখানেই ন’কাকার হার্ট-এর চিকিৎসা হয়েছিল (এই কথাগুলি অবশ্য আগেই বলা হয়েছে)। এ্যান্জিওপ্লাস্টি – হওয়ার পর ন’কাকা কিন্তু যথেষ্টই সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন (অবশ্য ন’কাকা কোনদিনই ঠিক সেভাবে শয্যাশায়ী, অসুস্থ হয়ে থাকেন নি।)! ন’কাকা তাঁর যে নিত্যনৈমিত্তিক কাজ সেগুলি ঠিকই করতেন অর্থাৎ ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে মা করুণাময়ীর মন্দিরে গিয়ে কালীকীর্তন করতেন, কীর্তন শেষে মন্দির থেকে বাড়ি ফিরে আসতেন ভোর পাঁচটার মধ্যে বা তার আগেই ৷
আর সেই সময় থেকেই শুরু হয়ে যেত ফোন আসা – কোনো কোনো ক্ষেত্রে (শুনেছিলাম) ন’কাকা নিজেই ওই সময়ে অনেক ভক্তদেরকে ফোন করতেন (অবশ্যই যাদের খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস আছে, তাদেরকেই উনি ঐসময় ফোন করতেন)।
এরমধ্যেই ন’কাকা গরুর গোয়ালে গিয়ে সেখানকার প্রাথমিক কাজকর্মগুলি সারতেন, এই কাজ করতে গিয়ে তিনি কতবার যে__ কোনো না কোনো ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন (হয় পায়ে হোঁচট লাগত, না হয় গরুতে ওনার পা মাড়িয়ে দিতো অথবা গরুর ধারালো শিং-এ লেগে শরীরে আঘাত লাগতো)– তার ইয়ত্তা নাই ! আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকবার ন’কাকাকে অনুরোধ করতাম – ” ন’কাকা ! এবার আপনার বা কাকিমার বয়স হয়েছে, আর আপনার বাড়ি থেকে গোয়ালটা অনেকটাই দূর, যাওয়া-আসার রাস্তাটাও ভালো নয়, তাছাড়া বর্ষাকাল বা শীতকালে বারবার যাওয়া-আসা করে গরুগুলির যত্ন করা তো আরও কষ্টকর ! সুতরাং এসব আর কেন? ছোটবেলা থেকে দুধ-ভাত খাওয়া অভ্যাস _ দুধ না হোলে হয়তো মন কেমন করবে। কিন্তু দুধের প্রয়োজনের তো অন্য বিকল্প রাস্তাও রয়েছে, পাশেই ঘোষেদের গ্রাম কান্টিপুর, ওখানে দুধের ‘রোজ’ (প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ দুধ দিয়ে যাওয়া) করে নিলেই তো হয় ! গ্রামেও অনেকেই গরু পোষে, তাদের কাছেও পাওয়া যেতে পারে! তাই এবার গরুর ঝামেলা থাকে মুক্ত হ’ন _ন’কাকা!”
কিন্তু কী আশ্চর্য ! ন’কাকা গরু রাখার সপক্ষে-ই সওয়াল করতেন । বলতেন – “তাই বললে কি হয় বাবা ! যতদিন পারি – থাক্ দু-একটা গরু ! একটু কষ্ট হয় ঠিকই , তবু গৃহস্থ বাড়িতে গরু না থাকলে হয়? তবে জানো –অসুবিধা হয় বই কি! এখন তো আর পয়সা দিলেও লোক পাওয়া যায় না ! ওই একজন আছে __যে ‘ছানি'(বিচালি)-টা কেটে দিয়ে যায়, আর আমি শুধু বার কয়েক খেতে দিই – এই আর কি !
এরপর আমি আর ওই অলৌকিক সহজ-সরল, ভালো মানুষ মহাপুরুষটির মুখের ওপর কথা বলতে পারতাম না ! একেবারে শেষের দিকে অর্থাৎ 2018 সালের প্রথম দিকে ন’কাকা যখন আদিত্যপুর (বোলপুর) আশ্রমে রয়েছেন – তখন একদিন ন’কাকিমা ওনাকে ফোনে খবর দিলেন – “গরুর বাছুরটা মারা গেছে ৷” কাকিমার সঙ্গে কথা বলা সাঙ্গ করে – ন’কাকা আমার দিকে তাকিয়ে ওই খবরটি দিলেন এবং ঘোষণা করলেন, ” এইবার গাই গরুটি দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিলেই – গরুটা আশ্রমে মুরারী-কে (স্বামী নিষ্কামানন্দ মহারাজ) দিয়ে দেবো । আর গরু রাখবো না ।”
কিন্তু ওই গাই গরুটি তার অমৃতধারার ক্ষরণ বন্ধ ততদিন করেনি, যতদিন ন’কাকা তাঁর স্থূল শরীর ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা না করেছেন ! [ক্রমশঃ]
ন’কাকার শরীর ছাড়ার কয়েক বছর আগে হঠাৎ করে আমরা শুনলাম যে ওনার হার্টের (হৃৎপিণ্ড) কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে ! কলকাতার পিয়ারলেস হসপিটালে (প্রাইভেট হসপিটাল) – ন’কাকার সেজদা শ্রী উমাপ্রসাদ প্রসাদ মুখার্জীর ছেলে বিবেকানন্দ চাকুরী করায় – ওখানেই ন’কাকার হার্ট-এর চিকিৎসা হয়েছিল (এই কথাগুলি অবশ্য আগেই বলা হয়েছে)। এ্যান্জিওপ্লাস্টি – হওয়ার পর ন’কাকা কিন্তু যথেষ্টই সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন (অবশ্য ন’কাকা কোনদিনই ঠিক সেভাবে শয্যাশায়ী, অসুস্থ হয়ে থাকেন নি।)! ন’কাকা তাঁর যে নিত্যনৈমিত্তিক কাজ সেগুলি ঠিকই করতেন অর্থাৎ ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে মা করুণাময়ীর মন্দিরে গিয়ে কালীকীর্তন করতেন, কীর্তন শেষে মন্দির থেকে বাড়ি ফিরে আসতেন ভোর পাঁচটার মধ্যে বা তার আগেই ৷
আর সেই সময় থেকেই শুরু হয়ে যেত ফোন আসা – কোনো কোনো ক্ষেত্রে (শুনেছিলাম) ন’কাকা নিজেই ওই সময়ে অনেক ভক্তদেরকে ফোন করতেন (অবশ্যই যাদের খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস আছে, তাদেরকেই উনি ঐসময় ফোন করতেন)।
এরমধ্যেই ন’কাকা গরুর গোয়ালে গিয়ে সেখানকার প্রাথমিক কাজকর্মগুলি সারতেন, এই কাজ করতে গিয়ে তিনি কতবার যে__ কোনো না কোনো ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন (হয় পায়ে হোঁচট লাগত, না হয় গরুতে ওনার পা মাড়িয়ে দিতো অথবা গরুর ধারালো শিং-এ লেগে শরীরে আঘাত লাগতো)– তার ইয়ত্তা নাই ! আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকবার ন’কাকাকে অনুরোধ করতাম – ” ন’কাকা ! এবার আপনার বা কাকিমার বয়স হয়েছে, আর আপনার বাড়ি থেকে গোয়ালটা অনেকটাই দূর, যাওয়া-আসার রাস্তাটাও ভালো নয়, তাছাড়া বর্ষাকাল বা শীতকালে বারবার যাওয়া-আসা করে গরুগুলির যত্ন করা তো আরও কষ্টকর ! সুতরাং এসব আর কেন? ছোটবেলা থেকে দুধ-ভাত খাওয়া অভ্যাস _ দুধ না হোলে হয়তো মন কেমন করবে। কিন্তু দুধের প্রয়োজনের তো অন্য বিকল্প রাস্তাও রয়েছে, পাশেই ঘোষেদের গ্রাম কান্টিপুর, ওখানে দুধের ‘রোজ’ (প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ দুধ দিয়ে যাওয়া) করে নিলেই তো হয় ! গ্রামেও অনেকেই গরু পোষে, তাদের কাছেও পাওয়া যেতে পারে! তাই এবার গরুর ঝামেলা থাকে মুক্ত হ’ন _ন’কাকা!”
কিন্তু কী আশ্চর্য ! ন’কাকা গরু রাখার সপক্ষে-ই সওয়াল করতেন । বলতেন – “তাই বললে কি হয় বাবা ! যতদিন পারি – থাক্ দু-একটা গরু ! একটু কষ্ট হয় ঠিকই , তবু গৃহস্থ বাড়িতে গরু না থাকলে হয়? তবে জানো –অসুবিধা হয় বই কি! এখন তো আর পয়সা দিলেও লোক পাওয়া যায় না ! ওই একজন আছে __যে ‘ছানি'(বিচালি)-টা কেটে দিয়ে যায়, আর আমি শুধু বার কয়েক খেতে দিই – এই আর কি !
এরপর আমি আর ওই অলৌকিক সহজ-সরল, ভালো মানুষ মহাপুরুষটির মুখের ওপর কথা বলতে পারতাম না ! একেবারে শেষের দিকে অর্থাৎ 2018 সালের প্রথম দিকে ন’কাকা যখন আদিত্যপুর (বোলপুর) আশ্রমে রয়েছেন – তখন একদিন ন’কাকিমা ওনাকে ফোনে খবর দিলেন – “গরুর বাছুরটা মারা গেছে ৷” কাকিমার সঙ্গে কথা বলা সাঙ্গ করে – ন’কাকা আমার দিকে তাকিয়ে ওই খবরটি দিলেন এবং ঘোষণা করলেন, ” এইবার গাই গরুটি দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিলেই – গরুটা আশ্রমে মুরারী-কে (স্বামী নিষ্কামানন্দ মহারাজ) দিয়ে দেবো । আর গরু রাখবো না ।”
কিন্তু ওই গাই গরুটি তার অমৃতধারার ক্ষরণ বন্ধ ততদিন করেনি, যতদিন ন’কাকা তাঁর স্থূল শরীর ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা না করেছেন ! [ক্রমশঃ]