গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন – ” প্রাণীজগতে নারীরাই পুরুষ নির্বাচন করে । পাখি সমাজ বা পশু সমাজে যে অনেক সময় জোড়ায় জোড়ায় তাদেরকে দেখা যায় – সেখানে কে পুরোহিত ছিল, যে তাদের জোড় বেঁধে দিয়েছে ? কোনো নাপিত-পুরুত-মোল্লা-ফাদার কি কোন ক্রিয়াকাণ্ড করেছিলো ? তবু তাদের জোড় বাঁধতে তো কোন অসুবিধা হয় নি ! বরং দেখা যায়, আমৃত্যু তাদের এই জোড়-বাঁধা অক্ষুণ্ন থাকে ৷”
গুরুমহারাজ একটি বিশেষ প্রজাতির পাখির উল্লেখ করেছিলেন, যাদের একজন মারা গেলে অপর পাখিটি অনেক উঁচুতে উঠে গিয়ে আছাড় খেয়ে মাটিতে ঐ মৃত পাখিটির দেহের উপর পড়ে ; এইভাবে দুই একবার পড়ার পর সে আহত-ক্ষতবিক্ষত হয়ে প্রাণত্যাগ করে ! রামায়ণে বর্ণিত বাল্মিকী যে ক্রৌঞ্চ-মিথুনের কথা বলেছিলেন, সেখানেও এই ধরনের একটি চিত্র পাওয়া যায় । সুতরাং, মানুষের মধ্যে যে সহমরণ প্রথার প্রচলন ছিল – সেটাও নতুন কিছু নয়, প্রাণীজগতে বহুকাল থেকে এর উদাহরণ রয়েছে !
যাইহোক, গুরুমহারাজ যেটা বলেছিলেন – জোড় বাঁধার সময় প্রাকৃতিকভাবেই নারীরা ‘পুরুষ’ নির্বাচন করে । মনুষ্যসমাজে বর্তমানে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে বটে – কিন্তু প্রাচীনকালে স্বয়ংবর প্রথা চালু ছিল এইজন্যেই ! পরবর্তীতে পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থা প্রবলভাবে সমাজে চালু হওয়ায় – নারীদের অধিকারকে চরমভাবে খর্ব করা হয়েছিলো, ফলে পুরুষের চাহিদা মেটাতে, তাদের লালসা চরিতার্থ করতে – নারীদেরকে পণ্য হিসেবে গণ্য করা শুরু হলো ৷ মূল্যবান বস্তু বোঝাতে “রত্ন” কথাটি ব্যবহৃত হয়, মধ্যযুগের পর থেকে নারীকে অনেক স্থানে ‘নারীরত্ন’ বলা হয়েছে। কিন্তু ‘নারীরত্ন’- এই শব্দটি বেদ-উপনিষদ বা প্রাচীন পুরাণাদি শাস্ত্রগুলিতে পাওয়া যায় না – যদিও কোথাও থাকে, তাহলে পরবর্তীকালে এই শব্দটি সংযোজন হয়েছে বা এর ব্যবহার শুরু হয়েছে ৷
গুরুমহারাজ এটাও বলেছিলেন – ” আবার এমন সময় আসবে যখন নারীরাই তার স্বামীকে বা পুরুষসঙ্গীকে নির্বাচন করবে । পুরুষের কঠোর অনুশাসনের (সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয়) মধ্যে খুব বেশীদিন আর নারীরা আটকে থাকবে না – শৃংখল উন্মোচন করে বেরিয়ে আসবে ৷” গুরুমহারাজ বলেছিলেন – তেমন প্রয়োজন হলে উনি নিজেই একবার পৃথিবীতে নারীশরীর নিয়ে আসবেন এবং নারীর মহিমাকে সর্বতোভাবে তুলে ধরবেন ।
তবে নারী-পুরুষ, তাদের ভেদ, অধিকার ইত্যাদিগুলি সবই সাধারণ মানব সমাজের জন্য ! অনন্তের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের ভেদ নাই ! মানবচেতনা ঈশ্বরীয় চেতনায় উন্নীত হলে বোধ হয় – ” আত্মা পুরুষায় শাশ্বতে ৷” আত্মা নিত্য, মুক্ত, শাশ্বত, সনাতন !
তবে এখানে যেহেতু সাধারণ মানুষের কথাই হচ্ছিল – তাই মূল আলোচনায় ফিরে আসি। প্রকৃতিতে নারীরাই পুরুষ নির্বাচন করে! কিন্তু এটা তারা করে শুধুমাত্র সুস্থ-সবল পরবর্তী প্রজন্ম সৃজনের জন্য । পশু বা পক্ষীজগতে সাধারণত হৃষ্টপুষ্ট, বলবান, নিরোগ কোন পুরুষ একটা দলের দলপতি হয় এবং সেই সেই দলের সমস্ত নারীর উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখে । এটা ততদিন চলে যতদিন না ঐ দলপতি বৃদ্ধ হয় এবং তরুণ কোন বলশালী পশু বা পাখি ওই দলপতিকে মারামারিতে পরাজিত করে তার কর্তৃত্ব কায়েম করে ! অন্যান্য দলের দলপতি বা দলছুট্ কোন মদ্দাপুরুষও ঐ দলপতির সাথে লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হয় – নারীর অধিকার নিয়ে !
সুতরাং এটাই দেখা যায় যে, মনুষ্যেতর প্রাণীতে নারী-পুরুষের মিলন শুধুমাত্র সুস্থ-সবল প্রজন্ম বজায় রাখার জন্য ! বেশিরভাগ পশু-পাখি বা প্রাণীর-ই এরজন্য নির্দিষ্ট season বা ঋতু রয়েছে – তারা নির্দিষ্ট ঋতুতেই মিলিত হয় । আদিম মানব সমাজেও এই একই system বজায় ছিল । পরবর্তীতে মানবের মনোজগতের বিবর্তন হ‌ওয়ায় এবং সুস্থ সমাজ-জীবন, ঝঞ্ঝাটমুক্ত পারিবারিক জীবন আসায় – নারী-পুরুষের সম্বন্ধের মধ্যে একটা নতুন মাত্রা এসেছিল । নর-নারীর মধ্যে স্নেহ-প্রেম-প্রণয়-ভালোবাসা-মান-অভিমান ইত্যাদির আগমন ঘটেছিল অর্থাৎ মন-বুদ্ধির বিবর্তন ক্রিয়ার নানান ফল ফলতে শুরু করেছিল। সমাজকে সুস্থির এবং সুদৃঢ় করতে পারিবারিক বন্ধনকেও দৃঢ় করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল – এই জন্যই বিবাহ-প্রথা সমাজে আনাটা তৎকালীন সমাজপতিদের কাছে জরুরী হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া ব্যভিচার যাতে সমাজকে কলুষিত করতে না পারে – তার জন্যই শুরু হয়েছিল বিবাহ প্রথা। ভারতীয় শাশ্ত্রে রয়েছে – ঋষি উদ্দালক ছোটবেলায় তার গর্ভধারিনী জননীর অসহায়ভাবে অন্য পুরুষের(একজন অতিথি) অঙ্কশায়িনী হোতে দেখে(তখনকার সমাজে অতিথি সৎকারের অন্যতম অঙ্গ ছিল – ঐ অতিথির পছন্দমতো রমনীকে তার শয্যাসঙ্গী হোতে হবে) খুবই ব্যথিত হ’ন এবং তখন থেকেই তিনি সংকল্প করেন যে তিনি বড় হয়ে এর বিহিত-ব্যবস্থা করবেন – বর্তমানের বিবাহ প্রথা তাঁরই সৃষ্টি! (নারী-পুরুষের সম্পর্কের বিবর্তন পরের সংখ্যায়) … [ক্রমশঃ]