[গুরু মহারাজের বলা নারী পুরুষের যুগল-সাধনার কথা নিয়ে এখন কথা চলছিল।]
গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন – মানব শরীরে শুক্র বা বীর্য সৃষ্টি হতে সাতটি ধাপ অতিক্রম করতে হয় । স্থূল শরীরের সমস্ত রকম kinetic শক্তির যোগান দেয় খাদ্যরস, তাই বিবর্তনটা এখান থেকেই শুরু হয় ;– রস – রক্ত – মাংস – বসা বা চর্বি – অস্থি – মজ্জা – শুক্র ! যে শরীরে মজ্জা যত শক্তিশালী বা ঠাসা – জমাট অবস্থায় থাকে, সেই শরীরের পুরুষত্ব ততো বেশী – রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ততো বেশী, তার আধ্যাত্মিক শক্তিও আর পাঁচজনের থেকে বেশি । ফলে অহেতুক শুক্র ক্ষয় মানবকে শক্তিহীন করে তোলে – ধীরে ধীরে তা পুরুষের পৌরুষ বা পুরুষত্বের চরম ক্ষতি সাধন করে । সেইজন্যেই বেশীরভাগ মহাপুরুষ-মহাত্মাগণ পুরুষের ব্রহ্মচর্যের উপর সবসময় সর্বাধিক জোর দিয়েছেন ।
শৃঙ্গার সাধন বা যুগল সাধন ইত্যাদির সূচনাও হয়েছিল এই উদ্দেশ্যেই ! মহাপুরুষগণ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন সকল মানুষের কল্যাণ করার জন্য । তারা দেখলেন মানুষের জীবনে নর-নারীর পারস্পারিক আসঙ্গলিপ্সা এক চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে – যেখান থেকে তাদেরকে নিবৃত্তির পথে নিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব ৷ তখনই তাঁরা(বিভিন্ন মতের প্রবর্তকেরা) ভোগের মাধ্যমে ত্যাগের পন্থা-পদ্ধতি সম্বন্ধে গবেষণা শুরু করলেন । তারই ফল তন্ত্রে, বৈষ্ণব মতে, বাউল মতে – নারী নিয়ে সাধন ! কি হয় এই সাধন পদ্ধতিতে ? মহাজনেরা বলেন__ তরল খেজুর রসে (আখ রস) জ্বাল দিলে যেমন তা প্রথমে ঘন হয়ে গুড়ে পরিণত হয়, এরপর তাকে আবার processing করলে তা ওলায় (কঠিন মিছরি) পরিণত হয় ৷ তেমনি নারীর সাথে পুরুষের মিলনের সময় যখন কামনার অগ্নি জ্বলে ওঠে – সেই সময়, সাধনার দ্বারা নিম্নগামী শুক্রকে ঊর্ধ্বগামী করতে পারলে ওই উত্তাপ তরল রসকে প্রথমে ঘন রসে এবং পরে কঠিন মিছরি দানায় পরিণত করতে পারে ৷ এই পদ্ধতি যেন – শত্রুর শক্তিকে মিত্রশক্তিতে পরিণত করা এবং তাকে কাজে লাগিয়ে ভোগের উল্লাস থেকে মুখ ঘুরিয়ে ত্যাগের চরম ভূমিতে পৌঁছাতে পারা!!
শৃঙ্গার সাধনায় (নর ও নারীর মিলিত অবস্থায়) প্রথম এবং প্রধান শর্ত প্রাণায়াম সিদ্ধি । রেচক, পূরক ও কুম্ভক (রেচক-কুম্ভক-পূরক নয়) এই ক্রমে শ্বাসের ক্রিয়া করতে হয় ৷ সাধারণত মানুষের শুক্র মস্তিষ্ক থেকে পিঙ্গলা নাড়ী বরাবর প্রবলবেগে নীচের দিকে ধাবিত হয় এবং ক্ষণিক আনন্দ দান করে, আর নারীর শরীরেও তা বিদ্যুৎপ্রবাহ সৃষ্টি করে (কারণ শুক্র বিদ্যুৎশক্তির ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন,ফলে পুরুষের শরীরে এটি তৈরি হবার সময় বা নিঃসৃত হবার সময় যেমন পুরুষের শরীরে আনন্দের শিহরন অনুভব করে_তেমনি এটি নারী শরীরে গিয়েও আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে)। কিন্তু প্রাণায়াম সিদ্ধ সাধক বাম নাসায়(নাকের বাঁ দিকের ফুটো দিয়ে) শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ করে এই নিম্নগামী শুক্রকে পুনরায় ঊর্ধ্বপথে চালনা করে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয় । এরপর পিঙ্গলা নাড়ী বা ডান নাসায় শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে ঐ শুক্রকে পুনরায় নিম্নে সুষুন্মা মুখে আনতে হয় ! এইভাবে শুক্রকে বাইরে নির্গত হতে না দিয়ে প্রাণায়াম ক্রিয়ার সাহায্যে বারবার ঊর্ধ্বগতি ও নিম্নগতি প্রদান করার সিদ্ধি অর্জন করতে পারলে সাধক ও সাধিকা উভয়েই এক অপরিসীম ও দীর্ঘস্থায়ী আনন্দ আস্বাদন করতে পারে !
এইভাবে এই ক্রিয়ায় সাধক ও সাধিকা উভয়েই সমরস প্রাপ্ত হলে অর্থাৎ উভয়েরই প্রাণায়াম ক্রিয়ায় সিদ্ধি এসে গেলে সুষুম্মাদ্বার খুলে যায় এবং হু হু করে ওই শক্তি ঊর্ধ্বপথে সহস্রারের দিকে ধাবিত হতে শুরু করে – এই অবস্থাতেই সুষুম্মা-মধ্যস্থ চক্রগুলি একের পর এক খুলে যেতে থাকে এবং সাধক-সাধিকার উভয়েরই হ্লাদিনী শক্তির প্রকাশ ঘটে এবং মিলনরত অবস্থায় উভয়েরই রাধা-কৃষ্ণের দর্শন হয় !
চন্ডীদাসের পদে রয়েছে – ” দুই ধারা যখন একত্র থাকে । / তখন রসিক যুগল দেখে ।৷” এই অবস্থা প্রাপ্ত হলে সাধক সাধিকা এক অনির্বচনীয় আনন্দ সাগরে নিমগ্ন হয়ে যান । সহজ ভাবে সহজ প্রেমরসের আস্বাদন হয় এই ক্রিয়ায় – তাই এর নাম ‘সহজ-সাধন’। যেহেতু এই পথে ভোগের মধ্যে দিয়ে যোগের শিখরে পৌঁছানো যায় সেইজন্যই এই সাধনাকে সহজ-সাধন বলে বর্ণনা করা হয়েছে ৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এই পথের প্রবক্তা, তাই শ্রীকৃষ্ণই ‘সহজ মানুষ’ আর তার সাধন সঙ্গী ‘প্রেমময়ী রাধা’। এই পথ বা মার্গ অবলম্বন করে যেসব সাধক সিদ্ধ হন – তিনিই ‘সহজ অবস্থা’ প্রাপ্ত হন । স্থূল বৃন্দাবনের লীলা থেকে তাঁরা নিত্যবৃন্দাবনে স্থিত হ’ন । মধুর রসের এই সাধনাকেই বৈষ্ণবেরা ‘সহজ ভজন’ বলেন । … [ক্রমশঃ]
গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন – মানব শরীরে শুক্র বা বীর্য সৃষ্টি হতে সাতটি ধাপ অতিক্রম করতে হয় । স্থূল শরীরের সমস্ত রকম kinetic শক্তির যোগান দেয় খাদ্যরস, তাই বিবর্তনটা এখান থেকেই শুরু হয় ;– রস – রক্ত – মাংস – বসা বা চর্বি – অস্থি – মজ্জা – শুক্র ! যে শরীরে মজ্জা যত শক্তিশালী বা ঠাসা – জমাট অবস্থায় থাকে, সেই শরীরের পুরুষত্ব ততো বেশী – রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ততো বেশী, তার আধ্যাত্মিক শক্তিও আর পাঁচজনের থেকে বেশি । ফলে অহেতুক শুক্র ক্ষয় মানবকে শক্তিহীন করে তোলে – ধীরে ধীরে তা পুরুষের পৌরুষ বা পুরুষত্বের চরম ক্ষতি সাধন করে । সেইজন্যেই বেশীরভাগ মহাপুরুষ-মহাত্মাগণ পুরুষের ব্রহ্মচর্যের উপর সবসময় সর্বাধিক জোর দিয়েছেন ।
শৃঙ্গার সাধন বা যুগল সাধন ইত্যাদির সূচনাও হয়েছিল এই উদ্দেশ্যেই ! মহাপুরুষগণ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন সকল মানুষের কল্যাণ করার জন্য । তারা দেখলেন মানুষের জীবনে নর-নারীর পারস্পারিক আসঙ্গলিপ্সা এক চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে – যেখান থেকে তাদেরকে নিবৃত্তির পথে নিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব ৷ তখনই তাঁরা(বিভিন্ন মতের প্রবর্তকেরা) ভোগের মাধ্যমে ত্যাগের পন্থা-পদ্ধতি সম্বন্ধে গবেষণা শুরু করলেন । তারই ফল তন্ত্রে, বৈষ্ণব মতে, বাউল মতে – নারী নিয়ে সাধন ! কি হয় এই সাধন পদ্ধতিতে ? মহাজনেরা বলেন__ তরল খেজুর রসে (আখ রস) জ্বাল দিলে যেমন তা প্রথমে ঘন হয়ে গুড়ে পরিণত হয়, এরপর তাকে আবার processing করলে তা ওলায় (কঠিন মিছরি) পরিণত হয় ৷ তেমনি নারীর সাথে পুরুষের মিলনের সময় যখন কামনার অগ্নি জ্বলে ওঠে – সেই সময়, সাধনার দ্বারা নিম্নগামী শুক্রকে ঊর্ধ্বগামী করতে পারলে ওই উত্তাপ তরল রসকে প্রথমে ঘন রসে এবং পরে কঠিন মিছরি দানায় পরিণত করতে পারে ৷ এই পদ্ধতি যেন – শত্রুর শক্তিকে মিত্রশক্তিতে পরিণত করা এবং তাকে কাজে লাগিয়ে ভোগের উল্লাস থেকে মুখ ঘুরিয়ে ত্যাগের চরম ভূমিতে পৌঁছাতে পারা!!
শৃঙ্গার সাধনায় (নর ও নারীর মিলিত অবস্থায়) প্রথম এবং প্রধান শর্ত প্রাণায়াম সিদ্ধি । রেচক, পূরক ও কুম্ভক (রেচক-কুম্ভক-পূরক নয়) এই ক্রমে শ্বাসের ক্রিয়া করতে হয় ৷ সাধারণত মানুষের শুক্র মস্তিষ্ক থেকে পিঙ্গলা নাড়ী বরাবর প্রবলবেগে নীচের দিকে ধাবিত হয় এবং ক্ষণিক আনন্দ দান করে, আর নারীর শরীরেও তা বিদ্যুৎপ্রবাহ সৃষ্টি করে (কারণ শুক্র বিদ্যুৎশক্তির ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন,ফলে পুরুষের শরীরে এটি তৈরি হবার সময় বা নিঃসৃত হবার সময় যেমন পুরুষের শরীরে আনন্দের শিহরন অনুভব করে_তেমনি এটি নারী শরীরে গিয়েও আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে)। কিন্তু প্রাণায়াম সিদ্ধ সাধক বাম নাসায়(নাকের বাঁ দিকের ফুটো দিয়ে) শ্বাসের নিয়ন্ত্রণ করে এই নিম্নগামী শুক্রকে পুনরায় ঊর্ধ্বপথে চালনা করে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয় । এরপর পিঙ্গলা নাড়ী বা ডান নাসায় শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে ঐ শুক্রকে পুনরায় নিম্নে সুষুন্মা মুখে আনতে হয় ! এইভাবে শুক্রকে বাইরে নির্গত হতে না দিয়ে প্রাণায়াম ক্রিয়ার সাহায্যে বারবার ঊর্ধ্বগতি ও নিম্নগতি প্রদান করার সিদ্ধি অর্জন করতে পারলে সাধক ও সাধিকা উভয়েই এক অপরিসীম ও দীর্ঘস্থায়ী আনন্দ আস্বাদন করতে পারে !
এইভাবে এই ক্রিয়ায় সাধক ও সাধিকা উভয়েই সমরস প্রাপ্ত হলে অর্থাৎ উভয়েরই প্রাণায়াম ক্রিয়ায় সিদ্ধি এসে গেলে সুষুম্মাদ্বার খুলে যায় এবং হু হু করে ওই শক্তি ঊর্ধ্বপথে সহস্রারের দিকে ধাবিত হতে শুরু করে – এই অবস্থাতেই সুষুম্মা-মধ্যস্থ চক্রগুলি একের পর এক খুলে যেতে থাকে এবং সাধক-সাধিকার উভয়েরই হ্লাদিনী শক্তির প্রকাশ ঘটে এবং মিলনরত অবস্থায় উভয়েরই রাধা-কৃষ্ণের দর্শন হয় !
চন্ডীদাসের পদে রয়েছে – ” দুই ধারা যখন একত্র থাকে । / তখন রসিক যুগল দেখে ।৷” এই অবস্থা প্রাপ্ত হলে সাধক সাধিকা এক অনির্বচনীয় আনন্দ সাগরে নিমগ্ন হয়ে যান । সহজ ভাবে সহজ প্রেমরসের আস্বাদন হয় এই ক্রিয়ায় – তাই এর নাম ‘সহজ-সাধন’। যেহেতু এই পথে ভোগের মধ্যে দিয়ে যোগের শিখরে পৌঁছানো যায় সেইজন্যই এই সাধনাকে সহজ-সাধন বলে বর্ণনা করা হয়েছে ৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এই পথের প্রবক্তা, তাই শ্রীকৃষ্ণই ‘সহজ মানুষ’ আর তার সাধন সঙ্গী ‘প্রেমময়ী রাধা’। এই পথ বা মার্গ অবলম্বন করে যেসব সাধক সিদ্ধ হন – তিনিই ‘সহজ অবস্থা’ প্রাপ্ত হন । স্থূল বৃন্দাবনের লীলা থেকে তাঁরা নিত্যবৃন্দাবনে স্থিত হ’ন । মধুর রসের এই সাধনাকেই বৈষ্ণবেরা ‘সহজ ভজন’ বলেন । … [ক্রমশঃ]