শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা ওনার লেখা সহজতা ও প্রেম গ্রন্থের একেবারে শেষ পাতায় এসে পৌঁছেছি। এই গ্রন্থের একেবারে শেষের দিকে এসে গুরুজী যে কি আকূলভাবে আমাদেরকে (সাধারণ মানুষদেরকে) আহ্বান করেছেন স্বার্থবুদ্ধি বিসর্জন দেবার জন্য – তা আমরা আগের আগের আলোচনায় দেখেছি। এখন আমরা দেখি প্রেমের প্রকৃতি সম্বন্ধে গুরুজী আর কি বলেছেন। উনি এরপরে বলেছেন – ” প্রেম স্বপক্ষ সমর্থন করে না, যেখানে আত্মরক্ষার তাগিদ, সেখানে প্রেম প্রস্ফুটিত হয় না। প্রেম সংঘাত ও আঘাত বিমুখ।”
দেখেছেন ব্যাপারটা ! তার মানে দাঁড়ালো এই যে, জীবনের জৈবিক ধর্ম বা জৈবিক প্রবৃত্তি থাকতে মানবজীবনে ‘প্রকৃত প্রেম’ প্রকটিত হবে না। মানব সমাজে যেটা আমরা ‘প্রেম’ বা ‘ভালোবাসা’ হিসাবে দেখি – সেটা জৈবিক প্রেম বা জৈবিক ভালোবাসা – পরমপ্রেম বা প্রকৃত প্রেম নয়। গুরুজী একবার আলোচনা (সিটিং) প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, ” স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুব প্রেম, খুব ভালোবাসা দেখছিস তো ! যদি ওই স্ত্রী-টির মধ্যে হঠাৎ করে কোনোরূপ যৌন দুর্বলতা দেখা দেয় – তাহলে দেখবি তার প্রেমিকের প্রেম কোন দিকে পালিয়ে যাবে ! প্রথমে ঐ দম্পতির মধ্যে ঝটাপটি শুরু হবে, তারপর ডিভোর্স এবং পুরুষটি আবার অন্যত্র বিবাহ করবে ! আর ‘ভালোবাসা’ করে বিবাহ করেছে এমন দম্পতির মধ্যে পুরুষটির যদি যৌন-দুর্বলতা থাকে – তাহলে হয়তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা কিছুদিন মানিয়ে নেবার চেষ্টা করবে – কিন্তু তাও বেশিদিন স্থায়ী হবে না ! ঐসব ক্ষেত্রে স্ত্রী-টিও অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে বসবে ! তাই বলছিলাম বাবা – ঐ সব যাত্রা-সিনেমা-নাটক-থিয়েটারের প্রেম বা উপন্যাসের প্রেমের কথা আমাকে বোলো না ! মা মহামায়ার জগতে, জীবনে পথের ঘূর্ণিপাকে পড়ে গেলে বাবা – ওইসব প্রেম-টেম কোথায় উড়ে চলে যাবে তার আর সন্ধানই পাওয়া যাবে না !”
আবার বাবা-মায়ের সন্তানের প্রতি যে ‘ভালোবাসা’ সেটি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে উনি পিতা অপেক্ষা মাতার মমতার প্রতি-ই অধিক জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও উনি এই ভালোবাসাকে ‘Absolute প্রেম’ কখনোই বলেন নি। এখানেও – সামান্য হোলেও স্বার্থবুদ্ধি ক্রিয়াশীল থাকে, চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপার থাকে। এইজন্য একদম শিশু অবস্থা থেকে বাল্য অবস্থা পর্যন্ত বা কৈশোর পর্যন্ত মা ও সন্তানের সম্পর্কের মধ্যে যে ভালোবাসার মাধুর্য থাকে – সেই মাধুর্যকেই উনি অধিক প্রাধান্য দিতেন ! এরপরে অর্থাৎ যৌবনের পর থেকে আর সন্তানের উপর পিতা-মাতার ভালোবাসা প্রদর্শন করতে যাওয়াটা অধিকার প্রতিষ্ঠার সামিল হয়। ফলে ঐ সন্তানের (নারী বা পুরুষ) যৌবনকালের সাথীর (সন্তানটির স্বামী বা স্ত্রী) সাথে একটা সংঘাত শুরু হয়ে যায়। তারা (সন্তানটির স্বামী বা স্ত্রী) বলে বসে – “তুমি তোমার বাবা-মায়ের সাথে থাকলেই পারতে, আমাকে বিবাহ করার প্রয়োজনটাই বা কি ছিল ?”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! ‘প্রেম’ সম্বন্ধে আমাদের কতো ভুল ধারণা ছিল দেখেছেন ! আমরা ‘প্রেম’ বলতে কতকগুলো উচ্ছ্বাস-উদ্দামতা-আবেগ ইত্যাদির বহিঃপ্রকাশকে মনে করতাম ! কিন্তু গুরুমহারাজের কথা থেকে আমরা প্রেমের কি অপূর্ব-অলৌকিক-মহান সংজ্ঞাসমূহ পেলাম বলুন তো ! কি সুন্দর কথা উনি বললেন – “প্রেম গ্রহণ-বিমুখ”! কোনো প্রকার গ্রহণেই আগ্রহী নয় প্রেম –প্রেম শুধু দিয়ে যায়, শুধুই দিয়েই যায় ! আর একটা সুন্দর কথা আমরা শিখলাম, তা হোলো –প্রকৃত প্রেমে ” চাওয়া-পাওয়ার সংস্কার বিলীন হয়ে যায় !” সত্যিই তো, আমাদের অন্তর্জগতে জন্মজন্মান্তরের অর্জিত নানারকমের সব সংস্কার রয়েছে, তার মধ্যে ‘চাওয়া-পাওয়া’র সংস্কার অন্যতম একটি ! এই সংস্কার একেবারে বিলীন হয়ে যায় পরমপ্রেমে। গুরুমহারাজ আরও বলেছেন যে, মানবজীবনে সাধনার চূড়ান্ত অবস্থায় প্রেম জাগ্রত হয়। আর একবার প্রেম জাগ্রত হোলে তখন আর ছোটো-বড় বা ক্ষুদ্র-বৃহতের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না – সবই একীভূত হয়ে যায়। এই একীভূত অবস্থাকে গুরুজী বলেছেন__ “ওঁ” অবস্থা ! এই অবস্থায় মানবমনের স্বতন্ত্রতা থাকে না, কোনোরূপ বৃত্তির তরঙ্গ উত্থিত হয় না এবং তা নিস্তরঙ্গ ভাব ধারন করে।৷