[আগের দিন আলোচনা হয়েছিল এক অদ্ভুত চরিত্রের কয়েদী যে শুধু জেলার সাহেবের নামে গুনগান করে, মুক্তি পেলেও যেতে চায় না শুধু জেলার সাহেব কে চায়।তাঁরই সন্ধানে সে এখন সদর শহরে। ]
°°°°°°° কত সুন্দর জেলার সাহেবের বাংলো! আহা! কি অপূর্ব শোভা চারিদিকের! অনেকে এই শোভা দেখতে দেখতে মত্ত হয়ে যায়! কি জন্য এতদূর এসেছে – সেটাই ভূলে যায়! কিন্তু এই কয়েদী আর পাঁচজনের মতো নয় সে সেখানে পৌঁছেও আপন লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলো না! সদাসর্বদা জেলার সাহেবের গুনগান করে, “হে জেলার সাহেব! একবার দর্শন দাও, তোমার নয়নমনোহর রূপ দর্শন করে নয়নযুগল সার্থক করি!”
আড়াল(অলক্ষ্য) থেকে জেলার সাহেব সব দেখেন! কয়েক দিন ভালো করে যাচাই করার পর ‘লোকটির তাকে দর্শন করার’ এতো আকুলতা দেখে হটাৎ একদিন জেলার সাহেব তার সামনে এসে হাজির! স্বয়ং জেলার সাহেবকে চোখেরকিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা! তখন স্বয়ং জেলার সাহেবই হাত ধরে তাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন! দু-চারটে মধূর বাক্যে সম্ভাষন করে তার অন্তরের সকল জ্বালা জুড়িয়ে দিলেন। কয়েদীর মনোবান্ছা পূর্ণ হোল। (সাযুজ্য) কেউ কেউ এখান থেকেই ফিরে যায় কিন্তু আমাদের গল্পের কয়েদী যে সে কয়েদী নয়! সে যখন জেলার সাহেবকে একবার কাছে পেয়েছে আর তাকে ছাড়তে চায় না! সে বলল “প্রভু! তোমার দর্শন পেয়েছি, স্পর্শও পেয়েছি কিন্তু তাতে আমার মন ভরছে না। আমি সদা-সর্বদা তোমার সাথে সাথে থাকতে চাই, তোমার সেবক হয়ে – চাকর হয়ে থাকতে চাই! আর যদি তুমি আমাকে সুযোগ্য মনে করোতাহলে তুমি আমাকে তোমার বন্ধু, মিত্র, সখা করে নাও! হে প্রিয়_ তুমি যে আমার একান্ত প্রিয় – পরম প্রিয়!!সদা সর্বদা তোমাকে দেখব, তোমার কথা শুনব, তোমাকে মনন করব, তুমি সামনে না থাকলে তোমাকেই স্মরণ করব!!”জেলার সাহেব তার আন্তরিকতা দেখে তাকে সেবা করার অধিকার দিলেন নিজগুনে ঐ ব্যক্তি ধীরে ধীরে জেলার সাহেবের অন্তরঙ্গ হয়ে উঠল। (সার্ষ্ঠি)
গল্পটা শেষ করে গুরুমহারাজ উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন ” দ্যাখো, এই জগৎসংসার যেন জেলখানা বা কয়েদ! মহামায়ার মোহিনী মায়ায় আবদ্ধ সাধারণ মানুষ ভুবনমোহিনী মায়া কাটিয়ে কি নিজের ক্ষমতায় বেড়োতে পারে? কখনোই পারবে না!
তাহলে উপায়??
উপায় আছে! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলে গেছেন “কলিতে নারদীয় ভক্তি কেঁদে কেঁদে শুধু প্রার্থনা!” এ যুগে ভক্তিমার্গ অবলম্বন করলে আধ্যাত্মিক উন্নতি অপেক্ষাকৃত সহজে হয়। ভক্তিপথের সাধকেরা যদি ঐ কয়েদীর ন্যায় মালিকের কাছে সদা সর্বদা মুক্তির জন্য প্রার্থনা করে মালিক(ঈশ্বর) তুষ্ট হয়ে সংসার গারদ থেকে তাকে মুক্ত করে দিতে পারেন। মুক্ত করার পর ঐ যে রক্ষীদের নজর রাখতে বলা হয়েছে, এরও তাৎপর্য রয়েছে। মায়ামুক্ত হোলেও ভক্ত নানান অন্য প্রলোভনে ফেঁসে যেতে পারে মা কিন্তু এটা চান না। তাই অধ্যাত্ন পথের পথিকের কাছে নানাভাবে সাহায্য আসে যাতে তার সাধনার বিচ্যুতি না ঘটে!
এবার পরবর্তী স্টেজের ব্যাখ্যায় যাচ্ছি_ ভক্ত তো মুক্তি চায় না, সে মুক্তিদাতাকে চায়! সে চায় তার প্রিয়তমের দর্শন- স্পর্শন, তাঁর সান্নিধ্য!
তাই প্রথমেই সে যোগাড় করছে তার প্রিয়তমের ঠিকানা কিভাবে সেখানে পৌঁছাবে তার পথ এবং সেই পথ ধরে যেতে যেতে একদিন সে পৌঁছে গেল প্রিয়তমের ঠিকানার কাছাকাছি! এটাকে শাশ্ত্র বলেছে সালোক্য স্থিতি। ভক্ত ভগবৎ লোকে পৌঁছে গেছেতাই সালোক্য! এবার খুঁজে বের করা হোল প্রিয়তমের বাড়ি কি তার বাহার! কি নয়নমনোহর শোভা!স্বচ্ছ সরোবরের সৌন্দর্য বাগানের ফুল, ফল ইত্যাদির সৌন্দর্য অনেক কে আকৃষ্ট করলেও প্রকৃত ভক্ত এদিকে একবার দৃষ্টি দিলেও আকর্ষিত হয় না সে এগিয়ে যেতে চায় অন্দরমহলের দিকে! তারজন্য গার্ড বা রক্ষীদেরকে তুষ্ট করার কাজে সে তখন ব্যস্ত! প্রিয়তমের সমীপে বা নিকটে পৌঁছে গেছে তাই ভক্তিশাশ্ত্র এই অবস্থাকে বলেছে সামীপ্য।। এরপর ভক্তের কাতর প্রার্থনায় যখন সেই অধরা ধরা দেনতার কাছে নিজে এগিয়ে আসেন, ডেকে নিয়ে গিয়ে পাশে বসিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করেনতখন ভক্ত বিভোর হয়ে যায়, আনন্দ-বিহ্বল হয়ে পড়ে! সে এক অনির্বচনীয় অবস্থা !! ভক্তিশাশ্ত্র এই অবস্থাকে বর্ননা করেছে ‘সাযুজ্য’ হিসাবে। এখানে এসেও সাধক নিরাপদ নয় প্রতিপদে পা পিছলানোর সম্ভাবনা রয়েছে! প্রতিটি স্তরেই প্রাপ্তি রয়েছে সিদ্ধি!! এছাড়া রয়েছে আরো অন্য প্রলোভনের ফাঁদ!! বহু ভক্ত-সাধক তাদের নিজেদের চেতনার level অনুযায়ী এক একটা স্তরে আটকে পড়ে আর আগাতেই চায় না! পরে যখন হুঁশ ফেরে তখন তাকে আবার যাত্রা শুরু করতে হয়! কিন্তু কোন কোন ভক্ত অনন্যচিন্তার অধিকারী তার চলার পথের অগ্রগতি ব্যাহত হয় না,সে এগিয়েই চলে। ততক্ষণ চলে যতক্ষণ না তার ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হয়। তবে যে ‘প্রকৃত ভক্ত’সে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার রূপ দর্শন করে বা তাঁকে স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েও সন্তুষ্ট নয় সে আরো কিছু চায়, সেবক-বন্ধু – সখা হয়ে সর্বদা তাঁর কাছে কাছে, পাশে পাশে থাকতে চায় তারাই ভক্ত শ্রেষ্ঠ ভক্তকুলশিরোমনি!! সদা-সর্বদা সেই অরূপের অপরূপ রূপ দর্শন ও স্পর্শ করতে করতে ঐ ভক্তের নিজের রূপও পরিবর্তন হয়ে যায়! সেও তখন প্রভূর রূপ প্রাপ্ত হয়এটাই ‘সারূপ্য’-অবস্থা! বাউলেরা এই রূপ বর্ননায় বলেছে“সাধনায় সিদ্ধ হবি রূপে করবে টলমল টলমল রে… “। ঐরূপ ভক্তের তখন ত্রিশারীরিক রূপেরই পূনর্বিন্যাস ঘটে। ফলে সেই শরীরের সান্নিধ্যে সাধারণ মানুষ এলে মানুষ ভাবতে থাকে ‘ইনিই বোধহয় ভগবান’ , ‘ভগবানের অভিন্ন তনু’!! এরপরে শুধু বাকি থাকে, ভক্তের ভগবানের শরীরে লীন হওয়া! ভক্তের ভগবানত্ব লাভ হওয়া! এটাই ‘ভক্ত-ভগবানের মিলন’। যোগীরা বলেন ‘জীবাত্মা পরমাত্মার মিলন’, জ্ঞানীরা বলেন ‘ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মৈব ভবতি’।
তবে আমাদের কথা হচ্ছিল ভক্তিপথ নিয়ে। এই মার্গ ধরে রেখেছে বাউল বৈষ্ণবেরা। রাধাকৃষ্ণ লীলা কীর্তন যেখানেই অনুষ্ঠিত হোক না কেন সেখানে দেখা যায় সবার শেষে রাধাকৃষ্ণের মিলন দিয়ে পালাগান শেষ হয়। ভক্ত ভগবানের মিলন ই রাধাকৃষ্ণের মিলনযা ভক্তিপথের চূড়ান্ত লক্ষ্য, অন্তিম গন্তব্য! এই ভাবেই যেখান থেকে শুরু হয়েছিল জীবনের যাত্রা(ব্রহ্ম) সেখানে এসেই শেষ হয় জীবন নাটকের যবনিকা(ব্রহ্ম)!
“পূর্নমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎপূর্ণমুদচ্চতে
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণামেববশিষ্যতে”।।(ক্রমশঃ)