স্বামী বাউলানন্দজীর ভ্রমণকালীন সময়ের ঘটনাসমূহ এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। ডুম্মাগুডেম গ্রামে গণেশ পুজোর ভাসান উপলক্ষে যে শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল, সেই সময় উপস্থিত ভক্তদের সাথে নৃত্য করতে করতে স্বামীজ ভাবস্থ হয়ে পড়েছিলেন, এবং সেই অবস্থা দেখে পুরুষোত্তম পন্ডিত সকলকে হেঁকে-ডেকে সেখানে জড়ো করেছিলেন ‌। এরপর থেকে আজকের ঘটনা শুরু ।
পন্ডিতজীর চিৎকারে সকলে ছোটাছুটি আরম্ভ করে দিলো। তারা বাড়ি থেকে বালতি ভর্তি দুধ নিয়ে এসে স্বামীজীর মাথায় ঢালতে লাগলো, নারকেল ভেঙে তার জল স্বামীজীর মাথায় ঢেলে দিলো, আগরবাতি আর কর্পূর জ্বেলে দিলো। জ্বলন্ত কর্পূরের আলোয় স্বামীজীর মুখ উদ্ভাসিত হতে লাগলো। সকলে মিলে চন্দন ঘষে ঘষে স্বামীজীর গায়ে মাখিয়ে দিতে লাগলো। এই সমস্ত কাজ চলাকালীন স্বামীজীর শরীরের মধ্যে কোনো নড়ন-চড়ন দেখা গেলোনা। শোভাযাত্রা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হোল , কারণ সূর্যাস্তের পূর্বে নদীতে মূর্তি বিসর্জন করতে হবে !
উপস্থিত লোকেরা পুনরায় জমায়েত হয়ে স্বামীজীকে নড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু পারলো না ! শ্রীনিবাস আচার্য এবং পুরুষোত্তম পন্ডিত যথাসাধ্য চেষ্টা করেও তাঁকে নড়াতে পারলেন না। তারা স্বামীজীকে ছাড়াই শোভাযাত্রা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। পুরুষোত্তম পন্ডিত তখন এক বিরাট সুযোগ পেয়ে গেলেন । তিনি স্বামীজীর মুখোমুখি বসে অনেক স্তোত্র পাঠ করতে লাগলেন। স্বামীজীর শরীরে তিনি এরপরই চৈতন্য-ভাব লক্ষ্য করতে লাগলেন ! তিনি ভাবলেন তাঁর সামনে স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভু বসে আছেন এবং সেই ভাবনায় তিনি তার সামনে নেচে নেচে গান করতে লাগলেন!
অনেকক্ষণ ধরে এরকমটা চললো। পন্ডিতজী ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না । কয়েকটা মন্ত্র তিনি স্বামীজীর কানে বারবার বলতে লাগলেন।মন্ত্রের প্রভাবে স্বামীজী ক্রমশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন। কিন্তু তাঁর শরীর এত দুর্বল বোধ হচ্ছিল যে, তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না বা চলতেও পারছিলেন না। পন্ডিতজী এবং আচার্যজী তাঁর দুই হাত তাদের কাঁধে নিলেন এবং স্বামীজীর কোমর ধরে তারা মন্দিরের দিকে তাকে নিয়ে চলে গেলেন । পন্ডিতজী বুঝতে পারলেন _স্বামীজীর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ ! তিনি জানতেন স্বামীজীকে কি ধরনের চিকিৎসা করা দরকার ।।কে-জনার্দন নামে একজন যুবক একপাত্র মাখন নিয়ে এসে স্বামীজীর সারা অঙ্গে ডলতে লাগলো। তারপর তাঁকে গরম জলে স্নান করানো হোলো । পরে স্বামীজীকে দুধ এবং ফল খেতে দেওয়া হোলো। কয়েকদিনের মধ্যেই স্বামীজী সুস্থও হয়ে উঠলেন। … [ক্রমশঃ]
*স্বামী বাউলানন্দজীর আধ্যাত্মিক আলোচনা*
________________________________________
একবার আশ্রমে উপস্থিত ভক্তদের আলোচনা-প্রসঙ্গ শুনে তিনি বলতে শুরু করলেন :
“সর্বেসর্বা বিশ্বব্যাপী। যে সর্বেসর্বা সমস্ত মন্দিরে রয়েছেন সেই সর্বেসর্বা এই মন্দিরেও রয়েছেন। সর্বেসর্বার নাম কি ? তাঁতে বিভিন্ন নাম প্রয়ােগ করা যায়। যে নামেই তাঁর উপাসনা করো বা যে ভাবেই প্রার্থনা করো—তা তাঁর কাছেই পৌঁছাবে। কারণ তিনি সর্বত্র বিরাজমান। শিব, কেশব, রাম, কৃষ্ণ, ভবানী, লক্ষ্মী, পার্বতী, কালী—আমাদের পছন্দমত যে কোনো মূর্তির মধ্যেই তিনি রয়েছেন। সুতরাং তিনি আমাদের প্রার্থনা গ্রহণ করছেন। এই বিষয় জেনে গেলে বা এই বিষয়ে আমাদের ধারণা হলে যে কোন মূর্তিই আমরা উপাসনা করি না কেনো_ তাতে কিছু আসে যায় না। অতএব উপসনার সময় আমরা কোন্ মূর্তি চিন্তা করছি তা নিয়ে মাথা ঘামানাের কোনো প্রয়ােজন নেই।
জিজ্ঞাসা :– “তাহলে আমরা ঈশ্বরের এত মূর্তি গড়ি কেনো? আমাদের উপাসনা বিভিন্ন ধরণের কেন? উদাহরণস্বরূপ—এই মন্দিরে কথা বলা উচিত নয়, এখানে আমাদের এইসব সঙ্কল্প করা উচিত নয়। এখানে অর্থ দেওয়া উচিত—এ সব কেনো?”
স্বামীজী বললেন :– সম্ভবত রামকৃষ্ণের ইচ্ছায় এই আলােচনা হচ্ছে। সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যাক্। সকলে আমরা ঈশ্বরের পূজা তথা উপাসনা করেছি। এ কথার অর্থ কি ? আমরা ঈশ্বরের মূর্তির পূজা করি। সুতরাং আমাদের মতে মূর্তিটাই ঈশ্বরের প্রতীক। অনেকে প্রস্তর মূর্তির পরিবর্তে গাছকে ঈশ্বরের প্রতীক ভেবে পূজা করে। কেউ বা কোনো জীবন্ত মানুষকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি ভাবে। পাথর, গাছ বা মানুষ—এদের মধ্যে যে কেউ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি হােক না কেনো–ঈশ্বরের কৃপা এদের মধ্য দিয়েই আমরা পেয়ে থাকি। কোনো বিশেষ নামে যদি আমরা ঈশ্বরকে ডাকি তখন একটা বিশেষ মূর্তি আমরা ধারণা করি । ‘ঈশ্বর’ কথাটাই কোনো কিছুর নাম।
ঐ কোনো কিছুটা কি ?
ভালবাসা, জ্ঞান, শক্তি, চৈতন্য, সচেতনতা, সময় এবং স্থান— এই সাতটি জিনিসের সমষ্টির নাম ঈশ্বর। প্রত্যেক নামের একটা রূপ আছে। ঈশ্বর এই কথাটারও একটা রূপ আছে। ব্যক্তির চিন্তার উপর নির্ভর করে এই (ঈশ্বরের) মূর্তির রূপ।
আমরা অনেক মনুষ্যশরীর দেখি I প্রত্যেকটি মনুষ্য‌ই সেই ‘সত্তা’-র রূপ। একইভাবে একটা বস্তুও সতর্কতার কোনো না কোনো নামের মূর্তি হতে পারে!
সুতরাং কেমন করে তুমি বলবে যে, ঈশ্বরের কোন রূপ নেই ! যদি ঈশ্বরের কোন রূপ নেই বলে তর্ক করা হয় _তাহলে বলতে হয় মানুষেরও কোন আকার বা রূপ নেই। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা একমত যে মানুষের রূপ আছে । সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে ঈশ্বরেরও রূপ আছে। … [ক্রমশঃ]