[গুরু মহারাজ তাঁর প্রথম বনগ্রামে আসা এবং আশ্রম প্রতিষ্ঠার কথা বলছিলেন। আজ তার‌ই পরবর্ত্তী অংশ]
যাইহোক, আমি বনগ্রামে আসার পর থেকেই আমার বন্ধুরা (অর্থাৎ আশ্রমের কাজের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিরা) বনগ্রামে পাকাপাকি ভাবে থাকার জন্য আসতে শুরু করলো । তৃষাণ(স্বামী পরমেশ্বরানন্দ), খোকন (স্বামী আত্মানন্দ), মানিক(স্বামী অখন্ডানন্দ),দেবেন্দ্রনাথ(স্বামী বিশুদ্ধানন্দ), মিহির (স্বামী প্রজ্ঞানন্দ) প্রমুখেরা প্রায় প্রথম থেকেই ছিল । এরা ছাড়াও আশ্রম প্রতিষ্ঠার পরে পরেই একে একে এসে হাজির হোলো প্রশান্ত (সচ্চিদানন্দ), শম্ভু (সত্যানন্দ) – ইত্যাদিরা৷ এই দলে মুখার্জি বাড়ির ছেলে মেয়েরাও ব্রহ্মচারী বা ব্রহ্মচারিণী হিসাবে full-timer হয়ে গেল ।
কিছুদিন পরে উদয় (স্বরূপানন্দ),মুরারী(স্বামী নিস্কামানন্দ), মদন মহারাজ (চিৎবিলাসানন্দ)– এরাও এসে গেল ৷ ব্যস্, শুরু হয়ে গেল আশ্রমের কাজ ! প্রথম প্রথম আশ্রমে খাওয়া-দাওয়া বলতে Rice-to-Rice অর্থাৎ দুপুর এবং সন্ধ্যায় ডাল-ভাত-একটা তরকারি ৷ মধ্যিখানে কোনো কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না । আশ্রমে চা-য়ের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, কেউ খেতোও না ৷ তারপরে যখন তৃপ্তি-মা (সংহিতাপ্রাণা) এলো, তখন আশ্রমে আমার ঘরের পিছনে একটা মাটির দেড়তলা ঘর হয়েছিল, সেখানে উপরে তৃপ্তি একটা ষ্টোভ রাখতো এবং ও সকাল-সন্ধ্যায় দুই-এক কাপ চা তৈরি করতো ৷ সেটা ওর নিজের জন্য, আর হয়তো তৃষাণ বা অন্য দু-একজন ব্রহ্মচারীরা মাঝে মধ্যে খেতো ।
আরও পরে এলো ত্রিপুরা থেকে মৌনী-মা (কৃষ্ণজ্যোতিপ্রাণা) । কৃষ্ণ দরশনের সংকল্প নিয়ে দীর্ঘদিন মৌন ছিল বলে ওর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘মৌনী-মা’ ৷ আমার সাথে দেখা হবার পর মৌনী-মা মৌনব্রত ভঙ্গ করেছিল ! ও তখন বনগ্রামে একটানা অনেকদিন ছিল, তখন তো আশ্রমে মায়েদের (মেয়েদের) জন্য আলাদা কোনো ঘর বা পায়খানা-বাথরুমের ব্যবস্থা ছিল না, তাই মৌনী মা সহ অন্যান্য ব্রহ্মচারীনীরা ন’কাকাদের বাড়িতে থাকতো । মৌনী মা খুব ধ্যান করতো এবং ওই সময় ওর ইষ্ট দর্শন‌ও হয়েছিল I পরে ও এখানেই ব্রহ্মচর্য্য নিয়েছিল এবং তার কিছুদিন পর নিজের এলাকায়(ত্রিপুরায়) ফিরে গেছিলো। ওখানে ও মেয়েদের জন্য অনাথ আশ্রম করেছে, এখান থেকে এতোটা দুরে একা থেকে কাজ করা সহজ কথা নয় ! মৌনী মা কষ্ট করেই সব কিছু বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে ৷
মুরারী এখন যে অফিসঘরে বসে, ওটি যখন তৈরি হয় তখন আশ্রমের দুবেলা-দুমুঠো খাবার জোটানোই মুস্কিল ছিল তো নতুন ঘর কি করে হবে ! ফলে আশ্রমিকরা সকলে অংশগ্রহণ করায় একতলা ঘরটা হয়েছিল! সবাই মিলে মাথায় করে ইঁট বয়েছিল , কাদা তৈরি করেছিল ‌। ঘরটা সিমেন্টের গাঁথনি নয় _জানোতো, ইঁট আর মাটির গাঁথনি ! সিমেন্টের প্লাষ্টার করা হয়েছে। ঘরের ভিতও তেমন জুতসই ছিলো না । পরে যখন দোতলা করা হোলো, তখন ফের নিচ থেকে ঢালাই কলম (Column) তুলতে হোলো ৷
গোটা বনগ্রামের মধ্যে তখন ইঁটের বাড়ি একটাই ছিল – আর আশ্রমের ঐ অফিসঘরটি হোলো ইঁটের তৈরি !
পরে যখন বনগ্রামের মুখার্জি বাড়ির কালীমন্দির বা ছাত্রদের (অনাথ বালক) জন্য প্রথম (তিন তলা) বিল্ডিং তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল, তখন মালপত্র (শিক,সিমেন্ট ইত্যাদি) ভান্ডুল পর্যন্ত লরী-তে নিয়ে এসে ওখানে ঢেলে আবার re-carriage করতে হোতো । ফলে খরচ অনেকগুণে বেশি হতো ৷ রাস্তাঘাটের এইসব নানান অসুবিধার জন্যই বনগ্রাম বা পাশাপাশি গ্রামগুলোয় পাকাবাড়ি প্রায় ছিলই না । তাছাড়া সাধারণ মানুষের অভাবও ছিলো খুব, পাকাবাড়ি করবেই বা কি করে ?
বনগ্রামে অনাথ আশ্রম হবে –এটা যখন প্রচার করা হয়ে গেল, তখন ভাবা গিয়েছিল যে, হয়তো সহজেই আশ্রমে দেবার মতো অনেক অনাথ (যারা দরিদ্র এবং পিতৃহীন)ছেলে পাওয়া যাবে ! কিন্তু ব্যাপারটা অতো সহজ ছিল না ! প্রথমেই আমি তৃষাণ, মুরারী এদের সকলকেই বলে দিয়েছিলাম যে, যে-সমস্ত ছেলেদেরকে এখানে নেওয়া হবে তাদের থাকা-খাওয়া-পড়াশুনা – ইত্যাদির সমস্ত ব্যবস্থা করে, তবেই যেন তাদের নেওয়া হয় । কারণ এমনিতেই এই ধরনের শিশুরা পরিবারে বা সমাজে বঞ্চনার শিকার ! কারণ যেহেতু তাদের বাবা নাই, মায়েরও সচ্ছলতা নাই, অপরের উপর নির্ভরশীল –তাই ছোটোবেলা থেকে এদের নিজেদেরকে এবং তার মাকে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকার হতে হয়েছে ৷
এবার এই ধরনের ছেলেরা যদি আশ্রমে এসে আবার নতুন করে বঞ্চনার মধ্যে পড়ে__অর্থাৎ ভালো করে পেটভরে খেতে না পায়, পড়াশুনা করতে না পারে__তাহলে সেটা হবে চরম অপরাধ ৷
সেইজন্যেই প্রথমে কিছু জায়গা-জমি কিনতে হয়েছিল, তারপর ছেলে নেওয়া শুরু করার ভাবা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনা কি ঘটেছিলো জানো ? এই ধরনের ছেলেদের guardianরা বা কোনো স্থানের প্রতিবেশীরা তাদের পাড়ায় ওই ধরনের ছেলে থাকা সত্ত্বেও আশ্রমে পাঠাতে চাইছিলো না ! বরং স্থানীয়ভাবে প্রচার হয়ে গেল যে, ওরা ছোটো ছোটো ছেলেদেরকে নিয়ে ব্যবসা করবে, ওদের কিডনি পাচার করে দেবে -ইত্যাদি ইত্যাদি !! তাই প্রথম প্রথম আশ্রমের ভক্তদের দু-একজন ছেলে এবং বনগ্রামের ও পাশাপাশি গ্রামের দু-একজনকে নিয়ে প্রথম অনাথ আশ্রমের কাজ শুরু হয়েছিল !
প্রথম প্রথম আশ্রমের রান্নাঘরে ব্রহ্মচারীরা নিজেরাই রান্না করতো ৷ ওরা পালা করে করে রান্না করতো । খোকন মহারাজ, স্বরূপানন্দ, মুরারী এরা অনেকদিন পালা করে রান্নাঘর চালিয়েছে ৷ এদের পর পঞ্চানন্দ ঘোষ , মালতিপুরের গোবিন্দ এরা রান্নাঘরের দায়িত্ব নিয়েছিল । তবে আরও পরে আশ্রমের লোকসংখ্যা বেড়ে যা অবস্থা হোলো__ তাতে পাকাপাকিভাবে একটা বড় রান্নাঘর করতেই হোলো । পুকুরের ওইপারে অগ্নিকোণে বড় রান্নাঘর তৈরি করা হোলো, যেখানে উপর নিচ মিলিয়ে কমপক্ষে একহাজার লোক বসে খাওয়া দাওয়া করতে পারবে ।
এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত বিল্ডিং হয়েছে, সেগুলি তিনতলা ! তবে এবার স্কুল বিল্ডিং তৈরি হবে চারতলা ! স্কুল বিল্ডিং-এরও মাপজোপ হয়ে গেছে, কাজ শুরু হবার অপেক্ষা ! তৃষাণ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এখানকার soil-test করিয়েছে–ওরাই বলেছে যে, এই মাটিতে চারতলার বেশি উঁচু বাড়ি করা উচিত হবে না !
তবে এখন আমাদের আশ্রমে অনেক নতুন নতুন ব্রহ্মচারীরা আসছে, যাদেরকে স্কুলের বা চরৈবেতি কার্যালয়ের অথবা রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করতে বলা হয়েছে ৷ আশ্রমের যে কোনো দপ্তরে আশ্রমিকরা কাজ করুক না কেন_প্রতিটি কাজ‌ই মানবকল্যাণের নিমিত্ত । আর একজন নিঃস্বার্থ কর্মীর তো এই ধরনের কাজেই সার্থকতা ! বাইরের লোক দিয়ে কাজ করালে__ ভক্ত লোক হোলেও সে কাজ সম্পূর্ণভাবে ‘নিঃস্বার্থ’ হোতে পারে না ! কিন্তু আশ্রমের কাজ, সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীরা করলে তাদের মধ্যে নিঃস্বার্থতা থাকবে, প্রাণ থাকবে,– ফলে কাজটি সম্পূর্ণতা পাবে ।
তা নাহলে তো সব কাজই pay করা লোক নিয়োগ করে করা যায়, কিন্তু সেটা করতে গেলে আশ্রম আর আশ্রম থাকবে না – hostel হয়ে যাবে ।৷