শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরামানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা ছিলাম গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ *বাউলের মর্মকথা* -র প্রথম অধ্যায়ের আলোচনায়। গুরুমহারাজ এর আগে ‘বাউল’দের সম্বন্ধে বলেছেন – ” বাউল উপনিষদের সৃজনমুখী আত্মতত্ত্বের সাধক ও প্রচারক।” তাছাড়া উনি আরও একস্থানে বলেছেন – ‘বাউলদের অনিত্যের প্রতি বৈরাগ্য এবং নিত্যের প্রতি অনুরাগ।’ আর এঁদের সাধন পদ্ধতিকে বলেছেন – ” কোনরূপ ‘বাদে’র কবলে না পড়ে পরম আত্মবোধের জন্য তৎপর বা অগ্রসর হওয়াটাই প্রকৃত জীবনমুখী ধর্ম।” গুরুজীর এই সমস্ত কথা থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারি যে, বাউল সাধকই প্রকৃত উপনিষদের আত্মতত্ত্বের ধারা বহনকারী সাধক ও প্রচারক এবং এঁরাই প্রকৃত জীবনমুখী ধর্মপালনকারী সাধক। আমরা আগে আরো কিছু কথা গুরুমহারাজের এই অধ্যায় থেকে পেয়েছি, তা হোলো – “জীবনকে বাদ দিয়ে ধর্ম নয়,” এবং “মানুষকে বাদ দিয়ে ধর্মাচরণ নয়।” সুতরাং আমরা যারা ‘মানুষ’ তারা এইটুকু বুঝতেই পারছি যে, বাউল-সাধন পদ্ধতিটি কতটা নিত্য-আধুনিক, কতটা সমস্ত ধর্মমতের সমন্বয়কারী এক সাধনপথ যেখানে ‘মানুষ’কে এবং ‘মানুষের জীবন’-কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
যাইহোক, এবার আমরা দেখি গুরুমহারাজ এই ব্যাপারে আরো কি কি বলেছেন। আগের আলোচনায় আমরা দেখেছিলাম উনি বলেছিলেন – ‘বাউল পথের সাধক চূড়ান্ত অবস্থায় বিন্দুর ভিতর দিয়ে সিন্ধুর উল্লাস বোধ করেন’। এরপরে উনি বললেন – “এই সৎ-চিৎ-আনন্দের উল্লাস (বোধে) পরমানন্দময় সাগরে তিনি নিজেকে দ্রষ্টাস্বরূপ, সাক্ষীস্বরূপ রূপে জানতে পারেন বা পরমতত্ত্ব বোধে উপনীত হ’ন ! আত্ম-অনুরাগে, অনাত্মবৈরাগ্যে (তাই) তিনি ‘বাউল’! ঘর ছেড়ে তিনি পথে বের হ’ন ‘মনের মানুষে’র সন্ধানে। পরম সত্যলাভের জন্য তাঁর বিবাগী মন বাউন্ডুলে হয়ে ঘোরে পথে, বনে, গিরিগুহায়, কন্দরে, নগরে, বন্দরে। অবশেষে তিনি আবিষ্কার করেন আপনার ভিতরেই আপন ‘মনের মানুষ’-কে। নিজের ভিতরেই সেই পরম আত্মবোধ প্রাপ্ত হ’ন। পূর্ণস্বরূপ আপনাকে আবিষ্কার করেন, যাঁকে পেলে ‘সব পাওয়া যায়’ – সেই তত্ত্বে উপনীত হ’ন।
তাহলে গুরুমহারাজের উপরিউক্ত কথাগুলি থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারলাম যে, যোগমার্গীরা যোগের শীর্ষে পৌঁছে যে পরমানন্দময় স্থিতিলাভ করেন – বাউলসাধকেরা সেই একই তত্ত্বে উপনীত হ’ন বাউল-সাধনার শেষে। তাছাড়া আমরা এটাও বুঝলাম যে, জ্ঞানযোগীরা তাঁদের সাধনার শীর্ষে পৌঁছালে অর্থাৎ পরমজ্ঞান প্রাপ্ত হোলে যেমন ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ জেনে দ্রষ্টাস্বরূপ, সাক্ষীস্বরূপ হয়ে যান, বাউল সাধনার শেষেও ‘বাউল’গণ ঐ একই স্থিতিলাভ করেন। তবে বাউল-সাধকদের সাথে রাজযোগী বা জ্ঞানযোগীদের পার্থক্য এটাই যে, বাউলগণ তাঁদের ‘মনের মানুষ’-কে খোঁজার জন্য পথে-প্রান্তরে-বনে-জঙ্গলে-নগরে-বন্দরে মনের আনন্দে আলখাল্লা পড়ে, হাতের একতারায় সহজিয়া সুর তুলে ঘুরে বেড়ান। আর রাজযোগী ও জ্ঞানযোগীগণ একস্থানে থেকে যোগমার্গ অবলম্বন করে আত্মতত্ত্বের সন্ধান করে থাকেন ৷ বাউলগণ পথে-প্রান্তরে সকলের মধ্যে ‘মনের মানুষ’-কে খোঁজ করতে করতে অবশেষে নিজের মধ্যেই ‘আত্মতত্ত্বে’র বোধ করে শান্ত হয়ে যান, দ্রষ্টাস্বরূপ-সাক্ষীস্বরূপ হয়ে যান।
এখন আমরা আবার গুরুমহারাজের কথায় ফিরে যাই। এরপরে উনি বাউল সাধকদের সাধনার শীর্ষে পৌছানোর পর কি অবস্থা হয় সেই সম্পর্কে বলেছেন – “পেয়েছেন তিনি, তাই (তিনি বা বাউল) ‘পাগল’ অর্থাৎ ‘পেয়ে গিয়েছেন’! সেই পরম আত্মতত্ত্ব বোধে বা তত্ত্ববোধে আত্মহারা, তাই তিনি “ক্ষ্যাপা”! তাঁর পরম আত্মবোধ, পরমানন্দময় উল্লাস সংগীতাকারে উদ্গীত হয়, তাই তিনি ‘বাতুল'(এখান থেকেই ‘বাউল’ কথাটি এসেছে)। তাঁর অপরোক্ষ অনুভূত আনন্দধ্বনি অভিব্যঞ্জিত হয় অন্তরের সহজ ভাষায় – তাই তিনি উদ্গাতা – ‘বাউল’ বা ‘বাতুল’!”
পাঠকবৃন্দ – দেখেছেন কি সুন্দর এবং সহজ সব সংজ্ঞা !! ‘পাগল’, ‘ক্ষ্যাপা’, ‘বাতুল’– ইত্যাদি শব্দগুলি কি সাধারণভাবেই না আমরা এতোকাল ধরে ব্যবহার করতাম। কিন্তু এই শব্দগুলির কি সুন্দর অর্থ দেখেছেন – যিনি পরমতত্ত্ব বা আত্মতত্ত্বের সন্ধান পেয়েছেন বা পেয়ে গিয়েছেন বা লাভ করেছেন – তিনিই পাগল ! সেই আত্মতত্ত্বের বোধে যিনি আত্মহারা – তিনিই ‘ক্ষ্যাপা’ ! আর ঐ আত্মবোধ এবং আত্মবোধের ফলে পরমানন্দময় উল্লাস সঙ্গীতাকারে(জগৎ, জীবন এবং ঈশ্বর সংক্রান্ত) উদ্গীত হয় সেই ‘ক্ষ্যাপা’ বা ‘পাগলে’র কন্ঠে – তাই তখন তিনি ‘বাতুল’ বা ‘বাউল’।
এইখানেই যুগপুরুষের সঙ্গে অন্যান্য মহাত্মা-মহাপুরুষদের কিছুটা তফাৎ করা যায়। যুগপুরুষগণ যুগোপ্রয়োজনে যুগোপযোগী করে কথা বলেন, ফলে সেই কথাগুলি সেই যুগের মানুষের কাছে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তাছাড়া এই যুগপুরুষের শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের জীবনে যোজনা করতে পারলেই আধ্যাত্মিক উন্নতির গতি ত্বরান্বিত হয় – এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নাই।
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – এই যুগটা শ্রীরামকৃষ্ণের যুগ (আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে)। এই যুগে শ্রীরামকৃষ্ণকে অতিক্রম করা যাবে না। আমরা এই ব্যাপারটা কি দারুণভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম – গুরুমহারাজের জীবন ও তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে। গুরুমহারাজকে দেখেই আমরা ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিক কেমনটি ছিলেন, কি শিক্ষা দেবার জন্য ঠাকুরের শরীরধারণ হয়েছিল। ঈশ্বরের পরবর্তী অবতরণ হয় – পূর্ববর্তী অবতারকে ঠিক ঠিক ব্যাখ্যা করার জন্য ! স্বামী পরমানন্দ এবার শরীর ধারণ করে সেটাই দেখিয়ে গেলেন।৷
যাইহোক, এবার আমরা দেখি গুরুমহারাজ এই ব্যাপারে আরো কি কি বলেছেন। আগের আলোচনায় আমরা দেখেছিলাম উনি বলেছিলেন – ‘বাউল পথের সাধক চূড়ান্ত অবস্থায় বিন্দুর ভিতর দিয়ে সিন্ধুর উল্লাস বোধ করেন’। এরপরে উনি বললেন – “এই সৎ-চিৎ-আনন্দের উল্লাস (বোধে) পরমানন্দময় সাগরে তিনি নিজেকে দ্রষ্টাস্বরূপ, সাক্ষীস্বরূপ রূপে জানতে পারেন বা পরমতত্ত্ব বোধে উপনীত হ’ন ! আত্ম-অনুরাগে, অনাত্মবৈরাগ্যে (তাই) তিনি ‘বাউল’! ঘর ছেড়ে তিনি পথে বের হ’ন ‘মনের মানুষে’র সন্ধানে। পরম সত্যলাভের জন্য তাঁর বিবাগী মন বাউন্ডুলে হয়ে ঘোরে পথে, বনে, গিরিগুহায়, কন্দরে, নগরে, বন্দরে। অবশেষে তিনি আবিষ্কার করেন আপনার ভিতরেই আপন ‘মনের মানুষ’-কে। নিজের ভিতরেই সেই পরম আত্মবোধ প্রাপ্ত হ’ন। পূর্ণস্বরূপ আপনাকে আবিষ্কার করেন, যাঁকে পেলে ‘সব পাওয়া যায়’ – সেই তত্ত্বে উপনীত হ’ন।
তাহলে গুরুমহারাজের উপরিউক্ত কথাগুলি থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারলাম যে, যোগমার্গীরা যোগের শীর্ষে পৌঁছে যে পরমানন্দময় স্থিতিলাভ করেন – বাউলসাধকেরা সেই একই তত্ত্বে উপনীত হ’ন বাউল-সাধনার শেষে। তাছাড়া আমরা এটাও বুঝলাম যে, জ্ঞানযোগীরা তাঁদের সাধনার শীর্ষে পৌঁছালে অর্থাৎ পরমজ্ঞান প্রাপ্ত হোলে যেমন ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ জেনে দ্রষ্টাস্বরূপ, সাক্ষীস্বরূপ হয়ে যান, বাউল সাধনার শেষেও ‘বাউল’গণ ঐ একই স্থিতিলাভ করেন। তবে বাউল-সাধকদের সাথে রাজযোগী বা জ্ঞানযোগীদের পার্থক্য এটাই যে, বাউলগণ তাঁদের ‘মনের মানুষ’-কে খোঁজার জন্য পথে-প্রান্তরে-বনে-জঙ্গলে-নগরে-বন্দরে মনের আনন্দে আলখাল্লা পড়ে, হাতের একতারায় সহজিয়া সুর তুলে ঘুরে বেড়ান। আর রাজযোগী ও জ্ঞানযোগীগণ একস্থানে থেকে যোগমার্গ অবলম্বন করে আত্মতত্ত্বের সন্ধান করে থাকেন ৷ বাউলগণ পথে-প্রান্তরে সকলের মধ্যে ‘মনের মানুষ’-কে খোঁজ করতে করতে অবশেষে নিজের মধ্যেই ‘আত্মতত্ত্বে’র বোধ করে শান্ত হয়ে যান, দ্রষ্টাস্বরূপ-সাক্ষীস্বরূপ হয়ে যান।
এখন আমরা আবার গুরুমহারাজের কথায় ফিরে যাই। এরপরে উনি বাউল সাধকদের সাধনার শীর্ষে পৌছানোর পর কি অবস্থা হয় সেই সম্পর্কে বলেছেন – “পেয়েছেন তিনি, তাই (তিনি বা বাউল) ‘পাগল’ অর্থাৎ ‘পেয়ে গিয়েছেন’! সেই পরম আত্মতত্ত্ব বোধে বা তত্ত্ববোধে আত্মহারা, তাই তিনি “ক্ষ্যাপা”! তাঁর পরম আত্মবোধ, পরমানন্দময় উল্লাস সংগীতাকারে উদ্গীত হয়, তাই তিনি ‘বাতুল'(এখান থেকেই ‘বাউল’ কথাটি এসেছে)। তাঁর অপরোক্ষ অনুভূত আনন্দধ্বনি অভিব্যঞ্জিত হয় অন্তরের সহজ ভাষায় – তাই তিনি উদ্গাতা – ‘বাউল’ বা ‘বাতুল’!”
পাঠকবৃন্দ – দেখেছেন কি সুন্দর এবং সহজ সব সংজ্ঞা !! ‘পাগল’, ‘ক্ষ্যাপা’, ‘বাতুল’– ইত্যাদি শব্দগুলি কি সাধারণভাবেই না আমরা এতোকাল ধরে ব্যবহার করতাম। কিন্তু এই শব্দগুলির কি সুন্দর অর্থ দেখেছেন – যিনি পরমতত্ত্ব বা আত্মতত্ত্বের সন্ধান পেয়েছেন বা পেয়ে গিয়েছেন বা লাভ করেছেন – তিনিই পাগল ! সেই আত্মতত্ত্বের বোধে যিনি আত্মহারা – তিনিই ‘ক্ষ্যাপা’ ! আর ঐ আত্মবোধ এবং আত্মবোধের ফলে পরমানন্দময় উল্লাস সঙ্গীতাকারে(জগৎ, জীবন এবং ঈশ্বর সংক্রান্ত) উদ্গীত হয় সেই ‘ক্ষ্যাপা’ বা ‘পাগলে’র কন্ঠে – তাই তখন তিনি ‘বাতুল’ বা ‘বাউল’।
এইখানেই যুগপুরুষের সঙ্গে অন্যান্য মহাত্মা-মহাপুরুষদের কিছুটা তফাৎ করা যায়। যুগপুরুষগণ যুগোপ্রয়োজনে যুগোপযোগী করে কথা বলেন, ফলে সেই কথাগুলি সেই যুগের মানুষের কাছে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তাছাড়া এই যুগপুরুষের শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের জীবনে যোজনা করতে পারলেই আধ্যাত্মিক উন্নতির গতি ত্বরান্বিত হয় – এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নাই।
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – এই যুগটা শ্রীরামকৃষ্ণের যুগ (আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে)। এই যুগে শ্রীরামকৃষ্ণকে অতিক্রম করা যাবে না। আমরা এই ব্যাপারটা কি দারুণভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম – গুরুমহারাজের জীবন ও তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে। গুরুমহারাজকে দেখেই আমরা ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিক কেমনটি ছিলেন, কি শিক্ষা দেবার জন্য ঠাকুরের শরীরধারণ হয়েছিল। ঈশ্বরের পরবর্তী অবতরণ হয় – পূর্ববর্তী অবতারকে ঠিক ঠিক ব্যাখ্যা করার জন্য ! স্বামী পরমানন্দ এবার শরীর ধারণ করে সেটাই দেখিয়ে গেলেন।৷