শ্রী শ্রী গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্ত রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ *বাউলের মর্মকথা* থেকে পরপর লাইন তুলে তুলে এখানে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টায় ছিলাম। এরপরে আমরা দেখবো ‘বাউল তত্ত্ব’ নিয়ে গুরুমহারাজ আরও গভীরে গিয়ে কি কি আলোচনা করেছেন। এবার উনি বলেছেন – ” বাউলমতে এক অদ্বৈত পরমতত্ত্বই নিত্যযুগলরূপে স্ব-স্বরূপে স্বধাম নৃত্যবৃন্দাবনে বিরাজমান। ঐ একই তত্ত্ব নিত্যকৃষ্ণ এবং নিত্যরাধা, যা নিত্যবৃন্দাবনে যুগলভাব ধারণ করে বিরাজিত আছেন।
এই পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ চিরকিশোর এবং পরমাপ্রকৃতি শ্রীরাধা চিরকিশোরী। বাহ্যতঃ শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ এবং শ্রীরাধা প্রকৃতি, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত ভাবটি অন্যরূপ। সেখানে একই অদ্বৈত-মহাচৈতন্য লীলারস মাধুর্য্য আস্বাদন করার নিমিত্তে লীলাবশে বাহ্যতঃ দুটি রূপ ধারণ করেছেন মাত্র। অর্থাৎ একই আত্মা দুটি দেহে নিত্য মিলিত – যুগপৎ ভেদ ও অভেদরূপে। নিত্যস্বরূপে অভেদ এবং লীলারূপে ভেদ। আর এই লীলা অনাদি – অনন্ত। সুতরাং লীলাও সত্য, নিত্যও সত্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ :–
” ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।৷” (বৃহদারণ্যকোপনিষৎ ; ৫/১/১)
[ ওঁ উহা (পরব্রহ্ম) পূর্ণ, ইহাও (নামরূপ ব্রহ্ম) পূর্ণ, পূর্ণ হতে পূর্ণ উদ্গত হ’ন, পূর্ণের (নাম-রূপ-কার্য ব্রহ্মের) পূর্ণত্ব গ্রহণ করলে পূর্ণ (পরব্রহ্ম)-ই অবশিষ্ট থাকেন।]।৷
গুরুমহারাজ এক লাইনের মধ্যে বললেন – ‘ বাউলমতে এক অদ্বৈত তত্ত্বই নিত্যযুগলরূপে স্ব-স্বরূপে স্বধাম বৃন্দাবনে বিরাজমান।’ নিত্যবৃন্দাবনে নিত্যযুগলরূপে অর্থাৎ নিত্যকৃষ্ণ ও নিত্যরাধা রূপে বিরাজিত। এই নিত্যকৃষ্ণ চিরকিশোর এবং নিত্যরাধা চিরকিশোরী, ইনিই পরমাপ্রকৃতি। ব্যাপারটা বুঝতে একটু গোলমাল লাগলেও আমরা মনঃসংযোগ করে কথাগুলি বোঝার চেষ্টা করছি। যাইহোক, এরপরে গুরুমহারাজ আরো কিছু রহস্যাবৃত কথার আবরণ উন্মোচন করলেন, আর সেগুলি হোলো – বাহ্যতঃ শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ এবং শ্রীরাধা প্রকৃতি, কিন্তু এই বাহ্যরূপের অন্তর্নিহিতভাবে এই দুই-এ এক, অদ্বৈত-মহাচৈতন্য অবস্থা। তাহলে একটা জিজ্ঞাসা এসেই যাচ্ছে, আর তা হোলো__ বাহ্যে দুটি পৃথক রূপ কেন ? এর উত্তরে গুরুমহারাজ বলেছেন যে, এটি শুধুমাত্র লীলারস মাধুর্য্য আস্বাদন করার নিমিত্ত। একই আত্মায় দুটি দেহ, যুগপৎ ভেদ ও অভেদরূপে নিত্য মিলিত। নিত্যস্বরূপে অভেদ এবং লীলারূপে ভেদ, আর এই লীলার শেষ নাই, যা অনাদি–অনন্ত। এই অর্থেই বলা যায় যে, লীলাও সত্য এবং নিত্যও সত্য। গুরু মহারাজ বৃহদারাণ্যক উপন্যাসের অংশ তুলে বলেছেন যে, এই লীলার জগৎ-ও পূর্ণ এবং নিত্য-ও পূর্ণ… ইত্যাদি।।
পরমপুরুষ শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই একই কথা বলেছিলেন, উনি বলেছিলেন – ” ব্রহ্মও সত্য, কালীও সত্য। যিনি ব্রহ্ম – তিনিই কালী, কালীই ব্রহ্ম – ব্রহ্মই কালী !”
যাইহোক, আমরা আবার ফিরে যাই গুরুমহারাজের লিখিত কথায়। এবার উনি বলেছেন – ” বাউলগণ বলেন – ব্রহ্মতত্ত্ব বা ঈশ্বরতত্ত্ব যদিও দুর্গম (এই তত্ত্বের নাগাল পাওয়াটা খুবই দুষ্কর) তথাপি তা ধারণা করা যেতে পারে। কিন্তু মানুষতত্ত্ব অতি অদ্ভুত এবং ইহা বোধ করাও অতি দুরূহ। অধিকারী ভিন্ন অন্য কেহ এই তত্ত্ব বুঝতে সক্ষম হয় না।
নিত্যধাম বা সহজপুরে চিরকিশোর-কিশোরী শ্রীরাধাকৃষ্ণ রত্ন সিংহাসনে বিরাজমান। আর ওই নিত্যধাম হোলো নিত্যবৃন্দাবন, যা বিরজার পরপারে অবস্থিত।
বাউলমতে মানুষতত্ত্বের তিন প্রকার ভেদ, যথা – (১) সহজ মানুষ, (২) অযোনিজ মানুষ এবং (৩) সামান্য মানুষ বা যোনিজ মানুষ। ‘সহজ মানুষ’ বিরাজ করেন নৃত্যবৃন্দাবনে যা অপ্রাকৃত চিন্ময় এবং বাউলমতে (এটিই) সহজপুর। এখানে তিনি আপন স্বরূপশক্তি হ্লাদিনী অর্থাৎ শ্রীরাধা সহকারে অবস্থান করেন এবং নিত্য নব নব লীলারস মাধুর্য্য আস্বাদন করেন।৷
‘অযোনিজ মানুষ’ বিরাজ করেন বৈকুন্ঠেতে। এটা ভাবজগৎ বা অধ্যাত্মজগৎ। এখানে তিনি লীলাময় নারায়ণ ও শ্রী লক্ষীদেবীর সঙ্গে বিরাজ করছেন। চতুর্ভুজ নারায়ণ এবং শ্রী লক্ষীদেবী বৈকুন্ঠে অনন্ত-শয্যায় শায়িত রয়েছেন। তাঁরা নারদাদি ভক্তগণ এবং অসংখ্য মোক্ষপ্রাপ্ত মুক্তগণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন।
আর ‘সামান্য মানুষ’ অর্থাৎ যোনিজ মানুষ বিরাজ করেন ক্ষীরোদ সাগরে – এটা হোলো জন্ম-মৃত্যুর অধীন স্থূল জড়জগৎ। ইনি জীবন ও মৃত্যুতে গমনাগমন করেন অর্থাৎ স্থূল বিশ্বে যাতায়াত করেন। এই সামান্য মানুষই সর্বত্র বর্তমান।৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ, গুরুমহারাজ বাউলতত্ত্বের কথা যা বললেন, তাতে এটাই বোঝা গেল যে, ব্রহ্মতত্ত্ব-ঈশ্বরতত্ত্ব দুরূহ-দুর্গম-দুর্লভ তো বটেই কিন্তু মনুষ্যতত্ত্ব আরও দুরূহ ! বাউলগণ মানুষের যে তিনপ্রকার ভেদ করেছেন তা হোলো – সহজ মানুষ, অযোনিজ মানুষ এবং যোনিজ মানুষ। এই সহজ মানুষই যুগলরূপে নিত্যকৃষ্ণ ও নিত্যরাধা রূপে নিত্যবৃন্দাবনে বিরাজ করেন। অযোনিজ মানুষ থাকেন বৈকুন্ঠে ! এখানেও যুগলরূপে চতুর্ভুজ নারায়ণ এবং লক্ষ্মীদেবী বিরাজ করেন। এখানে নারদাদি ভক্তগণ ও মুক্তপুরুষগণেরও প্রবেশাধিকার রয়েছে।
আর সামান্য মানুষ বা যোনিজ মানুষ থাকেন ক্ষীরোদসাগরে অর্থাৎ স্থূল জড়জগতে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরাই সেই সামান্য মানুষ বা যোনিজ মানুষ !
[ক্রমশঃ]
এই পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ চিরকিশোর এবং পরমাপ্রকৃতি শ্রীরাধা চিরকিশোরী। বাহ্যতঃ শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ এবং শ্রীরাধা প্রকৃতি, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত ভাবটি অন্যরূপ। সেখানে একই অদ্বৈত-মহাচৈতন্য লীলারস মাধুর্য্য আস্বাদন করার নিমিত্তে লীলাবশে বাহ্যতঃ দুটি রূপ ধারণ করেছেন মাত্র। অর্থাৎ একই আত্মা দুটি দেহে নিত্য মিলিত – যুগপৎ ভেদ ও অভেদরূপে। নিত্যস্বরূপে অভেদ এবং লীলারূপে ভেদ। আর এই লীলা অনাদি – অনন্ত। সুতরাং লীলাও সত্য, নিত্যও সত্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ :–
” ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।৷” (বৃহদারণ্যকোপনিষৎ ; ৫/১/১)
[ ওঁ উহা (পরব্রহ্ম) পূর্ণ, ইহাও (নামরূপ ব্রহ্ম) পূর্ণ, পূর্ণ হতে পূর্ণ উদ্গত হ’ন, পূর্ণের (নাম-রূপ-কার্য ব্রহ্মের) পূর্ণত্ব গ্রহণ করলে পূর্ণ (পরব্রহ্ম)-ই অবশিষ্ট থাকেন।]।৷
গুরুমহারাজ এক লাইনের মধ্যে বললেন – ‘ বাউলমতে এক অদ্বৈত তত্ত্বই নিত্যযুগলরূপে স্ব-স্বরূপে স্বধাম বৃন্দাবনে বিরাজমান।’ নিত্যবৃন্দাবনে নিত্যযুগলরূপে অর্থাৎ নিত্যকৃষ্ণ ও নিত্যরাধা রূপে বিরাজিত। এই নিত্যকৃষ্ণ চিরকিশোর এবং নিত্যরাধা চিরকিশোরী, ইনিই পরমাপ্রকৃতি। ব্যাপারটা বুঝতে একটু গোলমাল লাগলেও আমরা মনঃসংযোগ করে কথাগুলি বোঝার চেষ্টা করছি। যাইহোক, এরপরে গুরুমহারাজ আরো কিছু রহস্যাবৃত কথার আবরণ উন্মোচন করলেন, আর সেগুলি হোলো – বাহ্যতঃ শ্রীকৃষ্ণ পুরুষ এবং শ্রীরাধা প্রকৃতি, কিন্তু এই বাহ্যরূপের অন্তর্নিহিতভাবে এই দুই-এ এক, অদ্বৈত-মহাচৈতন্য অবস্থা। তাহলে একটা জিজ্ঞাসা এসেই যাচ্ছে, আর তা হোলো__ বাহ্যে দুটি পৃথক রূপ কেন ? এর উত্তরে গুরুমহারাজ বলেছেন যে, এটি শুধুমাত্র লীলারস মাধুর্য্য আস্বাদন করার নিমিত্ত। একই আত্মায় দুটি দেহ, যুগপৎ ভেদ ও অভেদরূপে নিত্য মিলিত। নিত্যস্বরূপে অভেদ এবং লীলারূপে ভেদ, আর এই লীলার শেষ নাই, যা অনাদি–অনন্ত। এই অর্থেই বলা যায় যে, লীলাও সত্য এবং নিত্যও সত্য। গুরু মহারাজ বৃহদারাণ্যক উপন্যাসের অংশ তুলে বলেছেন যে, এই লীলার জগৎ-ও পূর্ণ এবং নিত্য-ও পূর্ণ… ইত্যাদি।।
পরমপুরুষ শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই একই কথা বলেছিলেন, উনি বলেছিলেন – ” ব্রহ্মও সত্য, কালীও সত্য। যিনি ব্রহ্ম – তিনিই কালী, কালীই ব্রহ্ম – ব্রহ্মই কালী !”
যাইহোক, আমরা আবার ফিরে যাই গুরুমহারাজের লিখিত কথায়। এবার উনি বলেছেন – ” বাউলগণ বলেন – ব্রহ্মতত্ত্ব বা ঈশ্বরতত্ত্ব যদিও দুর্গম (এই তত্ত্বের নাগাল পাওয়াটা খুবই দুষ্কর) তথাপি তা ধারণা করা যেতে পারে। কিন্তু মানুষতত্ত্ব অতি অদ্ভুত এবং ইহা বোধ করাও অতি দুরূহ। অধিকারী ভিন্ন অন্য কেহ এই তত্ত্ব বুঝতে সক্ষম হয় না।
নিত্যধাম বা সহজপুরে চিরকিশোর-কিশোরী শ্রীরাধাকৃষ্ণ রত্ন সিংহাসনে বিরাজমান। আর ওই নিত্যধাম হোলো নিত্যবৃন্দাবন, যা বিরজার পরপারে অবস্থিত।
বাউলমতে মানুষতত্ত্বের তিন প্রকার ভেদ, যথা – (১) সহজ মানুষ, (২) অযোনিজ মানুষ এবং (৩) সামান্য মানুষ বা যোনিজ মানুষ। ‘সহজ মানুষ’ বিরাজ করেন নৃত্যবৃন্দাবনে যা অপ্রাকৃত চিন্ময় এবং বাউলমতে (এটিই) সহজপুর। এখানে তিনি আপন স্বরূপশক্তি হ্লাদিনী অর্থাৎ শ্রীরাধা সহকারে অবস্থান করেন এবং নিত্য নব নব লীলারস মাধুর্য্য আস্বাদন করেন।৷
‘অযোনিজ মানুষ’ বিরাজ করেন বৈকুন্ঠেতে। এটা ভাবজগৎ বা অধ্যাত্মজগৎ। এখানে তিনি লীলাময় নারায়ণ ও শ্রী লক্ষীদেবীর সঙ্গে বিরাজ করছেন। চতুর্ভুজ নারায়ণ এবং শ্রী লক্ষীদেবী বৈকুন্ঠে অনন্ত-শয্যায় শায়িত রয়েছেন। তাঁরা নারদাদি ভক্তগণ এবং অসংখ্য মোক্ষপ্রাপ্ত মুক্তগণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন।
আর ‘সামান্য মানুষ’ অর্থাৎ যোনিজ মানুষ বিরাজ করেন ক্ষীরোদ সাগরে – এটা হোলো জন্ম-মৃত্যুর অধীন স্থূল জড়জগৎ। ইনি জীবন ও মৃত্যুতে গমনাগমন করেন অর্থাৎ স্থূল বিশ্বে যাতায়াত করেন। এই সামান্য মানুষই সর্বত্র বর্তমান।৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ, গুরুমহারাজ বাউলতত্ত্বের কথা যা বললেন, তাতে এটাই বোঝা গেল যে, ব্রহ্মতত্ত্ব-ঈশ্বরতত্ত্ব দুরূহ-দুর্গম-দুর্লভ তো বটেই কিন্তু মনুষ্যতত্ত্ব আরও দুরূহ ! বাউলগণ মানুষের যে তিনপ্রকার ভেদ করেছেন তা হোলো – সহজ মানুষ, অযোনিজ মানুষ এবং যোনিজ মানুষ। এই সহজ মানুষই যুগলরূপে নিত্যকৃষ্ণ ও নিত্যরাধা রূপে নিত্যবৃন্দাবনে বিরাজ করেন। অযোনিজ মানুষ থাকেন বৈকুন্ঠে ! এখানেও যুগলরূপে চতুর্ভুজ নারায়ণ এবং লক্ষ্মীদেবী বিরাজ করেন। এখানে নারদাদি ভক্তগণ ও মুক্তপুরুষগণেরও প্রবেশাধিকার রয়েছে।
আর সামান্য মানুষ বা যোনিজ মানুষ থাকেন ক্ষীরোদসাগরে অর্থাৎ স্থূল জড়জগতে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরাই সেই সামান্য মানুষ বা যোনিজ মানুষ !
[ক্রমশঃ]