শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (কথিত ও লিখিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা এখন গুরুজীর *বাউলের মর্মকথা* গ্রন্থের উল্লেখিত ‘বাউল’-এর প্রকৃত সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা কি এবং বাউলজীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কি – এইসব আলোচনায় ছিলাম। এখন দ্যাখা যাক্ গুরুমহারাজ এরপরে আরো কি কি বলেছেন – ! উনি এবার প্রকৃত ধর্মাচরণ নিয়ে বলতে গিয়ে বললেন – ” মানুষকে বাদ দিয়ে ধর্মাচরণ নয়, মনুষ্যত্ব লাভ করেই তার ভিতর দিয়ে হয় ধর্মবোধ বা সহজ আত্মবোধ। মনুষ্যত্ব লাভ করাই মানবের প্রথম সাধনা। চরিত্র গঠন বা মনুষ্যত্বলাভ না হোলে আত্মতত্ত্বের বোধ হয় না। সেইজন্য প্রথম চরিত্র গঠন বা ‘মনুষ্যত্বলাভ’, তারপর ‘দেবত্ব’। আর দেবত্বে উপনীত হোলে আত্মতত্ত্ব সহজে বোধে বোধ হয়।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ (এর মধ্যে সংকলক নিজেও রয়েছে__অর্থাৎ নিজেই নিজেকেও বলছি) ! দেখলেন তো যুগপুরুষ কাকে বলে? কেমন সুন্দর করে এই যুগের (বর্তমানের) ধর্ম নিয়ে, ধর্মাচরণ নিয়ে যত ঝামেলা সমগ্র বিশ্বব্যাপী চলছে – তার সমাধান করে দিলেন ! কেমন সহজ করে বলে দিলেন – যে কোনো ধর্মমতের অবলম্বী-ই তুমি হও না কেন – ধর্মাচরণের প্রথম সাধনাই হোলো মনুষ্যত্ব লাভ ! সুতরাং মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃতঅর্থে ‘মানুষ’ না হয়ে উঠতে পারছে – ততক্ষণ তার সমস্ত প্রকারের ধর্মাচরণ বৃথা ! তাতে তুমি যতই তিলক কাটো, নামাবলী গায়ে দাও অথবা দাড়ি রাখো, টুপি মাথায় দাও বা মাথায় বড় বড় চৈতন্য (টিকি) রাখো – সবই ধর্মাচরণের নামে বৃথা কালক্ষয় করা আর এক একটা আলাদা আলাদা দল বা সম্প্রদায় সৃষ্টি করে বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়, যা মনুষ্যত্বের চরম অপমান ! মনুষ্য নামধারী পৃথিবীর সর্বোন্নত জীবটির এক কলঙ্কিত অধ্যায় !
যুগপুরুষ গুরুমহারাজ সমাজের তথা ধর্মজগতের এই চরম অবক্ষয় দেখেই কথাগুলো বললেন যে,” মনুষ্যত্ব লাভ করাই মানবের প্রথম সাধনা।” দেখুন, উনি কি কথাটা বললেন,__ ‘মানবের প্রথম সাধনা’– এখানে ‘মানব’ বলতে এই পৃথিবীগ্রহের সমগ্র মানব জাতির কথা বলেছেন উনি, কোন বিশেষ জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়কে specialise করেন নি ! ওনার কথায় কোনো সম্প্রদায়িকতা বা সংকীর্ণতার স্থান নাই – উনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের নিমিত্ত সকলকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলি বলেছেন। উনি নিজেই ছিলেন ‘বিশুদ্ধ বাউল’ বা বলা যায় ‘মহাবাউল’। তাই নিজে ‘বাউল’ হয়ে পৃথিবীর মানুষকে সহজ ভাষায় ‘বাউলতত্ত্ব’ বুঝিয়েছেন – যা আগামী পৃথিবীর ‘যুগধর্ম’ হোতে চলেছে। এমনিতেই এখন দেখা যাচ্ছে চারিদিকে বাউলদেরকে নিয়ে, বাউলগান নিয়ে যেন একটু বেশিরকম মাতামাতি চলছে। এবার যখন গুরুমহারাজের এই অত্যাধুনিক ‘বাউলতত্ত্ব’ সমাজের কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়বে, তখন একটা মহা জন-জাগরণের সৃষ্টি হবে ! সবাই যেন অন্ধকারের গভীর থেকে ঘুম ভেঙে চোখ মেলে চেয়ে – যেমন সূর্যালোকের শুভ্র কিরণে সবকিছু আবার নতুনভাবে, আরো পরিষ্কারভাবে দেখতে পায় – ঠিক তেমনি যুগপুরুষ গুরুমহারাজের এইসকল বাণী মানুষের বহুদিনকার অজ্ঞান-অন্ধকারে পড়ে থাকা অবস্থা থেকে অর্থাৎ সম্প্রদায় চেতনা-শ্রেণীচেতনা-গোষ্ঠীচেতনার level থেকে __এক ধাক্কায় উন্নীত করে ‘মনুষ্যত্ব চেতনা’য় এনে ফেলে দেবে। খন্ড-খন্ড চিন্তা থেকে অখণ্ডের চেতনায় আসতে সাহায্য করবে, দ্বৈত চেতনা–বহু চেতনা থেকে অদ্বৈত চেতনায় আসতে সাহায্য করবে। তখনই প্রকৃত অর্থে সকল মানুষের বোধগম্য হবে যে,” ঈশ্বর (আল্লা) এক ও অদ্বিতীয় !” এবং আমরা অর্থাৎ এই পৃথিবীগ্রহের সকল মানুষ সবাই সেই ‘এক’ হোতেই এসেছি – আবার যখনই আমাদের ‘আত্মবোধ’ হবে (যা মানবজীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য)– তখন আমরা সেই ‘একে’-ই ফিরে যাবো। সেই অর্থে আমরা এই পৃথিবী গ্রহের সকল মানুষই, পরস্পরে পরস্পরের আত্মার আত্মীয় ! এখানে ভেদভাব, বিরোধভাব, সম্প্রদায়ভাব, গোষ্ঠীভাবের কোনো স্থান নাই, যদি থাকে – তাহলে জানতে হবে তা নিছক আহাম্মকি এবং অজ্ঞান-প্রসূত !
গুরুমহারাজ বলেছেন – “মানবের প্রয়োজন চরিত্রগঠন ও মনুষ্যত্বলাভ।” মনুষ্যত্বলাভ হোলে তারপরে মানুষ ‘দেবত্ব’ স্থিতি অর্জন করতে পারে। সত্যিই তো – ‘মানুষ’ শরীর লাভ করেও যদি কোনো ব্যক্তি চরিত্রহীন হয় – তাহলে আর তার ‘মানুষ’ শরীর লাভের গৌরব কোথায়? ‘মানুষ’ হয়েও মনুষ্যেতর প্রাণীর ন্যায় তার আচরণ ! ফলে ঐরূপ ব্যক্তি সমাজে বা সংসারে চরম ঘৃণার পাত্র হয়েই বেঁচে থাকে – মানুষের শ্রদ্ধা-ভালবাসা কখনোই লাভ করতে পারে না। যাইহোক, আমরা দেখি এরপরে গুরুমহারাজ এই বিষয়ে আরো কি কি বলেছেন ! উনি বলেছেন – ” যাদের মনুষ্যত্ব লাভ হোলো না, তারা কেমন করে আত্মবোধে উপনীত হবে ? সেইজন্য বাউলগণ মনুষ‍্যত্বলাভের উপর বিশেষ জোর দিয়ে থাকেন। আর চরিত্র গঠন হোলেই মনুষ্যত্ব লাভ হয়। মনুষ্যত্ব লাভ হোলেই নিষ্কপট মানুষ ‘দেবত্বে’ উপনীত হ’ন। তখনই মানব সহজ হ’ন এবং তাঁর অন্তর বিকশিত হয়ে ওঠে আত্মজ্যোতিতে। তার মধ্যে বইতে থাকে দিব্যচেতনার চিন্তাপ্রবাহ – দিব্যভাবের প্রেমপ্রবাহ ও প্রবল কর্মপ্রবাহ। একাধারে দিব্যজ্ঞান ও অনন্ত প্রেমে প্রবল কর্মের মহাকল্লোল উঠতে থাকে। তিনি বিন্দুর ভিতর দিয়ে সিন্ধুর উল্লাস বোধ করেন।”
প্রিয় পাঠক – তাহলে বোঝা গেল প্রথমে চরিত্র গঠন হোলেই মনুষ্যত্বলাভ হবে এবং মনুষ্যত্বলাভ হবার পর মানুষকে নিষ্কপট হতে হবে__ তাহলেই সাধারণ মানব দেব-মানব স্থিতিতে পৌঁছাবে। মানব, দেবমানব-স্থিতিতে পৌঁছালে তবেই মানুষ ‘সহজ’ হোতে পারে। যে ‘সহজতা’ অর্জন-ই বাউল সাধনার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য – তা পূর্ণ হয় মানুষ যখন দেবত্বে উপনীত হয় তখন। কিন্তু এরপরে যে কথাগুলো গুরুমহারাজ বলেছেন সেগুলি আমাদের মাথার উপর দিয়ে চলে যাবার কথা – কারণ ঐ দিব্য অবস্থায় যাঁদের পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁরা ছাড়া ঐরূপ অবস্থার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব ! তবে আমরা এইটা বুঝতে পারলাম যে, সহজ অবস্থায় বাউল সাধকের মধ্যে দিব্যচেতনা-দিব্যপ্রেম এবং প্রবল কর্মপ্রবাহ বইতে থাকে। এগুলি সবই একসাথে হয়, ফলে তখন সেই সাধক বিন্দুতে সিন্ধুর উল্লাস বোধ করেন অর্থাৎ তার দেহভান্ডের মধ্যেই সেই অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বের প্রকাশ অনুভব করেন।৷