গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বনগ্রাম মিশনে সিটিং-এ যে সমস্ত কথা আলোচনা করতেন – তারই কিছু কিছু অংশ আপনাদের সামনে পেশ করার প্রচেষ্টা এই – ” পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা”! আমরা এখন আলোচনা করছিলাম ভগবান বুদ্ধ বিষয়ক যে সমস্ত কথা ভগবান পরমানন্দ বলেছিলেন, তার যতটা আমি শুনেছিলাম – সেইসব প্রসঙ্গগুলি ! ভগবান বুদ্ধ সম্বন্ধে যখনই গুরু মহারাজ কোন প্রসঙ্গ করতেন – তখনই আমরা দেখতাম গুরু মহারাজের মুখমণ্ডল কেমন যেন আনন্দঘন হয়ে উঠতো – – উনি করুণা-মৈত্রী-প্রেম-শান্তির একটা পারফেক্ট প্রতিমূর্তি হয়ে উঠতেন! যে কোন মহাপুরুষের সামনে বসে – তাঁর নিজের মুখ থেকে অন্য কোন মহাপুরুষের কথা বা আধ্যাত্মিক তত্ত্ব সমূহ শোনার বাড়তি পাওনা হচ্ছে ওটাই ! ‘ওটাই’- বলতে যা বোঝাতে চাইছি, সেটা বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয় ৷
আমরা আগেও বলার চেষ্টা করেছি যে – বিভিন্ন তিথি-নক্ষত্রের প্রভাবও পড়তো গুরু মহারাজের শরীরে বা মুখমন্ডলে ! গুরু মহারাজের মুখের ঐরকম দীপ্তি দেখে, ওনার কথা বলার স্বতস্ফূর্ততা দেখে বা অন্যান্য কিছু লক্ষণ দেখে আমরা বুঝতেই পারতাম যে, ‘আজ বোধহয় কোনো বিশেষ তিথি – হয়তো কোন মহাপুরুষের জন্মতিথি !’ এটাও আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম যে, ‘নিশ্চয়ই আজ সিটিং-এ গুরু মহারাজের কোন প্রিয় ভক্ত এসেছেন অথবা এখনই এসে পৌঁছাবেন – তাই ওনার মধ্যে এইরকম একটা খুশি খুশি ভাব !’ এছাড়া যেটা আগে বলা হলো, যখনই উনি কোন আধ্যাত্মিক তত্ত্ব আলোচনা করতেন তখন যেন মনে হতো উনি কোন প্রাচীন ঋষি – আর আমরা ওনার সামনে যারা বসে রয়েছি তারা যেন মুনি তপোবনের আশ্রম-বালক ৷ আবার যখন উনি রাম, কৃষ্ণ, ভগবান বুদ্ধ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ – প্রমুখদের সম্বন্ধে কোনো আলোচনা করতেন, – তখন আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখতাম যে গুরুমহারাজ তখন সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে যেতেন – যখন যাঁর কথা বলতেন তখন তিনি যেন তাঁরই রূপ পরিগ্রহ করতেন !
অবশ্য এমনটাই তো হওয়া উচিত ! ‘100% involvement’ বলে একটা কথা আমরা শুনি – কিন্তু সেটার বাস্তব প্রয়োগ সাধারণভাবে কখনোই দেখতে পাই না ! এটা পাওয়া যায় শুধুমাত্র মহাপুরুষদের জীবনে – তাঁদের সবকিছুই 100%, সবকিছুতেই তাঁরা 100% ! তাইতো তাঁরা নিজেরা পুরনো এবং নিজেরা পূর্ণ এবং নিজে পূর্ণ হয়ে তবেই পূর্ণত্বের স্বাদ আস্বাদন করতে সক্ষম হয়েছেন ! উপনিষদ বলেছেন – ” পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে …….. “! আর ভগবানের অবতারগণ তো পূর্ণ হয়েই আসেন ! এখানে ‘পূর্ণ’ হওয়া বলতে, ‘পূর্ণজ্ঞান’ বিশিষ্ট হওয়া বোঝানো হচ্ছে ! “পূর্ণজ্ঞান” অর্থাৎ “পূর্ণের পূর্ণজ্ঞান” ! সেই অর্থে একমাত্র পূর্ণের-ই থাকে পূর্ণজ্ঞান ।
সুতরাং বোঝাই গেল যে, গুরুমহারাজ যখন বুদ্ধ বিষয়ে কথা বলতেন – তখন কেন তাঁর মুখমণ্ডলে আমরা মৈত্রী-করুণা-প্রেম ও শান্তির পূর্ণ প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতাম ! যাইহোক, আমরা আলোচনা করছিলাম গুরু মহারাজের মুখনিঃসৃত বুদ্ধ বিষয়ক কথা। আগের দিন আমরা ছিলাম নরপিশাচ অঙ্গুলিমালের কথায় – যে ব্যক্তি, মনুষ্য শরীরবিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃত অর্থেই একজন নরপিশাচ ছিল । সে পিশাচ সাধনা করতো ! ফলে সে সবসময় শরীরে নোংরা-দূর্গন্ধ জিনিস মাখতো বা ব্যবহার করতো ৷ গুরু মহারাজের কাছে আমরা শুনেছিলাম যে, পিশাচ সাধনায় দূর্গন্ধ বিশিষ্ট জিনিস ব্যবহার করতে হয় । এরা দাঁত মাজে না – মুখে ভাগাড়ের মতো গন্ধ থাকে, স্নান করে না – মাথায় বড় বড় ঝাঁকরা ঝাঁকরা চুল, জটাও হতে পারে, তাতে উকুন কিলবিল করছে । গায়ে গু মাখে অথবা অঙ্গুলিমালের মতো পচা গলিত আঙুলের মালা !
এরফলে, এই ধরনের পিশাচ-সাধকেরা যখন যেখানে থাকে সেখানে তার ধারে কাছে কোন সাধারণ মানুষ টিকতেই পারবে না ।তার উপর এরা যেহেতু নরমাংস খায়, নরবলি দেয় – তাই এদের কাছে যাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না ! সেদিন কিন্তু ভগবান বুদ্ধ অঙ্গুলিমাল সম্বন্ধে সব কথা শোনার পরেও জঙ্গলের সামনে কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং তারপর ধীরে ধীরে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে গেলেন ! উপস্থিত সকলে ভগবান বুদ্ধের এ হেন আচরণে একেবারে হতবাক । ভগবান সঙ্গীদের কাউকে সঙ্গেও যেতে বলেন নি – বরং নিরাপদ কোন আশ্রয়ে থেকে ওনার জন্য অপেক্ষা করতে বলে গেছিলেন ! সুতরাং বুদ্ধ ভক্তদের প্রাণটা ফেটে যাচ্ছিল কিন্তু কিছুই করতে পারছিল না ! নগরের অন্যান্য ভক্তরাও সন্ধ্যার অন্ধকারে ভগবানের জঙ্গলে ঢুকে পড়ার দৃশ্য দেখে “হায়-হায়” করে উঠল । যে জঙ্গলে রাজার সৈন্যরা দিনের বেলাতেই যেতে ভয় পায় – সেখানে ভগবান বুদ্ধ একাকী ওই জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন, ওই নরপিশাচের খপ্পরে স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন ! রাত্রি ভোর হলেই ভগবান বুদ্ধের মৃত শরীর দেখতে হবে !!
বুদ্ধের বেদনাহত সহকারীরা সেখানেই বসে রইলো, কিন্তু স্থানীয়রা রাজধানীতে গিয়ে খবর দিল যে ভগবান বুদ্ধ অঙ্গুলিমালের খপ্পরে –তাই তাকে উদ্ধার করতেই হবে ! রাজার আদেশে একটা বিশাল সৈন্যবাহিনী সেই স্থানে এসে হাজির হলো ! কিন্তু এলে কি হবে – চারিদিকে মশালের আলোয় সমস্ত স্থান আলোকিত হয়ে গেল বটে – তবে জঙ্গলের ভিতরে ওই অন্ধকারে কেউ ঢুকতে চাইল না ! সবাই সেখানেই ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা করতে লাগল ! ওই জঙ্গলের ওপারে যে রাজা ছিল – তিনিও বুদ্ধের শিষ্য ছিলেন, যেভাবেই হোক, তার কানেও খবর পৌঁছে গিয়েছিল, তিনিও জঙ্গলের বিপরীত প্রান্তে বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে হাজির হয়েছিলেন । তবে তার সৈন্যরাও কেউ ওই রাত্রে জঙ্গলে ঢোকে নি । সবাই আপন আপন স্থানে ভোর হবার জন্য অপেক্ষা করছিল !
অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও ভোর হয়েছিল ! কথায় বলে যে, ” দুর্ভাগ্যের রজনী দীর্ঘতর হয় ” – বুদ্ধ ভক্তদের কাছে সেই রজনীটি সত্যিই দীর্ঘতর ছিল, দুঃস্বপ্নের রাত্রিটি যেন কাটতেই চাইছিল না! কিন্তু সময় তো আর থেমে থাকে না – তাই রাত্রি শেষে পুব আকাশে লালিমার আভা দেখা দিয়েছিল, আর ঘটেছিল ভগবান বুদ্ধের জীবনেতিহাসে এক আশ্চর্য্যতম ঘটনা !!
ঘটনাটির বর্ণনা পরের দিন । [ক্রমশঃ]