সময়:– 1989
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:– নগেন, স্বরূপানন্দ মহারাজ প্রমুখেরা এবং বহিরাগত ভক্তগণ।
জিজ্ঞাসু:– বই পড়েই কি সমস্ত প্রকারের জ্ঞানলাভ করা সম্ভব ?
গুরু মহারাজ:– তা কি করে হবে? জগতের জ্ঞানভান্ডার তো অনন্ত_ কোন একটা ব্যক্তি-জীবনে সেই অনন্ত জ্ঞানভান্ডারের সবকিছু কি বই পড়ে পাওয়া যায়? একজন বিজ্ঞানী সারা জীবন একটা বিশেষ শাখায় পড়াশোনা কোরে বা গবেষণা কোরে হয়তো সেই বিশেষ শাখাটির কিছুটা জ্ঞানলাভ করতে পারেন এবং তিনি কিছু নতুন থিওরি মানুষকে জানাতে পারেন! কিন্তু বলোতো_ এরকম কত শাখা, কত বিজ্ঞানী, কত গ্রন্থ রয়েছে_ সেগুলো কি একটা মানুষের পক্ষে এক জীবনে সমস্ত পড়া বা বোঝা সম্ভব হয়? কখনোই হবেনা! বিজ্ঞানী নিউটন যখন এই রহস্য বুঝতে পেরেছিলেন, তখন বলেছিলেন_ “জ্ঞান-সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আমি শুধু নুড়িপাথর কুড়োচ্ছি মাত্র”! তাছাড়া দ্যাখো, সমস্ত বিদ্যা, সমস্ত বিষয়ের জ্ঞান_ কি কখনো লিপিবদ্ধ করা যায় নাকি? কথায় রয়েছে_ “বেদ-বেদান্ত, যার না পায় অন্ত”,এই জ্ঞানটা তো গ্রন্থের বাইরে! সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, জগত-জ্ঞান বা অপরাজ্ঞান-ই যদি গ্রন্থ অধ্যয়ন করে জানা সম্ভব না হয়, তাহলে ঈশ্বর-জ্ঞান বা পরাজ্ঞান কি করে বই পড়ে জানা সম্ভব হবে? কারণ পরাজ্ঞানের শিক্ষালাভ হয় গুরুপরম্পরায়_এর কোন পুস্তকই হয়না! তাই বলা হয় অধ্যাত্মতত্ব জানার একমাত্র রাস্তা_ quest বা খোঁজ! আত্মতত্ত্বের বোধ হোলে এই বোধের উদয় হয় । এইসব বিচার হাজার হাজার বছর আগে ভারতীয় ঋষিরা করেছিলেন, তারপর তারা সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, বহির্মুখীনতায় প্রকৃতজ্ঞান বা পরাজ্ঞান লাভ হয়না! অন্তর্মুখীনতাই জ্ঞান লাভের প্রকৃষ্ট পন্থা! এই প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে_ সেটা তোমাদের বলছি শোনো!
আমি ছোটবেলায় একবার ঘুরতে ঘুরতে রাজগীর হয়ে নালন্দা এসে পৌঁছেছিলাম। তখন আমি ছিলাম কর-পাত্রী অর্থাৎ আমার সঙ্গে কোন ঝোলা, থালা এসব কিছুই ছিল না_ ‘কর’ অর্থাৎ হাত পেতে যেটুকু খাদ্য পেতাম_ তাই গ্রহণ করতাম, রাস্তায় কোন জলাশয় অথবা ঝরনার জল হাত পেতে ধরে পান করতাম,আর শুধু পথ চলা, চলা আর চলা__ এই ছিল জীবন!
যাইহোক, নালন্দার ধ্বংসস্তুপের কাছে গিয়ে মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। ভাবলাম এখানে একদিন কত দেশী-বিদেশী ছাত্ররা জ্ঞান লাভের জন্য আসতো, কত জ্ঞানী আচার্যরা তাদের অর্জিত জ্ঞানরাশি ছাত্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। কত বিদ্যাচর্চা কত তর্ক-মীমাংসা এই স্থানকে একদিন জমজমাট করে রাখতো! কিন্তু কালের নিয়মে আজ এটি একটি পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে_ মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল! ওখান থেকে উঠে সোজা হাঁটা লাগালাম বুদ্ধগয়া এবং গয়ার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় সাত দিন কেটে গেল_ এই সময়ের মধ্যে আমার তেমন কোন আহারও জোটে নি। এইভাবে একদিন দুপুরবেলায় এসে বুদ্ধগয়ায় পৌছালাম। বোধিবৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে ভগবান বুদ্ধের করূনা, প্রেম, অহিংসা, প্রজ্ঞার কথা স্মরণ করে_ক্ষুধার্ত,ক্লান্ত শরীরটা অনেক শীতল হলো। একটু দূরে নির্জন স্থানে একটি গাছের নিচে বসে বসে বুদ্ধের ঐ কথাগুলি ভাবতে ভাবতেই মনটা অন্তর্মুখী হয়ে গেল! শরীরের বোধ ছিল, ইন্দ্রিয়েরও কাজ চলছিল_ কেননা চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম দূরে রাখাল ছেলেরা গরু চরাচ্ছে, গাছটিতে কোকিল বেশ মধুর স্বরে ডাকছে__ অথচ কেমন যেন একটা আবেশ, যা আমাকে নড়তে দিচ্ছিল না! আমার খুব ভালো লাগছিল সেই আবেশ অবস্থাটা! হঠাৎ আমার কানের কাছে কে যেন বলে উঠল_ “ধ্যান করো_ ধ্যান করো_ ধ্যান করো”! আমি চমকে উঠলাম_এই নির্জন গ্রীষ্মের দুপুরে কে এলো হঠাৎ? চোখ মেলে চেয়েও কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু খানিক পরেই আবার সেই আওয়াজ আসতে লাগলো _”ধ্যান করো, ধ্যান করো, ধ্যান করো!”সেই অদ্ভুত আওয়াজে আমার মধ্যে আবারো আবেশ জাগলো _ চোখ বুজে এল! সেই অবস্থায় নির্দেশ এলো, _ “দূরের দৃশ্যাবলী দেখোনা, ওতে ‘মারে’র(বৌদ্ধদর্শনে অধ্যাত্মপথের অন্তরায়কে বলা হয় _”মার”!) হাত আছে _শুধু ধ্যান করো! পাখির সুমিষ্ট গান শুনোনা, ওটা আপাত মধুর _ওতেও ‘মারে’র প্রলোভন রয়েছে , তুমি ধ্যান করো”! বুঝতে পারছিলাম ওখানকার মাটি -আকাশ-বাতাস এই কথাগুলো বলছে! সেই নির্দেশ অনুসরণ করে আমি গভীর ধ্যানে ডুবে গেলাম! তারপর যখন সম্বিত ফিরে এলো, তখন গভীর রাত্রি। শরীরে ও মনে অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম _বুদ্ধের আদর্শ ও তার শিক্ষার “সার” আমার উপলব্ধি হলো! আমি এটাও বুঝতে পারলাম যে, শুধু ভগবান বুদ্ধ-ই নয়, এককালে আরো অনেক উন্নত শ্রমনগন ওখানে সাধনা করতেন এবং তাঁদের সুউচ্চ আধ্যাত্মিক ভাবপুঞ্জ, এখনো সেখানে বিদ্যমান _আর সেই ভাবরাশির প্রভাবেই আমার এই রূপ অবস্থা প্রাপ্ত হোল! আমার বোধ হল _”জীবন সত্য, মৃত্যু সত্য,কাল সত্য!”
এবার ওখান থেকে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলাম, পরের দিন দুপুরে এসে পৌঁছলাম গয়ায়। ভাবলাম গদাধরের পাদপদ্ম একবার দর্শন করে যাই, কিন্তু ততক্ষণে মন্দির বন্ধ হয়ে গেছে, পান্ডারা কিছুতেই ভিতরে ঢুকতে দিল না। মনটা বিষন্ন হয়ে গেল, ফিরে এসে ফল্গু নদীর ধারে নির্জন স্থান দেখেএকটা গাছের তলায় এসে বসলাম। ভাবতে শুরু করলাম_ ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকে মুনি-ঋষিদের শিক্ষা, বেদ-বেদান্তের শিক্ষা কি এটাই যে, দেবতাকে বিভিন্ন নিয়মে বাঁধতে চায়? নাকি_ এসব পরবর্তীকালে পাণ্ডাদের সৃষ্টি করা নিয়ম? আমার অন্তঃকরণে চিন্তন এবং বিচার শুরু হয়ে গেল! এখানেও চোখে পড়ছিল_ সেই দূরে রাখাল ছেলে গরু চরাচ্ছে, একটা কোকিলও সেই সময় ওই গাছে বসে গান গাইতে শুরু করল_ আর এসবেরর মধ্যেই আমার চেতনা অন্তর্মুখী হতে শুরু করল! এখানেও হঠাৎ_ মাটি থেকে, বাতাস থেকে, আকাশ থেকে আমার কানের কাছে আওয়াজ ভেসে এলো_ “বিচার করো, বিচার করো, বিচার করো!” তাকিয়ে দেখলাম কেউ কোথাও নেই– অথচ এত কাছের আওয়াজ যেন মনে হচ্ছিল_ আমার অন্তর্জগতেরই অনুরণন।
এখানেও শুনতে পাচ্ছিলাম নির্দেশ_ “প্রকৃতির সুন্দর দৃশ্যাবলী দেখো_ ওগুলি ব্রহ্মের প্রকাশ! দৃষ্টিকে রুদ্ধ কোরোনা_ বিচার করো! পাখির মধুর সংগীত শোনো, শ্রবণশক্তি কে বদ্ধ কোরোনা_ কিন্তু বিচার করো! শব্দ ব্রহ্মেরই প্রকাশ!”এইভাবে বিচার করতে করতে গভীরতায় ডুবে গেলাম, আর বোধ হতে লাগল যে, জগতের রূপ- রস- শব্দ -গন্ধ- স্পর্শ সবকিছুই ব্রহ্মময়! সবকিছুই ব্রহ্মেরই প্রকাশ_ “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”! এইভাবে বহুক্ষণ পরে যখন বহির্জগতের চেতনা ফিরে এলো, তখন অনেক রাত্রি হয়ে গেছে। ফলে গদাধরের মূর্তি আর আমার দর্শন করা হলো না_ কিন্তু বেদান্তের জ্ঞান সমূহের বোধ হোল।
জানো__বৌদ্ধ দর্শন এবং বেদান্ত দর্শনের উপলব্ধিগত পার্থক্য এটাই। বৌদ্ধ দর্শন বলেছে_ মানবজীবনে বিভিন্ন ‘এষনা'(কামনা-বাসনাদি) থেকেই চিত্তবৈকল্য ঘটে, এটাই চিত্তধর্ম_ এবং এই জন্যই হয় জন্মান্তর! এখানে আত্মার কোন ভূমিকা নেই_ চিত্তধর্মই জন্মান্তরের জন্য দায়ী। আর যেহেতু বুদ্ধত্ব অর্থাৎ নির্বান লাভ হলে চিত্তধর্মের অবলুপ্তি ঘটে, অতএব নির্বানলাভই _মনুষ্য জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। বহির্জগতের যা কিছু, সে সবই শুন্য_এগুলি ‘মারে’র প্রলোভন, এগুলিতে চিত্তবৈকল্য ঘটে। সুতরাং বহির্মুখীনতা ত্যাগ করো_অন্তর্মুখী হও_আত্মমগ্ন হও,এটাই বৌদ্ধধর্মের চূড়ান্ত শিক্ষা!
আর বেদান্ত দর্শনের সারকথা হোল, পরাজ্ঞান লাভ। বেদান্ত দর্শন বলছে_ কাউকে ত্যাগ করো না, অবহেলা করোনা_ কারণ সবই ব্রহ্ম, সবকিছুই ব্রহ্মের প্রকাশ! শুধু বিচারের দ্বারা সিদ্ধান্ত করো যে, বহির্জগতের যা কিছু_ তাও ব্রহ্ম, অন্তর্জগতের যা কিছু_তাও ব্রহ্ম! “তেন তক্তেন ভূন্জিথা”_ ত্যাগের দ্বারা ভোগ করো!
যাইহোক, এবার তোমার জিজ্ঞাসার উত্তরে ফিরে আসি! আমার জীবনে অল্প সময়ের ব্যবধানে, এই যে দুটি মহান দর্শনের “সার”-এর বোধ হল, এটা কি বই পড়ে সম্ভব হতো! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “ঈশ্বর শুদ্ধ মনের গোচর”! তাই শুদ্ধমন নিয়ে অন্তর্মুখী হও_ তোমারও অন্তর্জগতে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটবে।
জিজ্ঞাসু:–এই জ্ঞান যারা লাভ করেন তারা জগতে কি সাধারণ মানুষের মতোই থাকেন?
গুরু মহারাজ:–জগতের সকল রহস্যই তাঁদের কাছে উন্মোচিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় তাঁরা বালকবৎ,জড়বৎ, পিশাচবৎ,উন্মাদবৎ ইত্যাদি নানাভাবে থাকতে পারেন। আবার অনেকে আচার্য ভাবেও থাকেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন_ “যেন যাত্রার আগে সাজঘর বা গ্রীন রুম ঘুরে এসে, যাত্রা দেখতে বসা। কে– কি অভিনয় করবে, সব আগে থাকতেই জানা।” আমি এখনই তোমাদেরকে আগামী পৃথিবীর পঞ্চাশ হাজার বছরের ঘটনাসমূহ কি ঘটবে_ তা বলে দিতে পারি_ পৃথিবীর কিরূপ পরিবর্তন ঘটবে, কোথায় কোন্ অবতারপুরুষ জন্মগ্রহণ করবেন, তাঁর নাম কি হবে_ কার্যাবলী কি হবে সবকিছুই বলা যায়।
প্লাশ ওয়ার্ল্ডের এমন অনেক মহাত্মা রয়েছেন,যাঁরা শুধু ভগবানের লীলা সহচর হবার জন্য জন্মগ্রহণকরেন_আবার এমনও রয়েছেন, যাঁরা বিশেষ লীলায় অংশগ্রহণ করেন, কেউ কেউ লীলা সহচর হতেই চান না_ কারণ তারা হয়তো পূর্বে পূর্বে বহুবার লীলা সহচর হয়েছেন_ তাই আর সেই ইচ্ছাটাও নেই! এঁদেরকে বলা হয় জ্ঞান-বৃদ্ধ! একটা উদাহরণ দিয়ে তোমাদের ব্যাপারটাকে বোঝাই_ধরো, কোন গ্রামে যাত্রা হচ্ছে । যাত্রার এখনো দেরী আছে দেখে অনেকে ঘুমিয়ে পড়ে এবং তার পাশের জনকে বলে দেয় যে, যখন যাত্রাপালায় ‘যুদ্ধ’ হবে, তখন যেন তাকে ডেকে দেয়! সেইরকম_ ভগবানের লীলা চলাকালীন কোন বিশেষ সময়ে এঁরা শরীরধারণ কোরে সেই লীলাটুকুই দর্শন করে বা অংশগ্রহণ করে! আর জ্ঞান-বৃদ্ধদের কথা যেটা বলা হচ্ছিল_ তারা যেন বাড়ির দাদু! গ্রামে যাত্রা হবে বলে বাড়ির ছোট ছোট নাতিরা খুব আনন্দ করছে, ছুটে ছুটে যাত্রাতলায় একবার করে যাচ্ছে_ আর বাড়িতে এসে দাদুকে সব রিপোর্ট করছে_ কখন যাত্রাদলের লোক এসে পৌঁছেছে_ কতজন এসেছে_ কটা বাক্স এনেছে ইত্যাদি! সন্ধ্যাবেলায় যাত্রা শুরুর আগে, নাতি _দাদুকে ডাকতে এসেছে, “দাদু! সবাই যাচ্ছে, চলো যাত্রা শুনে আসি”! দাদু উত্তর দেয় _”ভাই! ওসব তোমরা দেখোগে যাও। আমি ওইরকম যাত্রা অনেক দেখেছি।”
তাহলেই বোঝো এঁদের স্থিতি কতটা উচ্চে! ভগবানের লীলা সহচর হয়ে জন্মানোর ইচ্ছাটুকুও নাই_ যে অবস্থায় আছেন, সেই রকমই শান্ত সমাহিত হয়ে থাকতে চান!
সাধারণ মানুষ কি কখনো এই ধরনের মহাপুরুষদের বা প্রকৃত জ্ঞানীদের চিনতে পারে? আর তারা চেনা দেবেন ই বা কেন? হিমালয়ের গিরি- গুহা- অরণ্যে হাজার হাজার উন্নত অবস্থার জ্ঞানী এবং যোগীরা আছেন_ যাদের সন্ধান সাধারণ মানুষ কখনোই পাবে না! তাঁদের অষ্টসিদ্ধি করায়ত্ত, তাই তাঁরা অনিমা-লঘিমা ইত্যাদি বিভিন্ন সিদ্ধি প্রয়োগ করে কোথাও ‘অনুবৎ’ হয়ে কোথাও ‘লঘুবৎ’ হয়ে থেকে যান, পাশ দিয়ে হাজার লোকজন চলে গেলেও তাঁদের সন্ধান করতে পারে না! স্বামী বিবেকানন্দ হিমালয় ঘোরার সময় একবার এইরকম যোগীকে একটি গাছতলায় দেখেছিলেন। এমনিতে যাঁর কোনো স্থুলশরীর দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু স্বামীজির সামনে ধীরে ধীরে তিনি প্রকটিত হয়েছিলেন!
বাবাজী মহারাজের কথা_ যোগী শ্যামাচরণ লাহিড়ী যদি না বলতেন তাহলে কজন মানুষ জানতো যে, পাঁচ হাজার বছরের শরীরধারী কোন যোগী এখনও ক্রিয়াশীল রয়েছেন! বিভিন্ন সিদ্ধি প্রয়োগ করে যোগীরা যে কতকাল ধরে বিভিন্ন অবস্থায় থাকেন, তার কি ঠিক আছে? কিন্তু যে ভাবেই তাঁরা থাকুন না কেন, আর যেখানেই থাকুন না কেন_ তাঁদের দ্বারা জগতের কল্যান সর্বদাই হয়ে চলেছে!
জিজ্ঞাসু:–কোন মহাপুরুষের যদি complete manifestation(পূর্ণত্ব)হয় তাহলে কি তাঁর দ্বারা এই জগতের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধন হয়?
গুরু মহারাজ:–তাই কখনো হয় নাকি? এই দ্যাখো না, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভগবান বুদ্ধের তো complete manifestation হয়েছিল_ কিন্তু তাতে কি জগৎ থেকে দুর্নীতি_ দুরাচার বন্ধ হয়েছে? _তাতো হয়নি! সাধারণত দেখা যায় _কোন মহাপুরুষের মৃত্যুর পর, তিন প্রজন্ম পর্যন্ত আধ্যাত্মিক পরম্পরা ঠিকঠাক বজায় থাকে। এরপরে তার মধ্যে ধীরে ধীরে অবক্ষয় এসে যায়। ফলে ওই তিন প্রজন্ম পর্যন্ত যাঁরা থাকেন, তাঁদের দ্বারা জগতের কল্যাণ বা মানুষের কল্যাণ নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু তারপরে যখন থেকে অবক্ষয় শুরু হয় _তখন শুধু মতবাদটা পড়ে থাকে, আর সেইটা নিয়ে অনুগামীদের মধ্যে শুরু হয় দলাদলি, মতানৈক্য ইত্যাদি। এর ফলে আধ্যাত্মিকতার মূল স্রোত থেকে বিচ্যুত হয়ে বহুদূরে সরে যায় তারা। তবে এইরকমভাবে যখনই ধর্মজগতে গ্লানি এসে যায়, তখনই ভগবান আবার অবতীর্ণ হয়ে যুগোপযোগী নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করে যান _ধর্মাচরণের নতুন বিধান দিয়ে যান! যারা সেই সময় তাঁকে গ্রহণ করেন, তারা ধন্য হয়ে যায়, আর পুরাতনপন্থীরা, গোঁড়াপন্থীরা তাঁকে গ্রহণ করতে না পেরে পিছিয়ে পড়ে। এই ভাবেই চলছে!
তবে, একটা মতবাদ নিয়ে তো জগত সংসার চলতে পারে না! তাই যেমন ভিন্ন ভিন্ন রোগের জন্য আলাদা আলাদা প্রেসক্রিপশন _তেমনি এক্ষেত্রেও ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতার মানুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে! এই জগৎ হলো মহামায়ার জগৎ। তাই মহামায়া যে খেলা পেতে রেখেছেন, সে খেলা যেন নাভাঙে _সেদিকেও মহাপুরুষদের লক্ষ্য রাখতে হয়! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন মুদির দোকানে ইঁদুরের হাত থেকে চাল, ছোলার বস্তা বাঁচানোর জন্য একটা থালায় মুড়ি-মুড়কি মিঠাই রাখতে হয় ! ইঁদুর বাবাজি সেইগুলিই খায় _বস্তার কাছে যায় না। মুড়ি-মুড়কি রূপ মায়া-মোহের বন্ধনে মহামায়া সকলকে জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করছেন _ কাউকে বাঁধছেন লোহার শেকলে, কাউকে না হয় সোনার শেকলে! কিন্তু দুটোই বন্ধন!
আবার বন্ধনের ফলে যন্ত্রনাক্লিষ্ট মানুষের প্রতি স্নেহবশতঃ তিনি আবার বন্ধন খুলে দিচ্ছেন, তিনিই মহাপুরুষদের অবতরণ ঘটাচ্ছেন_ বদ্ধ মানুষের মুক্তির পথ দেখানোর জন্য! মহাপুরুষের আগমনে মুক্তি ঘটে যাচ্ছে হাজার হাজার ক্লিষ্ট মানুষের! এই ভাবেই মায়ের জগতে মা নিরন্তর লীলা করে চলেছেন কে বুঝবে তাঁর রহস্য!
জিজ্ঞাসু:–বর্তমানে সব সংসারেই অশান্তি। বিশেষত দাম্পত্য জীবনে অশান্তি তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এটার কারণ-ই বা কি, আর এর কি কোন প্রতিবিধান রয়েছে?
গুরু মহারাজ:—সংসারে অশান্তির প্রধান কারণ প্রেমহীনতা! স্বার্থপরতা আর পাশবিকতা মানুষের জীবনে অধিকাংশ স্থান জুড়ে নিয়েছে_সেখানে ভালোবাসার স্থান কোথায়? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও প্রেমহীন স্বার্থের সম্পর্ক। একে অপরের জন্য স্বার্থ ত্যাগ করা, একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠার প্রবণতাই বা কোথায়? যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্যই যেন_ স্বামী-স্ত্রী, উচ্চ উচ্চ আদর্শ স্থাপনের কোন প্রচেষ্টাই নাই! এ কথাটা বললাম বলে তোমরা কিছু মনে কোরো না! দ্যাখো, তোমাদের মধ্যে কজন স্বামী তার স্ত্রীর যৌন অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে ভালবাসতে পারবে অথবা উল্টোভাবে কজন স্ত্রী__ তার স্বামীর যৌন অক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে আপনার করে নেবে? বুঝতে পারছো_কি বলতে চাইছি! স্বার্থ বিঘ্নিত হলেই সংঘাত! শিক্ষিতরা কেলেঙ্কারির ভয়ে জোর করে adjust করে নিচ্ছে, আর অশিক্ষিতরা এই ব্যাপারটাকে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলে_লোক জানাজানি করে ফেলে, এই যা পার্থক্য! কিন্তু সর্বত্রই একই কান্ড চলছে_ জেনে রাখবে ! আমার এখানে এসে অনেক স্বামীরাই তাদের স্ত্রীর বিষয়ে নানা অভিযোগ করে, আবার অনেক স্ত্রীরা তাদের স্বামীর বিরুদ্ধে আমাকে নানা কথা বলে থাকে! কিন্তু আমিতো জানি_ প্রকৃত রহস্যটা কি! তাই আমি ওদেরকে বলি_ “ভগবানে বিশ্বাস রাখবে, ঠিক মত ধ্যান-জপ করবে, তাহলেই দেখবে তোমাদের অশান্তি কেটে যাবে”! এতে তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় কিন্তু সেই অর্থে সংসারে শান্তি কি আসে? আসলে প্রেম না থাকলে কোনো সম্পর্কই মধুর হয় না! আবার কোন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে যদি প্রকৃত প্রেমের আবির্ভাব ঘটে, তাহলে সেখানে মহাপুরুষের জন্ম হয়ে যাবে_ এটা জেনে রাখবে! অনেক মহাপুরুষের soul পৃথিবীতে শরীর নিতে চান কিন্তু উপযুক্ত ক্ষেত্রের অভাবে অর্থাৎ উপযুক্ত মায়ের গর্ভের অভাবে_ তাঁরা জন্ম নিতে পারছেন না! তাইতো আমি বিবাহিত যুবক-যুবতীদেরকে বলি_ তোরা ভালো মা হয়ে ওঠার এবং আদর্শ পিতা হয়ে ওঠ্।
আর তুমি শান্তির কথা বলছিলে_ শান্তি কি বাজারে কিনতে পাওয়া যায়, যে দু-চার কিলো কিনে আনবে? শান্তি আছে নিজের কাছে_ মানুষের স্বভাবেই শান্তি! জেনে রাখবে, জীবনে অসন্তোষ-ই সমস্ত দু্ঃখ এবং অশান্তির মূলে! মানুষের বাসনারও শেষ নাই, আর অশান্তিরও শেষ নাই। তোমার দ্বারাই আচরিত অতীতের কর্মের ফল _তোমার আজকের এই বর্তমান! আবার তোমারই এখনকার(বর্তমানের) আচরিত কর্ম, ভবিষ্যতে ফল দান করবে! সুকর্মের সুফল এবং কু কর্মের কুফল_বুঝতে পারলে ব্যাপারটা?
তাই অতীতকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বর্তমানকে ধরো! যা হয়ে গেছে যাক_ এখন থেকে সংযত হও।যদি শান্তি পেতে চাও তো, সৎ হও- সুন্দর হও- প্রেমিক হও- পরোপকারী হও সংযমী হও। এর ফলস্বরূপ_ তোমার ভবিষ্যৎ জীবন শান্তিময় হয়ে উঠবে!
জিজ্ঞাসু:–বেদান্তের “অহং ব্রহ্মাস্মি”, আর বৈষ্ণবদের “দাসোহহং”_ এই দুটো কি পুরো উল্টো ব্যাপার নয়?
গুরু মহারাজ:–বৈষ্ণবদের দোষ ধোরোনা, দাস-ভাবটা প্রাথমিক অবস্থা! বৈষ্ণব মতে পঞ্চভাব রয়েছে_ শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর! মধুর-ভাব অর্থাৎ জমাট ঘনীভূত প্রেমের অবস্থা! এই অবস্থা প্রাপ্ত হওয়াটাই লক্ষ্য। তাই দাস-ভাব দিয়ে শুরু করে মধুর-ভাবে পৌঁছানো!
দ্যাখো, কোন মত নিয়েই বিরোধ করবে না_ কারণ প্রত্যেকটি মত-ই যেন এক একটা mood বা ভাব নিয়ে চলছে। অন্তিমে এরা সকলেই রাজপথ অবলম্বন করে_ পথের শেষে বা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।
জ্ঞান এবং ভক্তি মার্গীদের একটা বিরোধ বহুদিন থেকেই সমাজে রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানী এবং প্রকৃত ভক্ত বা প্রেমীর মধ্যে কোন বিরোধ নাই, আর বিরোধের কোন অবকাশও নাই। দ্যাখো, সিংহের দুধ সোনার পাত্র ছাড়া অন্য কোনো পাত্রে রাখলে কেটে নষ্ট হয়ে যায়। তেমনি ঘনীভূত প্রেম কে ধারণ করতে পারে? জ্ঞানীর হৃদয়ে স্থান করে নেয় প্রেম! আর আমাদেরও তো এটাই কাম্য_ জ্ঞানীর হৃদয়ে প্রেম বিরাজ করুক! তাহলে আত্মাভিমান মুক্ত, অহংকার মুক্ত জ্ঞানী কে পাবে সমাজ। ভাবো তো_ সে কি দারুন ব্যাপার হবে! শুধু পান্ডিত্যে কি হবে_পান্ডিত্যের সাথে পরাজ্ঞান বা পরাভক্তি যুক্ত হোলে তবে তো সর্বাঙ্গসুন্দর হবে! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “একে তো হাতির দাঁত,তাতে আবার সোনা দিয়ে বাঁধানো!”
স্বামী বিবেকানন্দকে দ্যাখো, জাগতিক রূপ-রস-মোহ আদি বিষয়সমূহ তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ ছিল,যেন পরিপূর্ণ বেদান্তী! কিন্তু সেই হেন স্বামীজিও কোন মানুষের দুঃখ দেখলে কেঁদে ফেলতেন। একবার বলেছিলেন_” যতদিন ভারতবর্ষের একটা কুকুরও অভূক্ত থাকবে, ততদিন তাদের মুখে আহার তুলে দেওয়াই আমার ধর্ম”! কি অসাধারণ কথা_কি মধুর প্রেমের প্রকাশ!
আত্মাভিমান ও অহংমুক্ত জ্ঞানীই প্রেমিক_আর প্রকৃত প্রেমিকই পারেন হৃদয়ে প্রেম ধরে রাখতে।তা নাহলে কি হবে সেটা বাউলে বলেছে_”কাঁচা হাঁড়িতে গো হাঁড়িতে, রাখিতে নারিলি প্রেমজল”_অর্থাৎ অনুপযুক্ত আধারে আধ্যাত্মিক বেগ ধারণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং জ্ঞানমার্গ বা ভক্তিমার্গের চূড়ান্ত অবস্থায় কোন বিরোধ নাই,যত বিরোধ নিচুতলায়! ঠিক এমনটাই হয় রাজনীতির পরস্পর বিরোধী নেতা-নেত্রীরা কোন অনুষ্ঠানে একসঙ্গেই খানাপিনা করে, কিন্তু মারামারি করে মরে নিচুতলার লোকেরা!(সবাই হেসে উঠল)!