স্বামী বাউলানন্দজীর ভ্রমণকালীন সময়ের কথা এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। স্বামীজী অনেক সময় তার অতীতের ভ্রমণ এবং অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে ভক্তদের কাছে আলোচনা করতেন । এই দেশের বিশাল বিস্তৃতি এবং অনেক পবিত্র স্থান যথা হিমালয়ের উপরে বদরীনাথ, কেদারনাথ এবং দক্ষিনে কন্যাকুমারীর কথা বলতেন । এই সমস্ত কথা বলতে বলতে তিনি নিজেই স্থানগুলির মহিমা সম্বন্ধে বিস্ময় প্রকাশ করতেন ! ওই সমস্ত স্থানের কথা, বিভিন্ন মহাত্মারা যা ব্যক্ত করে গিয়েছেন বা তাঁরা ঐসব স্থানে যে সমস্ত সাধনা করেছেন_ তার vibration ঐসব স্থানে আজও প্রবাহিত হচ্ছে! তাঁদের পথে যে সমস্ত সাধক এখনো পরিভ্রমণ করে, তাদেরকে তাঁরা অনুপ্রাণিত এবং প্রভাবিত করে থাকেন। সাধকগণ ঐ সমস্ত মহাত্মাদের ভাবনা ও অনুভূতি মনের মধ্যে গ্রহণ করে আধ্যাত্মিক ঊর্ধ্বগতি লাভ করেন।
অন্নদান মহাযজ্ঞ! এই মত স্বামীজি সবসময় পোষণ করতেন! নিঃস্বার্থভাবে এই যজ্ঞ কোরলে অদ্ভুত ফল পাওয়া যায় । এটি কর্তা এবং ভোক্তা উভয়ক্ষেত্রেই বর্তায় । কোন ব্যক্তিকে অন্নদান করা হোলে, যখন সে পেট ভরে খায় _তখন সে পরিতৃপ্ত হয় ! আর এক গ্রাস খাবার‌ও সে খেতে পারেনা ! অতএব আহারে পরিতৃপ্তি আসে! অন্য কোন জিনিস, যেমন টাকা-পয়সা ইত্যাদি দান করলে এরকম পরিতৃপ্তি আসে না । কেনো না প্রাপ্তকর্তা আরো আশা করতে পারে ! তাছাড়া ভোক্তা যে খাবার খায় তা পরিপাক হয়ে সারাংশ রক্তে মিশে যায় । এই রক্ত সারা শরীরে সঞ্চালিত হয়ে সমস্ত স্নায়ুকে সক্রিয় করে তোলে । যে খাবার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে দান করা হয় তা ভোক্তার মধ্যে যথার্থ ভালোবাসার ভাবনা ও শক্তি সঞ্চারিত করে । এই ভালবাসার ভাবনা এবং শক্তি ওই ভোক্তার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
স্বামীজীর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে একজন ভক্ত (এই ভক্ত প্রতিদিন মঠ দর্শন করতে আসতেন) মঠের তত্ত্বাবধানে ব্যাপক অন্নদান যজ্ঞ করতে চাইলেন এবং স্বামীজীকে এই কর্মের নির্দেশ দিতে বললেন । এই ভক্ত ছিলেন পশ্চিম গোদাবরী জেলার বাসিন্দা । তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু আনার শপথ করলেন । স্বামীজি দু এক সপ্তাহ পরে ভদ্রাচলমে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন । সেজন্য তিনি মত প্রকাশ করলেন যে, মহাযজ্ঞ যেন খুব তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠিত হয়। দিন‌ও ঠিক করে ফেললেন। ভক্তটি সমস্ত রকম ব্যবস্থা করেছিলেন। মঠের পাশে মিউনিসিপাল স্কুল ছিল _সেই স্কুল প্রাঙ্গনে যাতে লোক খাওয়ানো যায় _সেজন্য স্বামীজি মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষের অনুমতি চেয়ে নিলেন । রান্নার জন্য বিরাট আয়োজন হোল। স্বামীজি পরিবেশনের জন্য বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করলেন । দলে দলে লোক এসে লম্বা লম্বা সারিতে বসে পড়লো। স্বামীজি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন । তাল পাতার তৈরি ঝুড়ি করে ভাত পরিবেশন করা হচ্ছিলো। বাস্তবিক এ ছিল একটা সুন্দর দৃশ্য! কিছু স্বেচ্ছাসেবক সারির মধ্যে দিয়ে এসে পাতায় ভাত দিয়ে যাচ্ছে, কিছু স্বেচ্ছাসেবক তাদের পিছু পিছু ডাল ভর্তি বালতি নিয়ে ঘুরছে, কয়েকজন পানীয় জল ভর্তি বালতি নিয়ে ঘুরছে, অন্যান্যরা একের পর এক তরকারি পরিবেশন করছিল। স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রবল বেগে কাজ করে চলছিল। স্বামীজী ছিলেন সেই কর্মের কেন্দ্রবিন্দু।
পরিবেশন চলছিল_ এমন সময় একজন স্বেচ্ছাসেবক এসে স্বামীজীকে জানালো যে, এক স্বেচ্ছাসেবক বালতি ভর্তি ভাত নিয়ে মাঠের বাইরে অন্য একটি লোকের মাধ্যমে চালান দিচ্ছে ! স্বামীজি সেখানে গিয়ে দেখলেন লোকটি ইতিমধ্যে তার ঝুড়ি ভাত সরিয়ে ফেলেছে ! কেনো এমন হচ্ছে ভেবে স্বামীজি অবাক হোলেন ! এই ভোজ পর্ব সকলের জন্য খোলা ! লোকজন এসে অবাধে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে ! তবে কেন এই চুরি? তাহলে কি এটা রাতের জন্য বা পরের দিনের খাবার জন্য রাখছিল? উদ্দেশ্য যাই হোক, যেভাবে লোকটি ভাত চালান দিচ্ছে তা অন্যায় ! স্বামীজী তাকে পাশে ডেকে তিরস্কার করলেন এবং পরিবেশক দল থেকে তাকে তাড়িয়ে দিলেন। লোকটি মাঠের ধারে বাস কোরতো । চুরি করা ভাত তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। তাকে দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়ায় সে স্বামীজীর উপর খুব রেগে গেল এবং স্বামীজীকে গালি দিতে লাগলো । তাকে জোর করে ধরে মাঠের বাইরে বের করে না দেওয়া পর্যন্ত সে গালি দিতেই থাকলো। এই একটি অঘটন ছাড়া উৎসবটি নির্বিঘ্নে উদযাপিত হলো। কর্তা এবং ভোক্তা উভয়েই পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত হোল।(ক্রমশঃ)
=============®===========
*স্বামী বাউলানন্দজীর আধ্যাত্মিক আলোচনা*
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একবার স্বামীজি ‘গুরু’ সম্বন্ধীয় কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন – ” তুমি যা বলছ তার কোনো অর্থই হয় না । যখন খুশি গুরু গ্রহণ করছো আবার যখন খুশি গুরু ত্যাগ করছো ৷ গুরু এরকম কোন জিনিস নয় । গায়ের জামা পরিবর্তন করার মতো গুরু পরিবর্তন করা যায় না । একবার কোন ব্যক্তিকে গুরুরূপে গ্রহণ করলে গুরু শিষ্যের সম্পর্ক স্থায়ী হয়ে যায় । এমনকি গুরু ও শিষ্য উভয়ের শরীর পাতের পরও ঐ সম্পর্ক থাকে । গুরু-শিষ্য সম্পর্ক দেহগত নয় – আত্মিক সম্পর্ক। ইচ্ছামত এই সম্পর্কের ছেদ ঘটানো যায় না। যদি তুমি প্রকৃতই তাকে তােমার গুরুরূপে গ্রহণ করে থাক তাহলে তুমি এই সংযাগ থেকে সরে যেতে পার না। যদি তুমি বল যে তাঁকে আর তুমি গুরু বলে মানতে চাও না, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় তুমি তাকে পূর্বে গুরু বলে মেনে নাও নি ।
যদি তোমার গুরুর চরিত্র দোষযুক্ত হয় সেটা তাঁর মাথা ব্যথা, তােমার নয় । তাঁর স্বভাব সম্বন্ধে তােমার উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই। তাঁর মধ্যে ভালটা নেওয়া এবং তাঁর আলােচনা শ্রবণ করাই হবে তােমার বিষয়।
গুরু নিন্দা মহাপাপ। ভক্তি পরায়ণ ব্যক্তিরা কখনই গুরু নিন্দা করে না, গুরু নিন্দা সহ্য করতেও পারে না। তুমি তােমার বাবা-মার নিন্দা করতে পার ? ঠিক তেমনি তুমি গুরু নিন্দা করতে পার না। কারও মনােরঞ্জনের জন্য বা কোন অসুবিধা এড়াবার জন্য যদি তুমি তােমার গুরুর নিন্দা কর তাহলে তুমি নিজেরই নিন্দা করবে। তোমার জীবনের প্রগতিতে আঘাত হানবে। তুমি অন্তর্ঘাতী হবে।”
জিজ্ঞাসা : — “স্বামীজী, শিক্ষা জীবনে আমরা অনেক গুরুর সংস্পর্শে আসি । যিনি আমাদের বর্ণ পরিচয় শেখান তিনি আমাদের প্রথম গুরু। পরে প্রতি বৎসরই আমরা নতুন নতুন গুরু করি । এঁদের আমরা গুরুর মত ভালবাসি । তাছাড়া, উপনয়নের সময় যিনি আমাদেরকে গায়ত্রী মন্ত্র দেন তিনিও গুরু হন | কিছুক্ষণের ঘটনা বলে এসবকে আমরা গুরুত্ব দিই না। লােকে অনেকের নিকট হতে উপদেশ নিয়ে থাকে এবং মন্ত্রও নেয় অনেকের কাছে। যে সমস্ত স্বামীজী গৃহস্থ বাড়ীতে বেড়াতে আসেন তাঁরাও উপদেশ দিয়ে যান—এই সকলের মধ্যে কাকে আমরা গুরু বলে মেনে নেব ? সকলকেই কি মেনে নেব ?”
স্বামীজী ব্যাখ্যা করতে লাগলেনঃ – “গুরু” একটা শব্দ নয়। এটাকে হালকাভাবে নিও না। গুরু এবং শিক্ষকের মধ্যে অনেক পার্থক্য। শিক্ষকগণ ছাত্রদের পাঠ শেখান। শােনা, বােঝা এবং পাঠ তৈরীর ব্যাপারটা ছাত্রদের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। ছাত্র ঐ পাঠ শুনতেও পারে আবার নাও পারে। পাঠ শিক্ষা বন্ধ করতে পারে। এতে তাদের স্বাধীনতা আছে। যদি তারা পাঠ বুঝে নেয় এবং ভাল করে পড়াশােনা করে তাহলে জীবনে উন্নতি করতে পারবে। যথাসাধ্য পাঠ বলে দিয়েই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ। ছাত্রের উন্নতির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। এই হল ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক । বর্ণপরিচয় থেকে আরম্ভ করে উচ্চস্তরে শিক্ষালাভ যাদের কাছে করছ তারা সকলেই হলেন শিক্ষক।
গুরু ও শিষ্যের মধ্যে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। এ সম্পর্ক আধ্যাত্মিক এবং তা অবিছিন্ন । জীবসত্তা যতদিন থাকবে ততদিন এই সম্পর্ক থাকবে—জীবসত্তা শরীরে থাক বানা থাক । জীব সত্তার মােক্ষ প্রাপ্তি হলেই এই সম্পর্কের অবসান হয় । … [ক্রমশঃ]