গুরুমহারাজের (স্বামী পরমানন্দ) ছোট ভাই গৌতমের অকাল প্রয়ানে মনটা খুবই বিষন্ন হয়ে আছে। তাই একটু গৌতমের কথা হোক। আমি যতটুকু দেখেছিলাম সেইটুকুই বলি। গুরু মহারাজের কথা বলতে গেলে শুধু গুরু মহারাজ-ই নয় , বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন , অন্যান্য আশ্রমগুলির শাখা , পরমানন্দ মিশনের সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারী , পরমানন্দ ভক্তমন্ডলী ইত্যাদির কথাও প্রায়ই আলোচনা করতে হয় । কিন্তু প্রায় একেবারেই আলোচনা হয় না গুরু মহারাজের পৈতৃক গৃহ এবং সেখানকার অধিবাসীদের কথা ! খুব অল্প পরিমাণে হয়তো গুরু মহারাজের গর্ভধারিণীর কথা এবং খুবই সামান্য পরিমাণে গুরু মহারাজের বাবার কথা আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু মোটেই গুরু মহারাজের বাকি family member-দের কথা বলা হয় না – তাই আমরা সাধারণ ভক্তরা গুরু মহারাজের family members-দের সম্বন্ধে খুব একটা জানি না ৷ এর একটা অন্য কারণও রয়েছে – গুরু মহারাজের family members-রা যে কারণেই হোক না কেন বনগ্রাম আশ্রমের সাথে খুব একটা যোগাযোগও রাখে না, তাই তাদের সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানি না ৷ কিন্তু এদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল গুরু মহারাজের পারিবারিক জীবনের ছোট ভাই ‘গৌতম’ ।
গৌতম বা গৌতম দাস মাত্র (কমবেশী) ৫০ বছর বয়সে গতকাল (১৬ই জানুয়ারী, ২০১৯) সকালের দিকে কলকাতায় P.G.Hospital-এ শরীর ছেড়েছেন ৷ বনগ্রাম আশ্রমের প্রেসিডেন্ট স্বামী পরমেশ্বরানন্দ অর্থাৎ তৃষাণ মহারাজ ওনাকে বেশ কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন । বেশ কয়েকবার গৌতমের অপারেশনও করাতে হয়েছিল । শেষটায় তৃষাণ মহারাজ (স্বামী পরমেশ্বরানন্দ) গৌতমকে কলকাতায় P.G.Hospital-এ ভর্ত্তি করিয়েছিলেন । ওখানকার ডাক্তাররা অবশ্য কোন আশা দেয়নি – ফলে যা হবার তাই হোল – গতকাল (১৬/০১/২০১৯) উনি পরমানন্দলোকে চলে গেলেন ৷
গুরু মহারাজের বাকি ভাইগুলির থেকে গৌতম আলাদা কেন সেই কথা বলি ৷ প্রথম কারণ হিসাবে বলা যায় _ছোটভাই হিসাবে গৌতমকে বাকি সব ভাই-বোনেদের ভালবাসার বা স্নেহের দৃষ্টিতে দেখাই স্বাভাবিক ! তাছাড়াও গুরু মহারাজের অন্যান্য ভাই-রা establishted হয়ে পৃথক পৃথক বাড়িতে থাকতে শুরু করার পর গর্ভধারিণী জননী নিভারানী দেবী ছোট ছেলে গৌতমকে নিয়েই থাকতেন। আর বরাবর গর্ভধারিনীর হাতখরচ বা অন্যান্য খরচের টাকা গুরুমহারাজ নিজে পাঠাতেনঅন্য কোন ভাইয়ের উপর যেন কোন চাপ না পড়ে, তাই এই ব্যবস্থা! এর ফলে প্রায় ছোট বয়স থেকেই গৌতম কে বনগ্রাম আশ্রমে আসা যাওয়া করতে হোত। এইজন্যই গৌতমও আশ্রমিকদের কাছে (বিশেষত তৃষাণ মহারাজ, মুরারী মহারাজ প্রমুখের কাছে ) পরিচিত হয়ে গিয়েছিল।এছাড়া মদন মহারাজ (স্বামী চিৎবিলাসানন্দ), উদয় মহারাজ (স্বামী স্বরূপানন্দ) ইত্যাদিরা গৌতমদের আত্মীয় অর্থাৎ পরিচিত হওয়ায় ওর বনগ্রাম আশ্রমে আসা যাওয়া করতে কোন অসুবিধা হোত না।
গুরুমহারাজ বিভিন্ন ভক্তদের আমন্ত্রণে কৃষ্ণদেবপুরও (গুরুজীর জন্মভূমি) যেতেন সেখানে মায়ের সাথে পুত্রের সাক্ষাৎ হোত! মাতা-পুত্রের এই অপার্থিব মিলন দৃশ্য আমি কখনো স্বচক্ষে দেখিনি তবে যারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাদের মুখে বর্ননা শুনেছি!! [অবশ্য যখন গুরুমহারাজ সকলকে নিয়ে পুরী(উড়িষ্যা) গিয়েছিলেন তখন গুরুমহারাজের মা জননী নিভারানীও গিয়েছিলেন। তখন মা-ছেলেকে একসাথে দেখেছিলাম। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মা কে মথুরবাবু কিছু দিতে চাইলে, মা বলেছিলেন “আমাকে এক পয়সার দোক্তা কিনে দিও। ” গুরুমহারাজের মা ও ছিলেন ঐরকমই সদাসন্তুষ্টচিত্ত! যারা তাঁর সেবা করার অধিকার পেয়েছিল, তাদের মুখে শুনেছি =গুরুমহারাজের মায়ের শরীর ননীর মতো নরম ছিল!] যাইহোক, কথা হচ্ছিল গৌতম কে নিয়ে গৌতম যে গর্ভধারিনীর কাছে সবসময় থাকতো, এতে গুরুমহারাজ ও অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকতেন। এরপর গৌতম B. A-পাশ করে গেল (কালনা কলেজে পড়ত, সম্ভবত ছাত্র পরিষদের নির্বাচিত মেম্বারও ছিল!), এবার তো কিছু রোজগারের ব্যবস্থা করতে হয়! সেই সময় গুরুমহারাজ, তৃষাণ মহারাজকে(স্বামী পরমেশ্বরানন্দ) দিয়ে দু-এক জায়গায় সরকারি চাকরির যোগাযোগ করেছিলেন। হাওড়া ষ্টেশন এর অফিসে Interview – ও হয়েছিল কিন্তু সে সব চাকরি হয় নি!
কিছুদিন সম্ভবত ওষুধের এজেন্সি বা ঐ ধরনের কিছু কাজ করেছিল গৌতম। এরপর আশ্রমের বিশিষ্ট ভক্ত কামারকুন্ডুর ডঃ হারাধন মান্নার নার্সিংহোমে চাকরি করতে চলে যায় গৌতম। বাড়িতে মা আবার একা! এইসময় মায়ের একাকীত্বের কথা ভেবেই, মায়ের কথায় গৌতমের বিবাহে মত দেন গুরুমহারাজ! গৌতমেরই পছন্দের মেয়ে কালনার পার্বতীর সাথে বিবাহ হয় গৌতমের। এই বিয়েতে গুরুমহারাজ বেশ আনন্দ পেয়েছিলেন বলেই মনে হয় কারণ বিয়ের পরে গৌতমরা যখন ‘জোড়ে’- গুরুমহারাজকে প্রনাম করতে এসেছিল তখন ওদেরকে গুরুমহারাজ আজিমগন্জ আশ্রমে আসতে বলেন (সেই সময় গুরুমহারাজ আজিমগন্জ আশ্রমে যাচ্ছিলেন)। নব বিবাহিত দম্পতি গুরুমহারাজের (ওদের দাদা! প্রথম প্রথম দেখতাম গৌতম – পার্বতী, গুরুমহারাজকে ‘দাদা ‘-ই বলত।) কথামতো আজিমগন্জ আশ্রমে যায়, ওখানে গুরুমহারাজ ওদেরকে খুব যত্ন করেছিলেন, পার্বতীকে কিছু সংসার বিষয়ে শিক্ষাও দিয়েছিলেন! এরপর উনি ওদেরকে নিজের গাড়ীতে চাপিয়ে কীরীটেশ্বরী মায়ের মন্দিরে নিয়ে গিয়ে পুজো দেওয়ান এবং রসবেরুলিয়া আশ্রমে নিয়ে যান।সেবারই রসবেরুলিয়া আশ্রমে আজিমগন্জের বিষ্ণুদা মারা যান। ওখানে ওরা দু-একদিন কাটিয়েছিল! তারপর ওদেরকে ফিরে যাওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা গুরুমহারাজ ই করে দিয়েছিলেন (সন্ন্যাসী শ্রেষ্ঠ ভগবান দাদার ছোট ভাইয়ের “হানিমুনে” – র সুন্দর ব্যাবস্থা!!)[ক্রমশঃ]