শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা ছিলাম ওনার স্বহস্ত রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা -র কথায়। আগের episode-এ আমরা দেখেছি উনি ‘সহজিয়া বাউল’-দের উৎপত্তি সম্বন্ধে গবেষকদের নানান মতের উল্লেখ করে__ সেইসব মতের ঊর্ধ্বেও যে কিছু কথা রয়েছে, কিছু অনুসন্ধানের অবকাশ রয়েছে, তা-ও উল্লেখ করেছেন। এইবার আমরা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে প্রবেশ করবো এবং দেখবো উনি ‘বাউল’ বিষয়ে আরো কি কি বলেছেন !
উনি এরপর “বাউলতত্ত্বের রহস্য” সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে সকল মানুষের উদ্দেশ্যে বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – এখন তোমাকে (তোমাদেরকে) ঐ বাউলতত্ত্বের রহস্য বিশদভাবে ব্যক্ত করছি, তুমি স্থিরচিত্তে শ্রদ্ধাপূর্বক তা শ্রবণ করো !– বাউলগণ বলেন – যদি আত্মস্বরূপের বোধে-বোধ (বা বোধ) করতে হয়, তাহলে ‘মনের মানুষ’কে ধরতে হবে। ‘আল্লা’ বা ‘ভগবান’ বলে চিৎকার করলে তাঁকে জানা যাবে না। ‘ভগবান বা ‘আল্লা’ তোমার মধ্যেই বিরাজমান আছেন। যদি তাঁকে বোধে বোধ করতে চাও, তাহলে কর্মময় যোগ সাধনার প্রয়োজন। নিজের স্বরূপকে জানতে পারলেই তাঁকে জানা যাবে।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ – এইবার এবং এতোক্ষণে আমরা ধারণা করতে পারলাম যে, ‘বাউলগণ’-কে কেন অসাম্প্রদায়িক বলা হয় এবং কেন এঁদেরকে উপনিষদের ধারার সাধক বলা হয়। এঁরা কতটা সংস্কারমুক্ত ও আধুনিক এবং অপরদিকে শাশ্বত-সনাতন আত্মবোধের তত্ত্বের ধারক – সেটাও আমরা বুঝতে পারলাম। যার জন্যই তাঁরা বলতে পেরেছেন যে, ঈশ্বর-আল্লা-গড ইত্যাদি বলে চিৎকার করলে অর্থাৎ এঁদের উদ্দেশ্যে স্তব-স্তুতি-পূজা-অর্চনা-প্রার্থনা বা আজান-নামাজ ইত্যাদির দ্বারা সেই পরমেশ্বর (ঈশ্বর-আল্লাহ-গড)-কে জানা যায় না। বাউলগণ আরও বলেন যে, এই পরমেশ্বর (ঈশ্বর-আল্লা-গড) প্রতিটি জীবের অন্তর্জগতে অন্তর্যামীরূপে বিরাজমান। আর মানুষ যেহেতু এই পৃথিবীর সবচাইতে উন্নত প্রাণী – তাই মানুষ নিজের অন্তর্জগতে অনুসন্ধান করে নিজের স্বরূপকে জেনে সেই অন্তর্যামী পরমেশ্বরকে জানতে পারে। আর এই ‘জানা’-ই মানব জীবনের উদ্দেশ্য।
যাইহোক, আমরা আরো একটু অগ্রসর হয়ে দেখি এই বিষয়ে গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছেন ! উনি বলেছেন – ” বাউল মতে পরমার্থ তত্ত্বের নাম ‘সহজ’। এঁকে ‘সহজ মানুষ’ বা ‘নিত্যের মানুষ’ বলেও অভিহিত করা হয় এবং তিনি হোলেন অপ্রাকৃত নরাকার।৷ বাউলমতে এক অদ্বৈত পরমতত্ত্বই নিত্যযুগলরূপে স্ব-স্বরূপে স্বধাম নিত্যবৃন্দাবনে বিরাজমান। ঐ একই তত্ত্ব নিত্যকৃষ্ণ এবং নৃত্যরাধা যা নিত্যবৃন্দাবনে যুগলভাব ধারণ করে বিরাজিত আছেন।৷”
তাহলে পাঠকবৃন্দ – আমরা ধীরে ধীরে বাউলতত্ত্বের ভিতরে ঢুকে পড়ছি। বাউল মতে ‘পরমার্থ তত্ত্ব’ (পরমেশ্বর তত্ত্ব!) হোলো ‘সহজ’ ! এটিকে ‘সহজ মানুষ’ বা ‘নিত্যের মানুষ’ নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু এতদূর ঠিকঠাক বোধগম্য হোলেও এর পরের লাইনটি সত্যিই একটু গোলমেলে ! আর সেই কথাটা হোলো – ”বাউলের ‘সহজ মানুষ’ বা ‘নিত্যের মানুষ’ – অপ্রাকৃত নরাকার।” ‘অপ্রাকৃত’, আবার ‘নরাকার’ – এই ব্যাপারটা ভাবনায় আনা একটু মুস্কিল বই কি ! তবে পৃথিবীতে যত ধর্মমত রয়েছে, তা সাকার-নিরাকার বা মধ্যবর্তী যা কিছু হোক না কেন, এদের সকলেই ঐ রকম একটা অপ্রাকৃত নরাকার পরমেশ্বরের ধারণাই দেয় – এটা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। কারণ আমরা গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম যে নিরাকারবাদী সেমিটিক মতেও শেষ বিচারের দিনে পরমেশ্বর (আল্লাহ্) এবং নবীগণ নিজ নিজ আসনে বসে থাকেন। মহান পরমেশ্বরের (আল্লাহের) ডানপাশে একেবারে তাঁর পাশে বসার সুযোগ পান প্রিয় নবী, অন্যান্য নবীরা বাঁ পাশে বা প্রিয় নবীর পাশের স্থানগুলিতে বসার সুযোগ পান। তাছাড়া আদম-কে সৃষ্টি করার সময়েও – উনি নিজের মতো আকৃতিবিশিষ্ট করেই তৈরি করেছিলেন – এমনটা শাস্ত্রে লেখা রয়েছে । এই কথাগুলিও গুরুমহারাজের কাছে শুনেছিলাম।
এইসব কথা মাথায় রেখেই, এই ব্যাপারে আরো দু-চারটি কথা বলা যায় ! পৃথিবী গ্রহের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ –সুতরাং সে তার প্রাণের প্রাণ, পরমপ্রিয় পরমেশ্বর অর্থাৎ ঈশ্বর-আল্লাহ-গড-কে একজন উন্নত, মহান, সর্বগুণসম্পন্ন আদর্শ মানবরূপেই তো কল্পনা করবে – তাছাড়া সে আবার কি-ই বা করতে পারে!!
আমরাও তো ছোটবেলায় এই একই কথা ভাবতাম যে, পরমেশ্বর (ঈশ্বর-আল্লাহ-হরি-গড ইত্যাদি) ওই উঁচুতে আকাশের ওপারে কোনো স্থান থেকে পৃথিবীগ্রহের সব ব্যাপারে কলকাঠি নাড়ছেন – সবার ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব রাখছেন এবং সবার বিচার করছেন !
তবে আমাদের এই ছেলেমানুষী ভাবনার সাথে বাউলদের “অপ্রাকৃত নরাকার” সহজ মানুষের concept কতোটা আলাদা – সেটাই গুরু মহারাজ আমাদেরকে বলতে চেয়েছেন যে, বাউলগণের সাক্ষাৎ সঙ্গ না করলে এইসব কখনোই বোঝা যাবে না।৷