গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ অনেক সময় বাউলগান গাইতেন। নিজে নিজেই গাইতেন ! আবার কোনো কোনো সময় উপস্থিত তেমন কাউকে পেলে, তাকে বাউলগান গাইতে বলতেন। আমি ওনার শ্রীমুখ থেকে যে সমস্ত বাউলগান গুলো শুনেছিলাম সেগুলোর বেশিরভাগই দেহতত্ত্বের গান। প্রেম-রস সমৃদ্ধ বাউলগান ওনার শ্রীকন্ঠে শুনেছি বলে মনে পড়ে না। আমি একবার ন’কাকাকে (শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি) জিজ্ঞাসা করেছিলাম (বোকার মতো জিজ্ঞাসা, কারণ যিনি সর্বজ্ঞ তাঁর তো সবই জানা) – ” আচ্ছা ন’কাকা ! গুরুজী যে অতো অতো বাউলগান করেন – ওগুলো উনি শিখলেন কোথা থেকে ?” ন’কাকার তাৎক্ষণিক উত্তর – ” বাবা ! ও যে বাউলের আখড়ায় আখড়ায় অনেক ঘুরেছে ! আমাকেও একবার জয়দেবে নিয়ে গিয়েছিল, ২/৩ -রাত কাটাতেও হয়েছিল ওর সাথে একটা বাউলের আখড়ায় ।”
যাইহোক, আমরা প্রসঙ্গে ফিরে আসি ৷ গুরু মহারাজকে একটি মেয়ে শুনিয়েছিল – ” আমি প্রেম রসিকা হবো কেমনে,করি মানা কাম ছাড়েনা মদনে। ….. ” আশ্রম যাওয়া আসার শুরুর দিকে যখন গানটা শুনেছিলাম – তখন শুনতে ভালো লেগেছিল – কিন্তু গানের মর্মার্থ সেই সময় কিছুই বুঝতে পারিনি ! পরে যখন শ্রী শ্রী গুরুমহারাজের কৃপায়_ওনার বিভিন্ন আলোচনা শুনে যুগল-সাধনার তত্ত্ব, রস-রতি তত্ত্বের ব্যাপারে ধারণা হোল – তখন এইসব গানের অর্থ অনেকটাই বুঝেছিলাম ।
প্রকৃতপক্ষে দেখুন – সেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথাতেই আসতে হবে – ” মিছরির চ্যাঙড় তুমি যেভাবেই খাও – স্বাদ সেই একই ৷” গুরুমহারাজ এটাই বললেন – ” ‘যত মত তত পথ’- নয়, মত ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু পথ সেই একটাই “! আত্মা-পরমাত্মার মিলন, রাধাকৃষ্ণের যুগল-মিলন, নুনের পুতুল সাগরের জল মাপতে গিয়ে সাগরে মিশে যাওয়া – সব তত্ত্ব‌ই এক – একই পথে অগ্রসর হওয়া ! শুধু ভিন্ন ভিন্ন আচার, ভিন্ন ভিন্ন আচরণ, ভিন্ন ভিন্ন উপাচার, ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন !
আগের দিন যুগল সাধনার যে অবস্থার কথা বলা হয়েছিল – এটাই রসোল্লাস ! বৈষ্ণবশাস্ত্র বারবার সেই আনন্দের স্বাদ বোঝাতে_ “রমনানন্দের শতগুণ-সহস্রগুণ-কোটিগুণ”– এভাবে বর্ণনা করেছে । কোথাও কোথাও এমনও বলা হয়েছে যে, ওই সময় প্রতি লোমকূপের রমণের আনন্দ অনুভূত হয় ।
তাহলে, সঠিক ব্যাপারটা কি হয় – সেই ব্যাপারে একটু আলোকপাত করা যাক । গুরুমহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) বলেছিলেন, ” অতিরিক্ত আনন্দে, অতিরিক্ত ভয়ে, অতিরিক্ত দুঃখে বা শোকে মানুষের কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে যায় ।” যুগল-সাধনায় যখন সাধক ও সাধিকা উভয়ের শরীর _একশরীর হয়ে একটি complete circuit -এর ন্যায় কাজ করে এবং রস-রতির পুনঃপুনঃ আবর্তন হতে শুরু করে – তখন ওই দুই শরীরের মধ্যে রসোল্লাস হয় ! শরীরের সমস্ত বাহ্য-ইন্দ্রিয় অন্তঃ-ইন্দ্রিয় ক্রিয়াশীলতা হারায় ! প্রাণবায়ু নিয়ন্ত্রণে থাকায় মন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং শরীরের সমস্ত এন্ডোক্রিন গ্রন্থি গুলিও সাম্যাবস্থায় থাকে ৷ এই অবস্থায় সুষুম্মাদ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং শক্তির প্রবাহ হু-হু করে ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে ! শক্তির এই প্রবল ঊর্ধ্বগতির ফলে মেরুদন্ডের অভ্যন্তরে সুষুম্মা বরাবর অবস্থিত একটি একটি চক্রের প্রস্ফুটন ঘটতে থাকে এবং প্রস্ফুটিত অবস্থায় তার কার্যকারিতাও শুরু হয়ে যায় । ফলে ওই যুগল সাধক-সাধিকা শুধুমাত্র অদ্ভুত আনন্দ আস্বাদনই করে না – ওই অবস্থায় তাদের নানারকম দর্শন হতে শুরু করে । প্রতিটি চক্রের বীজ, তাদের অধিষ্ঠাত্রী দেব-দেবীর রূপ __চক্ষু বুজেই প্রত্যক্ষ হতে থাকে ! সাধক-সাধিকা এইসব দর্শন করে “একি – একি !” “এটা কি দেখছি !” “ওটা কি দেখছি !”–এইরূপ দর্শনানন্দে অধীর হয়ে – প্রথমটায় এরকমটা করতে থাকে !
ধীরে ধীরে এই সাধন করতে করতে সাধক-সাধিকার মধ্যে ওই উচ্ছ্বাসগুলিও কমে একেবারে শান্ত হয়ে যায় এবং তাদের উভয়ের এক এক করে ষটচক্রের ভেদ হোতে থাকে! ধীরে ধীরে উভয়েই সাধনার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তারা একসাথে সহস্রারে উপনীত হয় ৷ বৈষ্ণবীয় শাশ্ত্রে এটাকেই বলা হয়েছে রাসমঞ্চ ! যেখানে পৌঁছানোই একজন ভক্তের ultimate destination! এখানে পৌঁছে রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপের দর্শন হয় এবং এখানেই ভক্ত ভগবানের মিলন হয় । তখন আর ভক্ত ভগবানে ভেদ থাকে না। একমাত্র তখনই প্রতীয়মান হয় যে__ রাধাই কৃষ্ণ, আবার কৃষ্ণ‌ই রাধা! গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে এটাই যুগপৎ ভেদ ও অভেদতত্ত্বের বোধ!… [ক্রমশঃ]