শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের বলা ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রাদিতে উল্লিখিত বিভিন্ন কাহিনী, বিভিন্ন চরিত্র ইত্যাদির কথা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো । গুরুমহারাজ যখন যে কথাই বলতেন – সেই কথাই আমাদের কাছে অনন্যসাধারণ বলে মনে হোতো ! ওনার কাছে সিটিং শুনে, আমরা যখন সেই কথাগুলি অন্যদের কাছে পরিবেশন করতাম – তখন তারাও সেই কথাগুলো শুনে ‘হাঁ’ হয়ে যেতো ! তারা বোলতো – “এমন কথা তো কখনও শুনিনি !” সেইজন্য গুরুমহারাজের কথা শুনলেই – যে কোনো মানুষ বুঝতে পারে যে, “এটা গুরুমহারাজের কথা” ! তেমনভাবে যদি কথাগুলি মনকে স্পর্শ না করে – তাহলে জানতে পারা যায় যে, কথাগুলি আর যারই হোক – গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা নয় !
“পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা”– লেখা শুরু হয়েছিল – সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে আমার বনগ্রাম সংক্রান্ত যে সমস্ত স্মৃতি রয়েছে – সেইগুলি সবার সাথে শেয়ার করার জন্য । ভালো ভালো জিনিস একা একা ভোগ না করে যেমন সবাই মিলে ভাগ করে নিলে আরও বেশি আনন্দ হয় – গুরুমহারাজের কথাগুলিও ঠিক তেমনি ! সবার সাথে ভাগ করলে যেন আরও বেশি আনন্দ হয়, শান্তি হয় ! যাইহোক, এইটা করতে গিয়ে পুরোনো বনগ্রামের ইতিহাস, আমাদের বিভিন্ন শাখা আশ্রমের ইতিহাস, পুরোনো অনেক ভক্তদের কথা, বিভিন্ন ব্রহ্মচারী মহারাজের কথাও বলা হয়েছে ! আরো অনেকের কথা পরে বলার ইচ্ছাও রয়েছে – কিছু কিছু note করাও রয়েছে – কিন্তু যেহেতু গুরুমহারাজ আর শরীরে নাই – তাই এখন পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে গেছে ! এখন তো আর gurdian নাই, তাই সবাই বড় হয়ে গেছে ! মানুষ মাত্রই দোষে-গুণে ভরা ! সবাই তার নিজের সম্বন্ধে বা তার নিকটজন সম্বন্ধে ভালো ভালো কথাই শুনতে চায় – একটুও কোনরকম মন্দ কথা শুনতে চায় না, কেউ বলে ফেললে সহ্য করতে পারে না !
এইজন্যেই ব্যক্তিগত কারো সম্বন্ধে লেখা বন্ধ করে গুরুমহারাজ বিভিন্ন সময়ে কোনো না কোনো প্রসঙ্গ ধরে ধরে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যে সব কথা বলেছিলেন – সেইগুলো একজায়গা করে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে ! এই কাজটি করতে গিয়ে বিভিন্ন reference দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়, অন্যান্য স্থানে সেই ব্যাপারে গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছিলেন সেগুলিও ঢোকানো যায় ৷ আর নিজের কথা –? নিজের কথা বলার আছেই বা কি ? সবই যখন গুরুমহারাজের – সবই তো ভগবানের বা ঈশ্বরের – তাহলে নিজের আর রইলটা কি ? সেই কথাটাই সদাসর্বদা স্মরণ করে এই লেখা ৷
আমরা আলোচনা করছিলাম গুরুমহারাজের বলা বিভিন্ন পৌরাণিক, মহাকাব্যিক, ঔপনিষদিক কাহিনীগুলি নিয়ে এবং ঐসব শাস্ত্রে উল্লিখিত বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে ৷ আমরা আগে একদিন জনকের রাজসভায়, তৎকালীন ভারতবর্ষের (পৃথিবীর) শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের সামনে যাজ্ঞবল্ক্য ও গার্গীর জিজ্ঞাসা-উত্তরের সেই অসাধারণ উপস্থাপনার উল্লেখ করেছিলাম । ওই ঘটনায় আমরা দেখেছি – আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতবর্ষে নারীরাও সুশিক্ষিত ছিল, তারাও প্রকাশ্য রাজসভায় শত শত পণ্ডিতদের সমকক্ষ হয়ে তাদের সাথে সমানে সমানে তর্ক-বিতর্কের ক্ষমতা বা যোগ্যতা রাখতো ! গুরুমহারাজের কাছে আমরা আরো অনেক এই ধরনের বিদুষী নারীর নাম শুনেছিলাম – যাদের নাম বেদ-উপনিষদে বা অন্যান্য প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রাদিতে উল্লেখ রয়েছে । যেমন – ঘোষা, লোপামুদ্রা, অপালা, বারবারা, বাক, মৈত্রেয়ী, অনুসূয়া, বিশ্ববারা, আত্রেয়ী, ঘোষা প্রমুখ আরো অনেকের নাম । এদের মধ্যে ঋষি অত্রির স্ত্রী অনুসূয়ার কথা বলেছিলেন গুরুজী, যাঁর কাছে রামচন্দ্র বনবাসকালে সীতাকে আলাদা করে পাঠিয়েছিলেন স্ত্রী-ধর্ম পালনের শিক্ষা করতে ! রামায়নে বর্ণিত রয়েছে সেই মূল্যবান উপদেশ যা মা অনুসূয়া সীতাদেবীকে দিয়েছিলেন । মধ্যপ্রদেশের চিত্রকূটে সতী অনুসূয়ার সুন্দর মন্দির রয়েছে – সেখানে পা দিলেই শরীর-মন-প্রাণ পবিত্র হয়ে ওঠে ! সারদা মায়ের প্রণাম মন্ত্রে যেমন রয়েছে “পবিত্রতা স্বরূপিণে”– ওখানে গেলে সেই একই বোধ অনুভূত হয় ।
গুরুমহারাজ আরো বলেছিলেন ঋষি অম্ভৃণের কন্যা বাক্-এর কথা ! ব্রহ্মবাদিনী এই নারী ব্রহ্মসাক্ষাৎকার বা আত্মসাক্ষাৎকার করেছিলেন । তিনি ঋকবেদের দশম মন্ডলের দেবীসূক্তের প্রবক্তা ! শ্রী শ্রী চন্ডীতে দেবীর যে মহিমা বর্ণিত হয়েছে – তা সম্ভবত ওই ব্রহ্মবাদিনী বাক্-এর কাছ থেকেই নেওয়া ৷ ওনার শিক্ষা, পাণ্ডিত্য ও অন্যান্য গুণের অসাধারনত্ব থেকেই দেবী সরস্বতীর মূর্তি কল্পনা করা হয়েছিল বলে পণ্ডিতদের একাংশের অভিমত ৷৷ [ক্রমশঃ]