জিজ্ঞাসু : ~ আপনি যখন কথা বলেন তখন তো সাধারণ কথ্য ভাষাই ব্যবহার করেন – ফলে বেশ ভালোই বোঝা যায় ! কিন্তু আপনার লেখা বইগুলির ভাষা বেশ কঠিন , বিশেষত “বাউলের মর্মকথা” আমি দু’বার পড়েছি কিন্তু খুব ভালো বুঝতে পারিনি ! এমনটা হবার কারণ কি?
গুরু মহারাজ : ~ ঠিকই বলেছো যে, আমার কথ্য ভাষা বা Language __ Poor ! কারণ আমি তো আর তোমাদের মতো কলেজ ইউনিভার্সিটিত লেখাপড়া শিখিনি ! সাধারণতঃ আমি কথা বলার সময় ‘যখন যেখানে থাকি, সেখানকার সাধারণ কথ্য ভাষা’-ই ব্যবহার করি ৷ এটা সত্যি বলছি_আমি দেখেছি যখন আমি যে অঞ্চলে যাই বা ঘুরি তখন আমার কথায় সেই অঞ্চলের কথ্য ভাষার টান এসে যায় ! এখানে আমার কথ্য ভাষা শুনে সব্য-রা(সিঙ্গুরের একজন ভক্ত) বলে এটা নাকি আমার Modesty – কিন্তু তা নয় ! আসলে সব্য আমার সাথে অনেক জায়গায় ঘুরেছে , বিভিন্ন স্থানে আমার বিভিন্ন ভাষায় ‘কথা বলা’ দেখেছে – তাই এরূপ ওর ধারণা ! পৃথিবী গ্রহের যে কোনো প্রান্তের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না – আমি যেখানে যখন থাকি, তখন সেখানকার কথা বলার ধরন আপনা-আপনি আমার আয়ত্ত হয়ে যায় !
আর তুমি কি বলছিলে “বাউলের মর্মকথা”-র ভাষার কথা ? দ্যাখো , কথাতেই আছে কথ্য ভাষা আর লেখ্য ভাষা ৷ যে ভাষায় মানুষ কথা বলে , যেরকম Accent প্রয়োগ করে __ঠিক ঠিক সেরকম ভাষায় কখনও কোনোকিছু লেখা যায় না ৷ কথা সাহিত্যিকেরা অনেকটা চেষ্টা করেছে লেখ্য ভাষাকে সহজ সরল করার জন্য – কিন্তু 100% হয় না ৷ যাই হোক, “বাউলের মর্মকথা”-র কথায় আসছি । “বাউলের মর্মকথা”-র ‘ভাষা’ সহজ, কিন্তু ‘ভাব’ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারে নতুন ! তাই একবার বা দুবার পড়লেও বিষয়বস্তু ‘কঠিন’ মনে হয় । “বাউলের মর্মকথা” তো সাধারণের জন্য নয় এটি আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের জন্য ! তুমি কি এই বইটিকে ‘প্রেমের উপন্যাস’ মনে করেছো নাকি __যে একবার পড়েই তার সারমর্ম হৃদয়ঙ্গম করে বইটিকে পাশে সরিয়ে রাখবে ! সাধারণ গল্প-উপন্যাসে মানুষের নিত্য জীবনের হাসি-কান্না , সুখ-দুঃখ , প্রেম বিরহের ঘটনা লিপিবদ্ধ থাকে _ যার সাথে পাঠকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মিল রয়েছে ! মানুষের মনোজগতে এসব সম্বন্ধে জন্ম-জন্মান্তরের অভিজ্ঞতা রয়েছে – তাই উপন্যাস, গল্প ইত্যাদি একবার পড়লেই ধারনা হয়ে যায় ! অনেক ক্ষেত্রে আর একবার পড়ারও প্রয়োজন হয় না । কিন্তু “বাউলের মর্মকথা”-র বিষয়ের ভাব বা অন্তর্নিহিত তত্ত্ব সাধারণের কাছে অজানা ! কারণ সাধন জীবনের এই স্তরে এখনও তো তোমরা পৌঁছাওনি ! এগুলি সম্বন্ধে পূর্ব পূর্ব জীবনেরও কোনো অভিজ্ঞতাও তোমাদের নাই ! সুতরাং তোমার মতো যে কোনো সাধারণ পাঠকের কাছে এগুলি তো প্রথমে বোধগম্য হবেই না ! কত মানুষের এই ধরনের বই পড়তে পড়তে ঘুম চলে আসে ! অর্থাৎ ব্রেন নিতে পারে না ! আমার এখানেই দেখেছি _ Sitting-এ বসে সাধারণ বিষয় নিয়ে যতক্ষণ আলোচনা চলছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিক ছিল _ কিন্তু যেই অধ্যাত্ম-বিষয়ক আলোচনা শুরু হোলো –অমনি দেখি অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে ! তাঁর মানে বুঝতে পারছো তো _ ব্রেনসেলগুলো কাজ করছে না !
মানুষের চেতনায় আধ্যাত্মিক জগতের টেস্ট থাকলে, তবেই আধ্যাত্মিক শাস্ত্র ভালো লাগে বা সেই গ্রন্থগুলি ভালোভাবে বোঝা যায় ৷ আর তখন ঐসব ব্যক্তির এই ধরনের শাস্ত্র পাঠের প্রেরণা জন্মায়, পড়তে ভালো লাগে । সমাজে সব রকমের রুচির মানুষ রয়েছে, তাই সব ধরনের গ্রন্থও রয়েছে ৷ দেখবে কমবয়সী কিছু ছেলে-মেয়ে লুকিয়ে মেলায় গিয়ে সস্তায় রগরগে আদিরসাত্মক চটি বই কিনছে ! ঐ মেলাতেই এমন সহস্র ব্যক্তিরা রয়েছে যারা ঐদিকে তাকিয়েও দেখছে না ! বইমেলাগুলিতে গেলে এইসব খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় ! সেখানে দেখা যায় _কেউ গবেষণামূলক বই ভালোবাসে – তাই সে বিভিন্ন স্টলে ঘুরে ঘুরে ঐ ধরণের বই খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে ! কেউ উপন্যাস, কেউ কেউ আবার ধর্মমূলক বই- অধ্যাত্মবিষয়ক গ্রন্থ – মহাপুরুষের জীবনী বা বাণী পড়তে ভালোবাসে _ তারা সেইসব বই খুঁজে বেড়াচ্ছে !
সহস্র সহস্র মানুষ তাদের সহস্র সহস্র ধরনের রুচি ! এই রুচি তৈরি হয় তার চেতনার লেভেল অনুযায়ী । কোনো ব্যক্তি চেতনায় কতটা উন্নত – সেই দিয়েই বিচার হয় তার ‘লেভেল’ ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এইজন্যই বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন, যারা দরকচা মারা পন্ডিত – তারা অনেকটা উঁচুতে ওঠে শকুনের মতো, কিন্তু নজর থাকে ভাগাড়ের দিকে, নিচের দিকে ! সুতরাং ধনে-মানে, শিক্ষায় উন্নতরাও প্রকৃত পক্ষে উন্নত নয়, একমাত্র আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত বা চেতনায় উন্নত মানুষরাই প্রকৃত উন্নত । এইসব ব্যক্তিদের দ্বারা সমাজে কোনোদিন কোনো ক্ষতি তো হবেই না বরং এরা যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন এঁরা সাধ্যমত সমাজের মঙ্গল সাধন করে যাবেন ।
তাহলে বুঝলে তো –কি বলতে চাইলাম! চেতনার উন্নতি-ই প্রথম লক্ষ্য হোক মানুষের ! এটাই মানবজীবনে প্রাথমিকভাবে ‘মুক্তি’ । সাধারণভাবে ‘মুক্তি’ বলতে যা বোঝায় সেটা হোল মানুষের মনোজগতের ‘লেভেলের পরিবর্তন’ । মনোজগতের এক লেভেল থেকে অন্য লেভেলে উন্নীত হওয়া ৷
যে কোনো সাধক , তা সে যে মত(ইসলামীয় মত, খ্রীষ্টীয় মত,জৈন মত, বৌদ্ধ মত ইত্যাদি) বা পথেরই হোক না কেন, সাধন-ভজন শুরুর পাঁচ বছর – সাত বছর পরেও যদি দেখা যায় সে একই মানসিকতায় রয়েছে বা একই চেতনার লেভেলে রয়েছে, তা হলে জানতে হবে তার সাধন-ভজন বা ক্রিয়া পদ্ধতিতে কোনো ছিদ্র রয়েছে ! যে ছিদ্র দিয়ে তার সব সাধন-জনিত সংগ্রহ বেরিয়ে যাচ্ছে ৷ কিন্তু কোনো অধ্যাত্মপথের ব্যক্তির জীবনে যদি দেখা যায় ধীরে ধীরে কর্মের, রুচির, মানসিকতার পরিবর্তন হোতে শুরু করেছে __ তাহলেই জানবে ঐ ব্যক্তির সাধন পদ্ধতি সঠিক ! তার আধ্যাত্মিক উন্নতি হচ্ছে , তার চেতনার লেভেলের উন্নতি ঘটছে !
তবে, এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত মুমুক্ষুত্ব ও মহাপুরুষ সংসর্গ । এর জন্য সাধককে প্রথমেই ‘নিষ্কপট’ হোতে হবে ৷ মনে নানান রকম প্যাঁচ রয়েছে, আর তুমি সাধন-ভজন করছো, এতে কি ফল পাবে ? পিঠে শোলার বোঝা বেঁধে জলে ডোবা যায় ? মুমুক্ষু হোতে হবে – অর্থাৎ আমি অন্য কিছু চাই না, অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই _এই এক লক্ষ্য। তোমরা এখানে যারা বসে আছো – তাদের মধ্যে কজন নিষ্কপট বলো ? কজন মুমুক্ষু ?
তোমরা অনেকেই অভিযোগ করো – “কই বাবা ! ধ্যান জপ তো করছি, উন্নতি হচ্ছে কই ?”__ সত্যিই কি তোমরা ধ্যান-জপ করছো ? আর যেটুকুই বা করছো _ সেটা তোমার সারাদিনের কর্মের নিরিখে কতটুকু ?
তাই আমি তোমাদের সকলকে বলছি সকাল-সন্ধ্যা সময় পেলে একটুখানি চোখ বুজে বসে থাকো –যে মন্ত্র দেওয়া হয়েছে, সেটা একমনে জপ করো ৷ কিন্তু এটাই সব নয় আমি তোমাদের আরও বলেছি __শ্বাসে-প্রশ্বাসে জপ করতে ! কিন্তু – বলো , তোমরা কজন সেটা করো ?
মনকে বিষয়শূন্য করে ধ্যান করতে বলেছি – কজনের তা হয় ? তাহলে উন্নতি কি করে হবে ? যেটুকু হয়, সেটা ঐ যে তোমরা এখানে অর্থাৎ এই বনগ্রাম আশ্রমে আসো – আমার সান্নিধ্যে বসো –আর তখন আমার কথা শুনতে শুনতে তোমাদের তন্ময়তা আসে ! এতে ব্রেন-এর এক্সারসাইজ হয় এবং তখন ধ্যান হয় ! এইটুকুই তোমাদের সঞ্চয় !
যদি ঠিক ঠিক আমার কথা শুনে চলতে _তাহলে কি আর আমাকে এত বোঝা টানতে হোতো ! আমার কাছে দীক্ষা নিয়ে তো তোমরা আমারই বোঝা বাড়ালে ! আমি ভাবলাম তোমরা বোধহয় আমার বোঝা হালকা করবে – কিন্তু ফলটা কি হলো ?
“বাউলের মর্মকথা”- বইটা একবার দুবার নয়, বারবার পড়বে ৷ একশ বার – দুশো বার এমনকি সারাজীবন ধরে পড়ো, আর এর অন্তর্নিহিত অর্থ, বিভিন্ন তত্ত্বের ব্যাখ্যা উপলব্ধি করার চেষ্টা করো ৷ যেমন যেমন সাধন পদ্ধতি বলেছি ঠিক ঠিক তেমনি পালন করো – দেখবে তোমার অন্তরের সব জট কেটে যাচ্ছে – সব রহস্যই তোমার কাছে নিজে নিজেই উন্মুক্ত হোচ্ছে – তুমি চিরমুক্ত, চির স্বাধীন হয়ে অনন্তের বুকে বিরাজ করছো ৷৷
গুরু মহারাজ : ~ ঠিকই বলেছো যে, আমার কথ্য ভাষা বা Language __ Poor ! কারণ আমি তো আর তোমাদের মতো কলেজ ইউনিভার্সিটিত লেখাপড়া শিখিনি ! সাধারণতঃ আমি কথা বলার সময় ‘যখন যেখানে থাকি, সেখানকার সাধারণ কথ্য ভাষা’-ই ব্যবহার করি ৷ এটা সত্যি বলছি_আমি দেখেছি যখন আমি যে অঞ্চলে যাই বা ঘুরি তখন আমার কথায় সেই অঞ্চলের কথ্য ভাষার টান এসে যায় ! এখানে আমার কথ্য ভাষা শুনে সব্য-রা(সিঙ্গুরের একজন ভক্ত) বলে এটা নাকি আমার Modesty – কিন্তু তা নয় ! আসলে সব্য আমার সাথে অনেক জায়গায় ঘুরেছে , বিভিন্ন স্থানে আমার বিভিন্ন ভাষায় ‘কথা বলা’ দেখেছে – তাই এরূপ ওর ধারণা ! পৃথিবী গ্রহের যে কোনো প্রান্তের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না – আমি যেখানে যখন থাকি, তখন সেখানকার কথা বলার ধরন আপনা-আপনি আমার আয়ত্ত হয়ে যায় !
আর তুমি কি বলছিলে “বাউলের মর্মকথা”-র ভাষার কথা ? দ্যাখো , কথাতেই আছে কথ্য ভাষা আর লেখ্য ভাষা ৷ যে ভাষায় মানুষ কথা বলে , যেরকম Accent প্রয়োগ করে __ঠিক ঠিক সেরকম ভাষায় কখনও কোনোকিছু লেখা যায় না ৷ কথা সাহিত্যিকেরা অনেকটা চেষ্টা করেছে লেখ্য ভাষাকে সহজ সরল করার জন্য – কিন্তু 100% হয় না ৷ যাই হোক, “বাউলের মর্মকথা”-র কথায় আসছি । “বাউলের মর্মকথা”-র ‘ভাষা’ সহজ, কিন্তু ‘ভাব’ সাধারণ মানুষের কাছে একেবারে নতুন ! তাই একবার বা দুবার পড়লেও বিষয়বস্তু ‘কঠিন’ মনে হয় । “বাউলের মর্মকথা” তো সাধারণের জন্য নয় এটি আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের জন্য ! তুমি কি এই বইটিকে ‘প্রেমের উপন্যাস’ মনে করেছো নাকি __যে একবার পড়েই তার সারমর্ম হৃদয়ঙ্গম করে বইটিকে পাশে সরিয়ে রাখবে ! সাধারণ গল্প-উপন্যাসে মানুষের নিত্য জীবনের হাসি-কান্না , সুখ-দুঃখ , প্রেম বিরহের ঘটনা লিপিবদ্ধ থাকে _ যার সাথে পাঠকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মিল রয়েছে ! মানুষের মনোজগতে এসব সম্বন্ধে জন্ম-জন্মান্তরের অভিজ্ঞতা রয়েছে – তাই উপন্যাস, গল্প ইত্যাদি একবার পড়লেই ধারনা হয়ে যায় ! অনেক ক্ষেত্রে আর একবার পড়ারও প্রয়োজন হয় না । কিন্তু “বাউলের মর্মকথা”-র বিষয়ের ভাব বা অন্তর্নিহিত তত্ত্ব সাধারণের কাছে অজানা ! কারণ সাধন জীবনের এই স্তরে এখনও তো তোমরা পৌঁছাওনি ! এগুলি সম্বন্ধে পূর্ব পূর্ব জীবনেরও কোনো অভিজ্ঞতাও তোমাদের নাই ! সুতরাং তোমার মতো যে কোনো সাধারণ পাঠকের কাছে এগুলি তো প্রথমে বোধগম্য হবেই না ! কত মানুষের এই ধরনের বই পড়তে পড়তে ঘুম চলে আসে ! অর্থাৎ ব্রেন নিতে পারে না ! আমার এখানেই দেখেছি _ Sitting-এ বসে সাধারণ বিষয় নিয়ে যতক্ষণ আলোচনা চলছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিক ছিল _ কিন্তু যেই অধ্যাত্ম-বিষয়ক আলোচনা শুরু হোলো –অমনি দেখি অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে ! তাঁর মানে বুঝতে পারছো তো _ ব্রেনসেলগুলো কাজ করছে না !
মানুষের চেতনায় আধ্যাত্মিক জগতের টেস্ট থাকলে, তবেই আধ্যাত্মিক শাস্ত্র ভালো লাগে বা সেই গ্রন্থগুলি ভালোভাবে বোঝা যায় ৷ আর তখন ঐসব ব্যক্তির এই ধরনের শাস্ত্র পাঠের প্রেরণা জন্মায়, পড়তে ভালো লাগে । সমাজে সব রকমের রুচির মানুষ রয়েছে, তাই সব ধরনের গ্রন্থও রয়েছে ৷ দেখবে কমবয়সী কিছু ছেলে-মেয়ে লুকিয়ে মেলায় গিয়ে সস্তায় রগরগে আদিরসাত্মক চটি বই কিনছে ! ঐ মেলাতেই এমন সহস্র ব্যক্তিরা রয়েছে যারা ঐদিকে তাকিয়েও দেখছে না ! বইমেলাগুলিতে গেলে এইসব খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় ! সেখানে দেখা যায় _কেউ গবেষণামূলক বই ভালোবাসে – তাই সে বিভিন্ন স্টলে ঘুরে ঘুরে ঐ ধরণের বই খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে ! কেউ উপন্যাস, কেউ কেউ আবার ধর্মমূলক বই- অধ্যাত্মবিষয়ক গ্রন্থ – মহাপুরুষের জীবনী বা বাণী পড়তে ভালোবাসে _ তারা সেইসব বই খুঁজে বেড়াচ্ছে !
সহস্র সহস্র মানুষ তাদের সহস্র সহস্র ধরনের রুচি ! এই রুচি তৈরি হয় তার চেতনার লেভেল অনুযায়ী । কোনো ব্যক্তি চেতনায় কতটা উন্নত – সেই দিয়েই বিচার হয় তার ‘লেভেল’ ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এইজন্যই বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন, যারা দরকচা মারা পন্ডিত – তারা অনেকটা উঁচুতে ওঠে শকুনের মতো, কিন্তু নজর থাকে ভাগাড়ের দিকে, নিচের দিকে ! সুতরাং ধনে-মানে, শিক্ষায় উন্নতরাও প্রকৃত পক্ষে উন্নত নয়, একমাত্র আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত বা চেতনায় উন্নত মানুষরাই প্রকৃত উন্নত । এইসব ব্যক্তিদের দ্বারা সমাজে কোনোদিন কোনো ক্ষতি তো হবেই না বরং এরা যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন এঁরা সাধ্যমত সমাজের মঙ্গল সাধন করে যাবেন ।
তাহলে বুঝলে তো –কি বলতে চাইলাম! চেতনার উন্নতি-ই প্রথম লক্ষ্য হোক মানুষের ! এটাই মানবজীবনে প্রাথমিকভাবে ‘মুক্তি’ । সাধারণভাবে ‘মুক্তি’ বলতে যা বোঝায় সেটা হোল মানুষের মনোজগতের ‘লেভেলের পরিবর্তন’ । মনোজগতের এক লেভেল থেকে অন্য লেভেলে উন্নীত হওয়া ৷
যে কোনো সাধক , তা সে যে মত(ইসলামীয় মত, খ্রীষ্টীয় মত,জৈন মত, বৌদ্ধ মত ইত্যাদি) বা পথেরই হোক না কেন, সাধন-ভজন শুরুর পাঁচ বছর – সাত বছর পরেও যদি দেখা যায় সে একই মানসিকতায় রয়েছে বা একই চেতনার লেভেলে রয়েছে, তা হলে জানতে হবে তার সাধন-ভজন বা ক্রিয়া পদ্ধতিতে কোনো ছিদ্র রয়েছে ! যে ছিদ্র দিয়ে তার সব সাধন-জনিত সংগ্রহ বেরিয়ে যাচ্ছে ৷ কিন্তু কোনো অধ্যাত্মপথের ব্যক্তির জীবনে যদি দেখা যায় ধীরে ধীরে কর্মের, রুচির, মানসিকতার পরিবর্তন হোতে শুরু করেছে __ তাহলেই জানবে ঐ ব্যক্তির সাধন পদ্ধতি সঠিক ! তার আধ্যাত্মিক উন্নতি হচ্ছে , তার চেতনার লেভেলের উন্নতি ঘটছে !
তবে, এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত মুমুক্ষুত্ব ও মহাপুরুষ সংসর্গ । এর জন্য সাধককে প্রথমেই ‘নিষ্কপট’ হোতে হবে ৷ মনে নানান রকম প্যাঁচ রয়েছে, আর তুমি সাধন-ভজন করছো, এতে কি ফল পাবে ? পিঠে শোলার বোঝা বেঁধে জলে ডোবা যায় ? মুমুক্ষু হোতে হবে – অর্থাৎ আমি অন্য কিছু চাই না, অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই _এই এক লক্ষ্য। তোমরা এখানে যারা বসে আছো – তাদের মধ্যে কজন নিষ্কপট বলো ? কজন মুমুক্ষু ?
তোমরা অনেকেই অভিযোগ করো – “কই বাবা ! ধ্যান জপ তো করছি, উন্নতি হচ্ছে কই ?”__ সত্যিই কি তোমরা ধ্যান-জপ করছো ? আর যেটুকুই বা করছো _ সেটা তোমার সারাদিনের কর্মের নিরিখে কতটুকু ?
তাই আমি তোমাদের সকলকে বলছি সকাল-সন্ধ্যা সময় পেলে একটুখানি চোখ বুজে বসে থাকো –যে মন্ত্র দেওয়া হয়েছে, সেটা একমনে জপ করো ৷ কিন্তু এটাই সব নয় আমি তোমাদের আরও বলেছি __শ্বাসে-প্রশ্বাসে জপ করতে ! কিন্তু – বলো , তোমরা কজন সেটা করো ?
মনকে বিষয়শূন্য করে ধ্যান করতে বলেছি – কজনের তা হয় ? তাহলে উন্নতি কি করে হবে ? যেটুকু হয়, সেটা ঐ যে তোমরা এখানে অর্থাৎ এই বনগ্রাম আশ্রমে আসো – আমার সান্নিধ্যে বসো –আর তখন আমার কথা শুনতে শুনতে তোমাদের তন্ময়তা আসে ! এতে ব্রেন-এর এক্সারসাইজ হয় এবং তখন ধ্যান হয় ! এইটুকুই তোমাদের সঞ্চয় !
যদি ঠিক ঠিক আমার কথা শুনে চলতে _তাহলে কি আর আমাকে এত বোঝা টানতে হোতো ! আমার কাছে দীক্ষা নিয়ে তো তোমরা আমারই বোঝা বাড়ালে ! আমি ভাবলাম তোমরা বোধহয় আমার বোঝা হালকা করবে – কিন্তু ফলটা কি হলো ?
“বাউলের মর্মকথা”- বইটা একবার দুবার নয়, বারবার পড়বে ৷ একশ বার – দুশো বার এমনকি সারাজীবন ধরে পড়ো, আর এর অন্তর্নিহিত অর্থ, বিভিন্ন তত্ত্বের ব্যাখ্যা উপলব্ধি করার চেষ্টা করো ৷ যেমন যেমন সাধন পদ্ধতি বলেছি ঠিক ঠিক তেমনি পালন করো – দেখবে তোমার অন্তরের সব জট কেটে যাচ্ছে – সব রহস্যই তোমার কাছে নিজে নিজেই উন্মুক্ত হোচ্ছে – তুমি চিরমুক্ত, চির স্বাধীন হয়ে অনন্তের বুকে বিরাজ করছো ৷৷