সময়:– 14 /4 __20/4, 1989
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:– কালনার জয়রাম, নগেন,আশ্রমের কয়েকজন মহারাজ এবং অন্যান্য ভক্তগণ।
জিজ্ঞাসু:– আজকাল ক্যালেন্ডার এ বা অন্যত্র _একই মূর্তিতে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ ও সারদা মায়ের ছবি দেখা যাচ্ছে; এটা কি কোন কল্পনা?
গুরু মহারাজ:–একই ফ্রেমে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মূখের আধখানা এবং বাকি আধখানা সারদা মায়ের মুখ_সূই ছবিটা বলছ তো? ওটা রামকিঙ্কর বেজের আঁকা ছবি। বাঁকুড়ার রামকিঙ্কর একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও স্থপতি ছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই উনি শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর সাহচর্যে আসেন। একবার একজন বিখ্যাত ফরাসি চিত্রশিল্পী এসেছিলেন বিশ্বকবির শান্তিনিকেতন পরিভ্রমনে! ড্রয়িং-এর ক্লাশে, ছাত্র রামকিঙ্করের তাৎক্ষণিক অংকনের প্রতিভা দেখে, শিক্ষক নন্দলাল বসুর কাছে_ ছেলেটির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে forecast করেছিলেন। এরপর থেকে নন্দলাল ওই ছেলেটির উপর বিশেষ নজর দিয়েছিলেন! তারপরের কথা তো সবার জানা!
পরবর্তীতে রামকিঙ্কর নিজেই একজন বিখ্যাত শিল্পী ও স্থপতি হয়ে ওঠেন এবং উনিও শান্তিনিকেতনের শিল্প কলা বিভাগের আচার্যপদে নিযুক্ত হন ।
তবে ওই মূর্তিটার কথা যেটা বলছ _ওইটা আঁকার পিছনে যে একটা ঘটনা ছিল সেটা বলছি শোনো ! রামকিঙ্কর তখন বালক _ওদের বাড়ি ছিল গন্ধেশ্বরী বা গাঁদাই নদীর তীরে একটি গ্রামে। নদীর ধারে এক সাধু বাবার একটি কুঠির ছিল, সেখানে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ ও সারদা মায়ের ফটো রাখা ছিল। ঐ আশ্রমে প্রত্যহ ওই ফটোগুলোকেই পুজো করা হতো বা ভোগ-আরতি-প্রার্থনা নিবেদন করা হতো । প্রতিদিন যাওয়া-আসার সুবাদে আশ্রমের সাধুবাবাটির সাথে রামকিঙ্করের একটা সম্বন্ধ তৈরি ও হয়ে গিয়েছিল ।তাছাড়া সে ছোট থেকেই ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ এবং সারদা মায়ের ভক্তও ছিল! সেই হিসাবে রামকিঙ্কর ওই আশ্রমে প্রায়ই যাওয়া-আসা করতো! একদিন বর্ষাকালে নদীতে প্রচন্ড বন্যা দেখা দিল _ বন্যার জল দু’কূল ছাপিয়ে গ্রামে ঢুকে গেল, চারিদিকে সামাল-সামাল রব_সবাই নিজের নিজের ঘরবাড়ি আর জিনিসপত্র সামলাতে ব্যস্ত! কিন্তু বালক রামকিঙ্করের মন চঞ্চল হল _নদীর ধারে আশ্রমটির কথা ভেবে! বন্যার তান্ডব কে অগ্রাহ্য করে জল ঠেলে ঠেলে রামকিঙ্কর যখন আশ্রমে পৌঁছাল _তখন সে দেখল যে, সাধুটি গ্রামের কোন নিরাপদআশ্রয়ে চলে গেছে, কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদার ফটো দুটি বেদীতে রয়ে গেছে! আশ্চর্যের কথা এটাই যে, তখনও ফটো দুটিতে জল স্পর্শ করেনি– কিন্তু ছুঁই-ছুঁই করছে! বালক রামকিঙ্কর তাড়াতাড়ি ফটো দুটিকে যত্ন করে তুলে নিল, তারপর সেগুলিকে মাথায় করে আবার জল ঠেলে ঠেলে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালো এবং নিরাপদ স্থানে ফটো দুটিকে রেখে দিল। এই ঘটনার পরে _ সেই রাত্রিতেই রামকিঙ্কর স্বপ্ন দেখল যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদা অভিন্ন মূর্তিতে তাঁকে আশীর্বাদ করছেন! পরবর্তীকালে ওই সপ্নে দেখা মূর্তিটির চিত্ররূপ দিয়েছিলেন রামকিঙ্কর _ যেটা হয়তো তুমি কোন স্থানে দেখেছো!
জিজ্ঞাসু:– গ্রহণের সময় খাওয়ার ব্যাপারে যে নিষেধ আছে এগুলি কুসংস্কার, না এর পিছনে কোন বিজ্ঞান আছে?
গুরু মহারাজ:– সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর অভিকর্ষ বল কমে যায় এবং তুলনায় মহাকর্ষ-বলের মান বেশি হয় । ফলে বিভিন্ন জীবাণু বা ভাইরাস যারা সাধারণত পৃথিবীর নিম্ন মন্ডলে থাকেনা, তারাও ওই সময় নিচে চলে আসে! এই জন্যই এই সময়ে খাদ্য গ্রহণ করা হয় না, এমনকি_ প্রস্তুত করা খাদ্য থাকলেও তা ফেলে দেবার কথা বলা হয় ! কিন্তু বর্তমানে রেফ্রিজারেটর আবিষ্কার হওয়ায়, লোকে ওতেই খাদ্য সংরক্ষণ করতে পারে ফেলার দরকার হয় না!
তবে, এই সমস্ত ব্যাপারগুলিকে কুসংস্কার মনে করো না_ এগুলি আধুনিক বিজ্ঞানও এখন স্বীকার করে! বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা গবেষণা এখন গ্রহণের সময় করা হয়! জীবন বিজ্ঞানের মিউটেশনের যে তত্ত্ব রয়েছে অর্থাৎ এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে উৎক্রমনের যে রহস্য _তা আজও বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা ! কিন্তু বিজ্ঞানীদের অনেকেই ধারণা করেন যে _ সূর্য বা চন্দ্রের পূর্ণগ্রহণ চলাকালীন সময়ে জনন-কার্যের ফলে অপত্য উৎপাদন হলে, তার জিনবিন্যাসের পরিবর্তন ঘটতে পারে! সেইজন্যেই দেখবে_গ্রহণকালীন সময়ে শুধু খাদ্যগ্রহণ নয়,শয়ন বা জনন ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও নিষেধ রয়েছে! এইসময় জননের ফলে, অপত্য সৃষ্টি হলে তার শারীরিক বা মানসিক বিকৃতি ঘটতে পারে! তাহলে বুঝতে পারলে তো পরম্পরাগতভাবে ভারতীয় শাস্ত্রাদিতে কেন খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি ব্যাপারগুলিতে গ্রহণের সময় বিধি-নিষেধ আরোপ করা আছে ! তাই কখনোই এগুলিকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়।
জিজ্ঞাসু:– আইনস্টাইনের বিখ্যাত e=mc` সূত্রটি বিজ্ঞান জগতে এত important কেন?
গুরু মহারাজ:– কারণ এই সূত্র আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানের অনেক অজানা তথ্য পাওয়া গেছে, আবার এই সূত্রের সাহায্যে অনেক অন্যান্য তত্ত্বের ব্যাখ্যা পাওয়াও সম্ভব হয়েছে! তাই বিজ্ঞানীদের কাছে এই সূত্রের এত কদর ! যে কোন সূত্রের সাহায্যে যত বেশি সংখ্যক তত্ত্বের ব্যাখ্যা করা যায় সেই সূত্র বিজ্ঞান জগতে তত বেশি উল্লেখযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। তুমি নিশ্চয়ই ‘বিজ্ঞানী’ এই শব্দ দিয়ে জড়-বিজ্ঞানীদের কথা বলতে চাইছো, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানী অর্থে _বিশেষ রূপে জ্ঞানী! সাধারণভাবে বোঝানো হয় _ কোন জ্ঞানী ব্যক্তি যে বিষয়ে,যে শাখায় গবেষণারত তিনি সেই শাখার বিজ্ঞানী যেমন জড়বিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী _তেমনি ধর্মবিষয়ে যিনি গবেষণা করছেন তিনি ধর্মবিজ্ঞানী,যিনি আত্মতত্ব অধিগত করার গবেষণায় রয়েছেন_তিনি অধ্যাত্মবিজ্ঞানী! ব্যাপারটা বুঝতে পারলে _ এরা সবাই নিজ নিজ শাখায় বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন, তাই এঁরা সকলেই বিজ্ঞানী! যাইহোক, সাধারণত জড়বিজ্ঞানীরা জগতে এমন এক তত্ত্বের খোঁজ পেতে চাইছেন _যার দ্বারা সমস্ত কিছুকে ব্যাখ্যা করা যায় ! প্রাচীনকালেরঅধ্যাত্মবিজ্ঞানীদেরও এটাই অন্বেষণ ছিল।সুতরাং দেখা যাচ্ছে সেই “এক”-এরই অন্বেষণ সকলেই করছে _শুধু আঙ্গিকের পার্থক্য!
কস্তুরী মৃগের শরীরে যখন কস্তুরীর সৃষ্টি হয়, তখন ওই মৃগটি সৌরভে মাতাল হয়ে চারিদিকে ছুটাছুটি করে আর গন্ধের উৎস খুঁজে বেড়ায়! কিন্তু সে বুঝতে পারে না যে সুগন্ধের উৎস তারই দেহের অভ্যন্তরে অবস্থিত! ঠিক তেমনি _এই দেহভান্ডেই “ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্ব” রয়েছে। ঋষিরা এই রহস্য বুঝতে পেরে বহির্জগতের রহস্য উদঘাটন করতে না চেয়ে নিজের অন্তর্জগতের রহস্য উদঘাটনে ব্রতী হয়েছিলেন এবং তাঁরা উপলব্ধি করলেন যে_জ্ঞানের দ্বারা, ধ্যানের দ্বারা এবং প্রেমের দ্বারা আত্নতত্বের বোধ হয়! বর্তমান বিজ্ঞানিরা _Quark theory এবং Grand unified theory দিয়ে মহাবিশ্বের আরও অনেক অজানা তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন _যেগুলি আইনস্টাইনের তত্ত্ব দিয়েও করা যায়নি! এইভাবেই বহির্জগতের এই অন্বেষণ চলতেই থাকবে _শেষ হবে না কোনদিন! মানুষের জানার আকাঙ্ক্ষা বা অন্বেষণ শেষ হয় তখনই _যখন “বোধে বোধ” হয়!
জিজ্ঞাসু:– বহির্জগতের উন্নতিরও তো সামাজিক মূল্য আছে মহারাজ !যেমন, মেডিকেল সায়েন্সের উন্নতি কত মানুষকে যন্ত্রণা ও অকাল মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি দিচ্ছে?
গুরু মহারাজ:–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! যে কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অথবা বিজ্ঞানের উন্নতি মানুষের কল্যাণের জন্যই তো সৃষ্টি হয়েছে! এক একজন বৈজ্ঞানিকের নিরলস সাধনার সিদ্ধি-ই তো হল _এক একটি আবিষ্কার! ফলে এগুলির সুফল আছে বই কি! কিন্তু পৃথিবী গ্রহের মানুষ এখনো ঠিক ঠিক মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি বলেই _ আবিস্কারগুলির সুফল অপেক্ষা অপপ্রয়োগের ফল বেশি পায় মানব সমাজ! দ্যাখো না, তুমি এখনি মেডিক্যাল সায়েন্স বা ঔষধের কথা বলছিলে _ কিন্তু এমন অনেক ওষুধ এই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে চালু রয়েছে, যেগুলি প্রথম বিশ্ব বহু আগেই ভয়ানক side effect-এর জন্য reject করেছে! কিন্তু আমাদের দেশের ডাক্তাররা সেগুলো এখনও prescribe করে যাচ্ছে _ এতে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি! ডাক্তাররা মানুষের কল্যাণ করার ব্রত নিয়ে_এই পেশাকে গ্রহণ করে কিন্তু মানুষকে না ভালোবেসে অর্থকে এত বেশি ভালবাসে _যে মানুষের কল্যাণ করাটা তাদের কাছে গৌণ হয়ে যায়! ডাক্তারের কাছে এমন অনেক রোগী আসে যাদেরকে হয়তো শুধু মৌখিক উপদেশ দিলেই রোগের উপশম হয়ে যায় কিন্তু তাতে বেশি টাকা নেওয়া যায় না, তাছাড়া প্রেসক্রিপশনে ওষুধ না লিখলে কমিশন পাওয়া যাবে না _তাই চোখ বন্ধ করে লম্বা প্রেসক্রিপশন করে বসে ডাক্তারেরা! এমনকি কয়েক সপ্তাহ পর আরো একবার আসার জন্য বলে দেয়! এই ভাবে রোগীকে নিয়ে ব্যবসা করে ডাক্তাররা _মানবকল্যাণ আর কোথায় করে? যদিও বা কেউ কেউ করে, তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য! তাই জানবে, মানুষ যতদিন না ঠিক ঠিক মানুষ হচ্ছে _ততদিন কল্যাণকর আবিস্কার সমুহ মানবের অকল্যাণ সাধনই বেশি করবে! এই ভাবেই পরমাণু শক্তির আবিষ্কার _পরমাণু বোমায় অথবা মহাকাশ গবেষণা _ star-war-এর মতো বিভীষিকায় রূপ নিয়েছে বা নিতে চলেছে! সেইজন্য আমি তোমাদের সকলকে বলছি যে, সভ্যতার পরিচয় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পরিসংখ্যানে নয়, এর পরিচয় নির্ভর করে সমাজে কত বেশি ভালো মানুষ আছে তার উপরে! তাই_তোমরা সবার আগে ভালো মানুষ হও, তারপর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিজ্ঞানী ইত্যাদি যা কিছু হও _আর কোন অসুবিধা হবেনা! কারো ভালো করতে না পারো তার ক্ষতি করো না, কাউকে কিছু দিতে না পারো _কারো কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নিও না, কাউকে সুখী করতে না পারো _কাউকে দুঃখ দিও না !
জিজ্ঞাসু:– সমাজে দেখা যায় কেউ দেখতে সুন্দর আবার কেউ অসুন্দর! এরূপ কেন হয় গুরুজী?
গুরু মহারাজ:– বল্ তো সুন্দর কে ? বলতে পারবি পারবি না_! জেনে রাখবি_ পুর্ণ-ই সুন্দর! আর পূর্ণের চোখে সবাই সুন্দর _সবই সুন্দর! বাকি সবই তো আংশিক! যে ব্যক্তির যেমন চেতনা, যেমন ভাব _তার তেমনি নজর! সুতরাং তোর চোখে কেউ সুন্দর হলেও অন্যের চোখে সেই অসুন্দর বলে বোধ হোতে পারে! দ্যাখ্ _ বেশিরভাগ মানুষই তো হয় চামার, না হয় কসাই! তোরা কোন মানুষের চামড়ার রংয়ের কতটা জৌলুশ অথবা তার শরীরের কোন অংশে কতটা মাংস, এই দিয়ে বিচার করিস _সে সুন্দর অথবা সুন্দরী কি না! এই দিয়ে কি সুন্দর-এর যথার্থতা বিচার হয় ?
সাধারণভাবে দেখা যায়_ ‘কিশোর বয়সে’-ই মানব শরীরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবচাইতে সৌন্দর্যের প্রকাশ বেশি ঘটে। যে কোনো কিশোর বা কিশোরী কে দেখলে এটা বোঝা যায়! এই সময় যে নিষ্পাপ-সরল-সহজ-সুন্দর রূপটি তাদের থাকে_ পরবর্তীকালে তেমনটি আর থাকেনা! এই জন্যই কৃষ্ণের বা রাধার চিত্রাঙ্কনে কিশোর কৃষ্ণকে অথবা কিশোরী রাধা বা রাইকিশোরীর রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভগবান কৃষ্ণ চির-কিশোর! কৃষ্ণ পূর্ণ তাই কৃষ্ণ সুন্দর_ চির কিশোর _চির সুন্দর!
জিজ্ঞাসু:– তাহলে ফর্সা- কালো রঙের উপর “সুন্দর” নির্ভর করে না?
গুরু মহারাজ:– ওই তো বললাম_ যারা চামড়ার রঙ নিয়ে বিচার করে_তারা চামার! কারো গায়ের রঙ কালো হলে সে অসুন্দর হয় _এটা কি করে ভাবলি ? কৃষ্ণ কালো_কালী কালো, হাজার নর-নারীর গায়ের রঙ কালো হওয়া সত্ত্বেও তারা কত সুন্দর _তোদের দেখার চোখ নাই বলে কালো কে অসুন্দর ভাবিস!
“ফর্সা” কথাটা এসেছে ফারসি শব্দ থেকে এর অর্থ ‘শুভ্র’! গ্রীক ইত্যাদি ইউরোপিয়ানরা সাদা চামড়ার লোক অর্থাৎ শুভ্র ! ওরা এদেশীয়দেরকে কালো বলে একটু ঘৃণার ভাব দেখাতো। সেটাই পরবর্তী কালে উচ্চবর্ণের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এইভাবে ভারতবর্ষে বিদেশিরা আসার পর থেকেই ভারতবাসীদের মধ্যেও ফর্সা অর্থাৎ সাদা চামড়ার উপর একটা দুর্বলতা জন্মায়। কয়েক প্রজন্ম আগেও পুরুষদের কালো মেয়ে বিয়ে করার ব্যাপারে কোনো বাছবিচার ছিল না কিন্তু এখন কোন পিতা মাতার মেয়ের গায়ের কালো রঙ নিয়ে জন্মালে তো, সেই মেয়েকে কি করে পাত্রস্থ করবে_ সেই চিন্তায় বাবা-মায়ের রাতের ঘুম চলে যায় !
দ্যাখো,কালো-ফর্সা এগুলো মানুষের সেন্টিমেন্ট! গোটা পৃথিবীতে এই সেন্টিমেন্ট নিয়ে নানান ঝামেলা, অত্যাচার, অনাচার, মারামারি চলছে! এসবের হাত থেকে যত তাড়াতাড়ি মানুষের মন মুক্ত হয়, ততই সমাজের এবং পৃথিবীর মঙ্গল।
জিজ্ঞাসু:– কথায় আছে_ ‘ভয় পেলে মানুষ বাপের নাম ভুলে যায়’_ এটা বলার কারণ কি?
গুরু মহারাজ:– প্রচন্ড ভয় পেলে, সেই মুহূর্তে মানুষের মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করে না! ফলে ঐরকম অবস্থায়_ হয় ঐ ভয় পাওয়া ব্যক্তিটির কথাবার্তা বেরোতেই চায়না_ গলা শুকিয়ে যায় নয়তো মিহি সুরে কথা বলে, তাই এরকম বলা হয়! তাছাড়া এই কথা বলার আর একটাও দিকও আছে, সেটাই বলছি শোনো! সাধারণত মানুষ উত্তরাধিকারসূত্রে দেহের বৈশিষ্ট্য লাভ করে_ পুরুষের গলার স্বর বাপের মত হয় অর্থাৎ পুরুষালী_ কিন্তু প্রচন্ড ভয় পেলে দেখা যায় মানুষের গলার স্বর মেয়েলী হয়ে যায়! ফলে সে তখনমিউ-মিউ করে কথা বলে!
এই ব্যাপারটা পশুদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়_এমনিতে কুকুর লেজ তুলে ঘেউ ঘেউ করে ডাকে, কিন্তু প্রচন্ড ভয় পেলে কুকুর,লেজ গুটিয়ে শিয়ালের মতো মুখ খুলে উ-উ-করে ডাকে। এ ক্ষেত্রে যেটা হয় সেটা হল কুকুর আসলে নেকড়ে ও শেয়ালের সংকর প্রজাতি! সাধারণ অবস্থায় কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, কিন্তু ভয় পেলে তার ডাক শেয়ালের মতো হয়ে যায়! এই ভাবে দেখা যায়_পুরুষ প্রানীরা ভয় পেলে তার পুরুষালি বৈশিষ্ট্য হারিয়ে বসে! সেই অর্থেও “ভয় পেলে বাপের নাম ভোলা”-র কথা বলা হয়!
ভয় পাওয়ার সঙ্গে আরও একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়_সেটা হোল, ভয় পেলে নারীর কণ্ঠস্বর মোটা হয়ে যায়, অর্থাৎ পুরুষের মতো হয়ে যায়!পাখিরাও বিপদের সময় ভয়ে নিজেদের ডাক ভুলে ভয়ার্ত কন্ঠে মোটা গলায় ক্যাঁ-ক্যাঁ করে ওঠে! এইসব নানারকম কান্ড দেখেই মানুষ ওই কথা বলে থাকে।
জিজ্ঞাসু:– শুক-সারি পাখি সত্যিই আছে না কাল্পনিক কোন কিছু?
গুরু মহারাজ:– হ্যাঁ, শুক-সারী পাখি বই কি!শালিকেরই এক প্রজাতির পুরুষ পাখিকে শুক এবং নারী পাখিরা সারী। শালিক পাখিরা ‘হরবোলা”-র ন্যায় বিভিন্ন পাখির ডাক অনুকরণ করতে পারে। ফলে এরা এদের নিজস্ব ডাক ছাড়াও অন্যান্য পাখির ডাক নকল করে ডেকে থাকে! তবে পাখিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়_ পুরুষ পাখিরাই সাধারণত আকারে বড় হয়, দেখতেও সুন্দর হয় এবং সুরেলা কন্ঠে ডাকে বা গান গায়_ স্ত্রী পাখিরা অতটা সুন্দর হয় না, আর অতটা সুন্দর গান গাইতেও পারে না।
জিজ্ঞাসু :– সমাজে অনেক বড় বড় সাধুসন্ত আছেন, যাঁরা নিজেদেরকে ভগবান বলে,প্রচার করেন। তাঁরা যা বলেন তা কি ঠিক?
গুরু মহারাজ:–দ্যাখো, এই জগৎ-সংসারের সবকিছুই তো সেই ব।রহ্মেরই প্রকাশ! সেই অর্থে_ সকল মানুষের মধ্যেই সেই “তিনি”-ই বিরাজমান! তবে আধার বিশেষে প্রকাশের তারতম্য হয়_এই যা! আর “ভগবান” বলতে তাঁকেই বোঝানো হয়, যখন সেই অখণ্ড সত্তা ভোগায়তন শরীর ধারণ করে, ধরণীতে অবতীর্ণ হন!এই অর্থে _ভগবান রাম, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ!
তবে সেই অখন্ড সত্তার অবতরনের জন্য যে সবসময় মানুষ-শরীরেরই প্রয়োজন হয় তা নয়_ যে কোন শরীরেই ভগবান লীলা করতে পারেন_ সেটা মানুষ হলেও হতে পারে অথবা মনুষ্যেতর শরীরে ! তবে কেউ যদি নিজেকে ভগবান বলে তাহলে তোর অসুবিধাটাই বা কোথায় ? তার যা ইচ্ছা বলুক না_ তবে জানবি, সর্ব অবস্থায় যিনি নিজেকে “ভগবান” বলে জানেন _তিনিই ভগবান! বহু সাধক সাধনার একটা পর্যায়ে পৌঁছে, কিছু শক্তিলাভ করে এইরকমটা ভাবে বা প্রচার করে _ কিন্তু তার জীবনে যখন সংকটকাল উপস্থিত হয়, তখন তার মধ্যে আর ভগবান-বোধ থাকে না, মনুষ্য-বোধ কাজ করে! আর এমনটা হলেই সাধারণ মানুষের কাছে তার চালাকি ধরা পড়ে যায়!
স্বামী বিবেকানন্দ এইজন্যেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে পরীক্ষা করার জন্য, তাঁর মৃত্যুশয্যায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন_”বলো তুমি কে?” তখন ঠাকুর কি উত্তর দিয়েছিলেন_ সেটা তো তোরা জানিস! তাহলে বুঝতে পারছিস তো _যিনি ভগবান তিনি সর্বাবস্থাতেই জানেন যে, “তিনি ভগবান”!
কিন্তু তোদের মধ্যে অত সংশয়-ই বা কেন কাজ করে? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন _”অদ্বৈত জ্ঞানআঁচলে বেঁধে যেখানে যাবি যা!” এটাই আত্মরক্ষার কবচ! সে যত উন্নত ব্যক্তিই হোক না কেন _তুই-ই বা কম কিসে? স্বরূপতঃ তুই তো সেই! তাহলে তোর স্বরূপের সন্ধানে যিনি তোকে সাহায্য করতে পারেন তিনিই তোর হিতৈষী। তুই তাঁর কাছেই যাবি, তাঁর কথা শুনে জীবন পথে হাঁটবি _ দেখবি বিবেকের জাগরণ এবং চেতনার উত্তরণ ঘটতে দেরি হবে না। অন্য কোথায় কার কি হলো, কে কি করলো তা জেনে তোর লাভ কি?