গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ, বনগ্রাম আশ্রমে বৈদিক শ্লোক “আহার-নিদ্রা-মৈথুনঞ্চ-ভয়ম্”– সংক্রান্ত বিষয়ে নানান আলোচনা করেছিলেন । সেইগুলি সম্বন্ধেই এখানে আলোচনা চলছিল ৷ গুরুমহারাজের বলা কথার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর সম্বন্ধেও কিছু কথার উল্লেখ এখানে করা হচ্ছে ৷ আমরা এখন “ভয়” প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম ৷ গুরুমহারাজ কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন – উনি নাকি জীবনে তিনবার ‘ভয়’ পেয়েছিলেন ! ওনার পাওয়া প্রথম ‘ভয়’-এর ঘটনাটি আগের দিন আলোচনা করা হয়েছে – আজ তার বিশ্লেষণের কথায় আসি ! অবশ্যই বিশ্লেষণটা ওনার শ্রীমুখ থেকেই শোনা !
গুরুমহারাজ সেদিন বনগ্রাম আশ্রমে ওনার ছোটবেলায় (হয়তো ৫/৭ বছর বয়স) ঘটে যাওয়া গভীর রাত্রিতে স্টেশনের কাছে স্কন্ধকাটা কবন্ধকে মাত্র ৩/৪ হাত দূর দিয়ে চলে যেতে দেখার সময় যে অসম্ভব ‘ভয়’ পেয়েছিলেন! উনি বলেছিলেন যে ওই সময় দুটি বিপরীতমুখী শক্তি ওনার শরীরকে কেন্দ্র করে ক্রিয়াশীল ছিল ৷ একটা হল জৈবিক বৃত্তিজনিত বা মানবের সংস্কারে রয়ে যাওয়া ভয়ের প্রভাবে ঊর্ধ্ব থেকে নিম্নগামী একটা তুহিন শীতল স্রোত নেমে আসছিল এবং যা শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে স্থির করে দিচ্ছিল, অকেজো করে দিচ্ছিল, ভারী করে দিচ্ছিল । অপরপক্ষে সেই প্রচন্ড ভয়ে উনি দেখেছিলেন – ওনার কুলকুণ্ডলিনী শক্তি ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছিল এবং সেখান থেকে সৃষ্ট একটা উষ্ণ স্রোত শরীরের মাঝ বরাবর বা মেরুদন্ড বরাবর ঊর্ধ্বদিকে উঠে যাচ্ছিল ৷ এই উষ্ণ স্রোতটি – নিচের দিকে আসা শীতল স্রোতকে resist করে দিচ্ছিলো এবং শরীরকে পুনরায় উষ্ণ হোতে সাহায্য করেছিল। এর ফলে লক্ হয়ে যাওয়া ওনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও ক্রিয়াশীল হতে শুরু করেছিল _যার জন্য উনি দৌড়ে ঐ স্থান ত্যাগ করে যেতে পেরেছিলেন।
নিজের এই অভিজ্ঞতা থেকেই গুরুমহারাজ আমাদেরকে বলেছিলেন – ” শুধু যে সদ্গুরুর কৃপায় অথবা যোগ-সাধনায় কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হয় – তাই নয় – অতি আনন্দে, অতি দুঃখে বা অতি ভয়েও (অর্থাৎ যা কিছু হোক তা যদি ‘অতি’ হয়) কুলকুণ্ডলিনীর ক্রিয়া শুরু হয়ে যেতে পারে ৷
গুরুমহারাজের জীবনে প্রথম ‘ভয়’-এর ঘটনাটাও ঘটেছিল ওনার একেবারে শিশু বয়সে(আগে যে ভয় পাওয়ার ঘটনাটা উল্লেখ করা হোল_এখন যেটা বলা হবে সেটি আরো আগের অর্থাৎ শিশু বয়সের ঘটনা) ।
গুরুমহারাজ তখন খুবই শিশু – ঘটনাটি ঘটার মুহূর্তে সেখানে কেউ উপস্থিত ছিল না বলেই হয়তো – গুরুমহারাজ ঐরকম একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটাতে সমর্থ হয়েছিলেন ! ঘটনাটি বলছি ! গুরুমহারাজ যখন খুব ছোট – তখন ওনাদের বাড়িতে গাই গরু ছিল, ফলে প্রায় বারো মাসই বাড়িতে দুধ থাকতো । একদিন সন্ধ্যার দিকে মা এক কড়াই দুধ উনুনে চাপিয়ে দুধে জ্বাল দিচ্ছিলেন ৷ তখনকার দিনে কাঠের উনুনে রান্না হোত । কিছুক্ষণের মধ্যেই দুধ টগবগ করে ফুটতে শুরু করলো । এদিকে সারাদিন ধরে সংসারের অক্লান্ত কর্মের ক্লান্তিতে মায়ের দু’চোখে ঘুম নেমে এসেছে ! মা বসে বসেই ঢুলছিলেন – কিন্তু হঠাৎ করে ঢুলুনিটা একটু জোরে হতেই মা হুমড়ি খেয়ে ফুটন্ত দুধের কড়াই-এর উপর পড়ে গেলেন !
শিশু গুরুমহারাজ (তখন রবীন বা রবি) কে ঘিরে সেই সময় একটা অলৌকিক কান্ড ঘটে গিয়েছিল, অত ছোট হয়েও উনি একলাফে মায়ের মাথা ধরে মা-কে সঙ্গে সঙ্গে গরম দুধের কড়াই থেকে তুলে দিয়েছিলেন ! কিন্তু মায়ের গোটা বুকটা এবং গলার কিছু অংশ একেবারে ঝলসে যাওয়ার মতো হয়েছিল – এটা দেখেই শিশু রবীন (গুরুমহারাজ) খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন – তাঁর মনে হয়েছিল – ” মা কি মারা যাবে ?” “মা কি আর কখনো ঠিক হবে না ?”– ভীষণ এক “ভয়” ওই শিশুকে এমনভাবে পেয়ে বসলো যে, তাঁর শরীর শীতল থেকে শীতলতর হতে শুরু করেছিল !
সেই অল্প বয়সেই শিশু রবীন – তাঁর শরীরে কুলকুণ্ডলিনীর ক্রিয়া বুঝতে পেরেছিলেন ! এই ঘটনা তার মনে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল যে, উনি বেশ কিছুদিনের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ! তবে বলাই বাহুল্য__অল্প সময়ের মধ্যেই মা এবং সন্তান সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন ।
তৃতীয় ভয়ের ঘটনাও ঘটেছিল ওনার ছেলেবেলাতেই__ একা একা হিমালয় ভ্রমণের সময় ! একদিন উনি গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখের দিকে যাচ্ছিলেন! সেই সময় উনি একাই হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চল পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াতেন । মানুষজনের প্রচলিত চলা পথ ধরে উনি যাচ্ছিলেন না – সাধুরা যে সমস্ত শর্টকাট পথে চলাচল করে – উনি সেইরকমই একটা পথ ধরে উপরের দিকে উঠছিলেন । তখন সন্ধ্যা হয় – হয়, ওনাকে ওনার সেদিনের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে আরো খানিকটা পথ যেতেই হবে – তাই উনি খুব যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি হাঁটছিলেন ! কিন্তু একটা পথের মোড় ঘুরতেই ওনার সামনে পড়লো একটা বিশালাকার হিমালয়ান ভল্লুক ! গুরু মহারাজ উপরের দিকে উঠছেন আর ভালুকটিও উপর থেকে নিচের দিকে নামছে – পথ একটাই ! ডাইনে খাদ, বামে সুউচ্চ পাহাড়ের গা ! তাহলে উপায় ! গুরুমহারাজ জানতেন, ভালুকে জড়িয়ে ধরলে বুকের হাড় ভেঙে দেবে । তাছাড়া ভালুকের হাতের বড় বড় নখ একেবারে হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে নিতে পারে ! এইসব ভাবার আগেই তাঁকে ‘ভয়’ গ্রাস করে বসল ! তিনি ওই একইরকম ভাবে দেখলেন, তুহিন শীতল স্রোত যেন মৃত্যুর দূতের ন্যায় তাঁর সমস্ত শরীরকে অবশ করে দিচ্ছিল ! কিন্তু সেই মুহূর্তেই তাঁর কুলকুণ্ডলিনী শক্তির বিপরীতমুখী উষ্ণ স্রোত আবার তাঁর শরীর গরম করে দিল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি ও শরীরবৃত্তির ক্রিয়া শুরু হয়ে গেল !
ওনার হাতে একটা গাছের ডাল ছিল – উনি সেইটা তাড়াতাড়ি ভালুকটির দিকে ধরতেই ভালুকটাও সেই ডালটা ধরে ফেললো ! উনি একটু ঠেলা দিলেন – ভালুকটাও ঠেলা দিল ! এইরকম করতে করতে উনি ভালুকটির পাশ দিয়ে একদৌড়ে অনেকটা উঁচুতে উঠে গিয়ে দেখলেন__ ভালুকটা তখনো লাঠিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে ৷৷ … [ক্রমশঃ]