গুরু মহারাজের কথা (কথিত এবং লিখিত) নিয়ে এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। গুরু মহারাজ তাঁর লেখা প্রথম গ্রন্থ ” সহজতা ও প্রেম” গ্রন্থে যে সমস্ত কথা আলোচনা করেছিলেন – আমরা ছিলাম সেইসব কথায় ৷ গুরুমহারাজ সৃষ্টির আদি শব্দ বা ‘নাদ’ অর্থাৎ ‘প্রণবে’র রহস্য সম্বন্ধে আমাদের সকলকে সুন্দর ও সহজ করে বুঝিয়েছেন, আর আমরা সেইসব কথা নিয়েই আলোচনা করছিলাম৷
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” প্রিয় আত্মন্ – আমরা এতোক্ষন ‘শব্দ উপাসনা’-র গুরুত্ব বা তাৎপর্য্য নিয়ে আলোচনা করলাম ৷ এইবার আমরা বর্তমান সমাজে ঐ ‘শব্দ উপাসনা’ বা ‘নাম উপাসনা’-কে কেন্দ্র করে কিরূপ প্রতিক্রিয়া চলছে – সে সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করবো।” তাহলে এটা আমরা বুঝতে পারছি যে, এতক্ষণ গুরুমহারাজ ‘নাম উপাসনা’ বা ‘শব্দ উপাসনা’-র গুরুত্ব বা তাৎপর্য্য নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এবার উনি বর্তমান মানবসমাজে এই ‘উপাসনা’র কি প্রতিক্রিয়া চলছে – সেই সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। যাই হোক, গুরুমহারাজ কি বলছেন তা শোনা যাক্ !
উনি বললেন – ” কিছু সংখ্যক ব্যক্তি বলে থাকেন – কলিকালে ‘তারকব্রহ্ম নাম’ ছাড়া কারো গতি নেই বা মুক্তি নেই। এইরূপ আপন আপন সম্প্রদায়ের কোনো বিশেষ নাম বা শব্দকে প্রাধান্য দিয়ে তারা বলেন – এটাই তারক(যা তারণ করে) এবং মুক্তি প্রদায়ক। আর অন্য যে সমস্ত নাম বা শব্দ নিয়ে যারা উপাসনা করছেন, তাদের উপাসনা ভস্মে ঘৃতাহুতি তুল্য !” এই দেখুন – এটাকেই গুরুমহারাজ সাম্প্রদায়-বুদ্ধি বলেছেন। এই জগতে অসংখ্য সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়ে রয়েছে – আর প্রত্যেকেই সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন, অর্থাৎ নিজের নিজের মতটাই শ্রেষ্ঠ এবং বাকিরা নিকৃষ্ট বলে প্রচার করতে থাকে।
এইজন্যেই গুরুমহারাজ এরপর বললেন – ” এইরূপভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায় আপন আপন সাম্প্রদায়িক বিশেষ ‘নাম’ বা ‘শব্দ’-কে কেন্দ্র করে বিবাদ করতে থাকেন এবং আপন সাম্প্রদায়িক বিশেষ ‘নাম’-কে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য ও অপর সম্প্রদায়ের বিশেষ ‘নাম’-কে হেয় বা নিষ্ফল প্রতিপন্ন করবার জন্য নানাপ্রকার শাস্ত্র, পুঁথি, ইতিহাস ইত্যাদি দ্বারা প্রমাণ সংগ্রহ করে কলহ ও তর্ক করে থাকেন।” গুরু মহারাজের বলা এই কথাগুলির সত্যতা তো আমরা সমাজে অহরহ দেখতে পাই। ছোট-বড় যেকোনো সম্প্রদায়েরই নিজস্ব তারক (যা জীবকে তারণ করে বা ত্রাণ করে – সেইরূপ কোনো নাম বা শব্দ)-ব্রহ্ম নাম অর্থাৎ পরমেশ্বরেরই একটা মনোমত নাম ধরে উপাসনা করে থাকে এবং অপর সম্প্রদায়ের ঐরূপ কোনো নামকে হেয় প্রতিপন্ন করতে থাকে। আর এই নিয়েই যত বিবাদ-বিসম্বাদ, মারামারি, হানাহানি, রক্তপাত ঘটে থাকে। গুরুমহারাজ এটাও বলেছেন যে, এই পৃথিবীর মানবসমাজ নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক বিশেষ নামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং অপর সম্প্রদায়ের বিশেষ নামকে হেয় করার জন্য নানারকম শাস্ত্র, পুঁথি, ইতিহাস ইত্যাদি নানা কিছু দ্বারা প্রমাণ সংগ্রহ করে বা প্রতিষ্ঠা করে কলহে লিপ্ত হয়।
শাস্ত্র, পুঁথি, ইতিহাস ঘেঁটে তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করে কোনো মতকে, কোনো বস্তু বা বিষয়কে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টাটা প্রধানতঃ so called শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীদের কাজ। তাদের ধারণা_ তথ্য-প্রমাণের দ্বারাই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা যায়৷ কিন্তু এই ধারণা সর্বতোভাবে ভুল ! কারণ ‘সত্য’ একমাত্র সত্যদ্রষ্টারাই জানেন বা দেখতে পান। একমাত্র সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের উপলব্ধ সত্য বেদাদি শাস্ত্র ছাড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা প্রণীত গ্রন্থগুলিতে উপলব্ধ সত্য নাই – সেগুলি বেদাদি শাস্ত্রের নিজ নিজ মত অনুযায়ী ব্যাখ্যা রয়েছে, আর তাছাড়া তাতে আপন মনের মাধুরী মেশানো হয়েছে। পুঁথিপত্রগুলি বেশিরভাগই সামাজিক বিধান এবং বিভিন্ন দেবদেবীর স্তব-স্তুতি সম্বলিত রচনা। আর ইতিহাস ? ইতিহাস ঘেঁটে যদি কেউ সত্য খুঁজতে যায় তাহলে তার মতো আহাম্মক আর দ্বিতীয়টি নাই ! কারন আমরা যেগুলিকে ‘ইতিহাস’ বলি – সেগুলি অত্যন্ত নবীন, মাত্র হাজার দুয়েক বছর আগে থেকে সৃষ্ট হয়েছে ! এইগুলি সৃষ্টি হয়েছিল রাজতন্ত্রের যুগে ! রাজন্যবর্গের আদেশে বা নির্দেশে, পুরস্কারের লোভে রাজাকেই সবার থেকে বড় করে দেখানো, যাতে বহুকাল মানুষের মনে সে বেঁচে থাকে_ তার জন্য তাদেরই নির্বাচিত পেটোয়া-শিক্ষিত লোকেদের দ্বারা ইতিহাস লেখানো হোতোএই তো ইতিহাস ! দেখুন না এখন তো গণতন্ত্রের যুগ, কোথাও আবার সমাজতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত ! কিন্তু এখনই যদি কোনো ব্যক্তি সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি বা তাদের খারাপ দিকগুলো লেখার আকারে প্রকাশ করতে চায় – তার কি অবস্থা হোতে পারে_ তা তো আমরা সবাই জানি ! তাহলে রাজতন্ত্রের যুগে রাজার সম্বন্ধে কোনো খারাপ কথা লেখার সাহস কি কোনো ঐতিহাসিকের পক্ষে দেখাতে পারা সম্ভব ছিল ?? সুতরাং বেদাদি শাস্ত্র ছাড়া অন্যান্য পুরাণাদি শাস্ত্র, স্মৃতিশাস্ত্র ইত্যাদির সাহায্যে বা পুঁথি অথবা ইতিহাসের সাহায্যে ‘সত্য’-কে প্রমাণ করার চেষ্টা একেবারেই নিষ্ফল !
যাইহোক, আমরা গুরুমহারাজের কথায় ফিরে যাই। উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – সমাজে কত প্রকারের কুসংস্কার শিকড় গেড়ে আছে, আর মানব দিনে দিনে কেমনভাবে বিভ্রান্ত হোচ্ছে এবং অপরকেও বিভ্রান্ত করছে। ‘শব্দ উপাসনা’-র আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভুলে তাদের কুসংস্কারগ্রস্থ মন উপলক্ষ্যকে প্রধান ভেবে লক্ষ্যচ্যুত বা কক্ষচ্যুত অবস্থা লাভ করেছে এবং লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর না হয়ে উপলক্ষে আটকে গেছে।”