শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা আগের এপিসডে দেখেছিলাম যে, গুরুমহারাজ ‘বাউলতত্ত্ব’ বোঝাতে গিয়ে এবার ‘ব্রহ্মতত্ত্ব’ বা ‘ঈশ্বরতত্ত্ব’ অপেক্ষাও যে ‘মনুষ্যতত্ত্ব’ অতীব দুরূহ – সেই কথার উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বাউলগণ ঈশ্বরতত্ত্ব অপেক্ষাও মনুষ্যতত্ত্বেই অধিক জোর দিয়ে থাকেন। ঈশ্বরতত্ত্বকেও তাঁরা মনুষ্যতত্ত্ব দিয়েই ব্যাখ্যা করে থাকেন – তাইতো এই তত্ত্ব ‘সহজতত্ত্ব’। বেশি জটিলভাবে তাঁরা জগৎ-জীবন-ঈশ্বরকে বুঝতে বা বোঝাতে চান না – তাই সহজতত্ত্ব অবলম্বন করে তাঁরা সহজ-সাধন করে থাকেন এবং নিজের মধ্যেই ‘সহজ মানুষ’ বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। এই ক্রম-টাই বাউলগণের সহজ সাধনার অন্তিম পরিণতি, যা উপনিষদের আত্মতত্ত্বেরই নামান্তর। সুতরাং বাউলগণের সহজ সাধনা বেদ-প্রতিপাদ্য আত্মতত্ত্বেরই সাধনা, তাই এঁরা শাশ্বত, সনাতন পথের পথিক।
এসব কথা থাক – আমরা গুরুমহারাজের আলোচনায় ফিরে যাই। উনি বলেছিলেন, বাউল মতে মানুষকে তিন প্রকারে ভাগ করা হয় – সহজ মানুষ, অযোনিজ মানুষ ও যোনিজ মানুষ বা সামান্য মানুষ অর্থাৎ সাধারণ জনসাধারণ ! এখানে ‘সহজ মানুষ’ অর্থাৎ নিত্যের মানুষ স্থূল-সূক্ষ-কারণের অতীত, নিত্যধাম নিত্যবৃন্দাবনে নৃত্যকৃষ্ণ ও নৃত্যরাধার নিত্যলীলা হয়ে চলেছে– যা অনাদি অনন্ত, যা সদা-সর্বদা হয়ে চলেছে, যা সাধারণ মানুষের বোধ-বুদ্ধি-চিন্তা-ভাবনার অতীত। এটি শুধু ‘বোধে বোধ’ করা যায়, এর স্থূল ব্যাখ্যা হয় না – স্থূলভাবে বোঝা বা বোঝানোও যায় না।
অযোনিজ মানুষ বৈকুন্ঠে থাকেন। গুরুমহারাজ অন্যত্র বলেছিলেন – “বৈকুন্ঠ অর্থাৎ যেখানে কুন্ঠা নাই”। এখানে চতুর্ভুজ নারায়ণ ও লক্ষীদেবী অনন্ত শয্যায় শায়িত কিন্তু নারদাদি ভক্তবৃন্দ এবং অসংখ্য মোক্ষপ্রাপ্ত মুক্তপুরুষের দ্বারা এঁরা পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছেন। এই যে নারদাদি ভক্তগণ এবং অসংখ্য মোক্ষপ্রাপ্ত মুক্তগণ__তাঁরা কুণ্ঠামুক্ত হয়েছেন, ভগবান নারায়ণ বা লক্ষীদেবীর সংস্পর্শে থাকতে বা তাঁদের সাথে যোগাযোগ করায় কোনো কুণ্ঠাবোধ নাই এঁদের – তাই এঁরাও বৈকুন্ঠে স্থিত। বাউলগণ বৈকুণ্ঠকে ভাবজগৎ বা অধ্যাত্মজগৎ-ও বলে থাকেন অর্থাৎ এক কথায় প্রকৃত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিগণ বৈকুন্ঠলোকে পৌঁছাতে পারেন বা সেখানে স্থিতিলাভ করতে পারেন।
আর যোনিজ মানুষ বা সামান্য মানুষ অর্থাৎ যারা আমাদের ন্যায় সাধারণ মানুষ। আমরা জন্ম-মৃত্যুর অধীন স্থূল জড়জগৎ, যাকে বাউলগণ ক্ষীরোদসাগর নামে অভিহিত করেন – সেখানেই অবস্থান করছি। তাই আমাদের বারবার জন্ম-মৃত্যুর আবর্তনে পড়তে হয় এবং জন্ম-জন্মান্তর ধরে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। যাইহোক, এরপর আমরা দেখবো এরপরে গুরুমহারাজ এই সব সম্বন্ধে আরো কি কি বলেছেন ! উনি বলেছেন – ” বাউলগণ বলেন – এই বর্তমান মানুষের মধ্যেই ‘সহজ মানুষ’ আছেন, অর্থাৎ ‘বর্তমান’ রূপের মধ্যে ‘অবর্তমান’ বা ‘নিত্য বর্তমান’ স্বরূপের স্থিতি আছে। এটা অতি গূঢ় এবং সহজে অনুধাবনযোগ্য নহে। ঐ ‘সহজ মানুষ’ অযোনিজ মানুষও ন’ন এবং সামান্য মানুষ ন’ন। তিনি কেবল নিত্যবৃন্দাবন সহজপুরেই বিরাজিত।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ, আমরা বাউলগানে শুনেছি – ‘এই মানুষে সেই *মানুষ* আছে !’ এইবার বোঝা গেল ঐ কথাগুলির মানেটা কি ! ‘এই মানুষ’ অর্থাৎ সামান্য মানুষ এবং ‘সেই মানুষ’ অর্থাৎ *সহজ মানুষ*! উপনিষদের মহাবাক্য ” *অহং ব্রহ্মাস্মি* ” বা ” *তৎ-ত্বমসি* “, অথবা অন্যত্র ভারতীয় শাস্ত্রাদিতে বলা হয়েছে – “প্রতিটি মানুষের অন্তরে, অন্তর্যামীরূপে পরমেশ্বর বিরাজমান”– এই কথাগুলিকেই পুষ্ট করছে বাউল তত্ত্ব।
অবশ্য গুরুমহারাজ এ কথাও বলছেন যে, ‘এটা অতি গূঢ় (তত্ত্ব) এবং সহজে অনুধাবনযোগ্য নয়।’ তাছাড়া উনি বলেছেন – ‘এই সহজ মানুষ অযোনিজ বা সামান্য মানুষ ন’ন, এই ‘সহজ মানুষ’ নিত্যবৃন্দাবন সহজপুরে বিরাজ করেন৷ এই যে কথাগুলি এখানে ব্যবহার হচ্ছে – ‘নিত্যরাধা’, ‘নিত্যকৃষ্ণ’, ‘নিত্যবৃন্দাবন’ -এই শব্দগুলির সাথে আমরা সাধারণ মানুষেরা মোটেই পরিচিত নই, সেইজন্যই গুরুমহারাজ বলেছেন এই তত্ত্ব বোঝা খুবই দুরূহ। প্রকৃতপক্ষে এই পৃথিবীগ্রহের কোন স্থানে অথবা পৃথিবীগ্রহের বাইরে নক্ষত্রমন্ডলের কোনো গ্রহে এই নিত্যবৃন্দাবন অবস্থিত নয়। বাউলগানেই রয়েছে – ‘হৃদয়মাঝে বৃন্দাবন’, আর এই বৃন্দাবনের খোঁজেই পথে নামে বাউল এবং অবশেষে নিজের অন্তঃপুরেই খুঁজে পান সেই সহজপুরে থাকা ‘সহজ মানুষ’-কে।
এরপরে গুরুমহারাজ এই সহজপুর সম্বন্ধে বলেছেন – ” এই সহজপুর বা নিত্যবৃন্দাবন সৃষ্টির অন্তর্গত নয়। তার উন্মেষ হয় রাগে অর্থাৎ রাগানুগা ভজনে।” এইবার বোঝা গেল ‘নিত্যবৃন্দাবন’ বা ‘সহজপুর’-এর আসল রহস্য ! এটি সৃষ্টির অন্তর্গত নয় অর্থাৎ এইটি এই বিশ্বে বা মহাবিশ্বের কোনো স্থানে অবস্থিত নয়। গুরুমহারাজ বলেছেন – “এই সহজপুরের উন্মেষ হয় রাগে বা রাগানুগা ভজনে৷” নিত্যবৃন্দাবন বা সহজপুর প্রচলিত সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাপার নয় – তাই স্থূলভাবে এর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব থাকে না। এটি ভাবজগতের ব্যাপার, রাগানুগা ভজনের ব্যাপার। সাধক যখন সাধনার গভীরে প্রবেশ করেন তখন তিনি দেখতে পান অর্থাৎ ধারণা করতে পারেন যে, তার এই স্থুলদেহটাকে কেন্দ্র করে যে অন্তর্জগৎ রয়েছে তা সমগ্র মহাবিশ্ব তথা বহির্জগতেরই যেন ক্ষুদ্র সংস্করণ। বাউল সাধক অনুভব করতে থাকেন *ভান্ডে ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্ব*। এইভাবেই ভাবজগতের নিত্যবৃন্দাবন লীলা সাধকের অন্তর্জগতেই প্রকাশিত হোতে থাকে এবং তিনি তাঁর ভাবচক্ষু দ্বারা সেই সমস্ত লীলা দর্শন করেও থাকেন ! এ বড় বিচিত্র ব্যাপার ! গুরুমহারাজ এইজন্যেই বারে বারে বলতেন – ” আধ্যাত্মিক জগতের বিচিত্র বিধান !”
এসব কথা থাক – আমরা গুরুমহারাজের আলোচনায় ফিরে যাই। উনি বলেছিলেন, বাউল মতে মানুষকে তিন প্রকারে ভাগ করা হয় – সহজ মানুষ, অযোনিজ মানুষ ও যোনিজ মানুষ বা সামান্য মানুষ অর্থাৎ সাধারণ জনসাধারণ ! এখানে ‘সহজ মানুষ’ অর্থাৎ নিত্যের মানুষ স্থূল-সূক্ষ-কারণের অতীত, নিত্যধাম নিত্যবৃন্দাবনে নৃত্যকৃষ্ণ ও নৃত্যরাধার নিত্যলীলা হয়ে চলেছে– যা অনাদি অনন্ত, যা সদা-সর্বদা হয়ে চলেছে, যা সাধারণ মানুষের বোধ-বুদ্ধি-চিন্তা-ভাবনার অতীত। এটি শুধু ‘বোধে বোধ’ করা যায়, এর স্থূল ব্যাখ্যা হয় না – স্থূলভাবে বোঝা বা বোঝানোও যায় না।
অযোনিজ মানুষ বৈকুন্ঠে থাকেন। গুরুমহারাজ অন্যত্র বলেছিলেন – “বৈকুন্ঠ অর্থাৎ যেখানে কুন্ঠা নাই”। এখানে চতুর্ভুজ নারায়ণ ও লক্ষীদেবী অনন্ত শয্যায় শায়িত কিন্তু নারদাদি ভক্তবৃন্দ এবং অসংখ্য মোক্ষপ্রাপ্ত মুক্তপুরুষের দ্বারা এঁরা পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছেন। এই যে নারদাদি ভক্তগণ এবং অসংখ্য মোক্ষপ্রাপ্ত মুক্তগণ__তাঁরা কুণ্ঠামুক্ত হয়েছেন, ভগবান নারায়ণ বা লক্ষীদেবীর সংস্পর্শে থাকতে বা তাঁদের সাথে যোগাযোগ করায় কোনো কুণ্ঠাবোধ নাই এঁদের – তাই এঁরাও বৈকুন্ঠে স্থিত। বাউলগণ বৈকুণ্ঠকে ভাবজগৎ বা অধ্যাত্মজগৎ-ও বলে থাকেন অর্থাৎ এক কথায় প্রকৃত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিগণ বৈকুন্ঠলোকে পৌঁছাতে পারেন বা সেখানে স্থিতিলাভ করতে পারেন।
আর যোনিজ মানুষ বা সামান্য মানুষ অর্থাৎ যারা আমাদের ন্যায় সাধারণ মানুষ। আমরা জন্ম-মৃত্যুর অধীন স্থূল জড়জগৎ, যাকে বাউলগণ ক্ষীরোদসাগর নামে অভিহিত করেন – সেখানেই অবস্থান করছি। তাই আমাদের বারবার জন্ম-মৃত্যুর আবর্তনে পড়তে হয় এবং জন্ম-জন্মান্তর ধরে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। যাইহোক, এরপর আমরা দেখবো এরপরে গুরুমহারাজ এই সব সম্বন্ধে আরো কি কি বলেছেন ! উনি বলেছেন – ” বাউলগণ বলেন – এই বর্তমান মানুষের মধ্যেই ‘সহজ মানুষ’ আছেন, অর্থাৎ ‘বর্তমান’ রূপের মধ্যে ‘অবর্তমান’ বা ‘নিত্য বর্তমান’ স্বরূপের স্থিতি আছে। এটা অতি গূঢ় এবং সহজে অনুধাবনযোগ্য নহে। ঐ ‘সহজ মানুষ’ অযোনিজ মানুষও ন’ন এবং সামান্য মানুষ ন’ন। তিনি কেবল নিত্যবৃন্দাবন সহজপুরেই বিরাজিত।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ, আমরা বাউলগানে শুনেছি – ‘এই মানুষে সেই *মানুষ* আছে !’ এইবার বোঝা গেল ঐ কথাগুলির মানেটা কি ! ‘এই মানুষ’ অর্থাৎ সামান্য মানুষ এবং ‘সেই মানুষ’ অর্থাৎ *সহজ মানুষ*! উপনিষদের মহাবাক্য ” *অহং ব্রহ্মাস্মি* ” বা ” *তৎ-ত্বমসি* “, অথবা অন্যত্র ভারতীয় শাস্ত্রাদিতে বলা হয়েছে – “প্রতিটি মানুষের অন্তরে, অন্তর্যামীরূপে পরমেশ্বর বিরাজমান”– এই কথাগুলিকেই পুষ্ট করছে বাউল তত্ত্ব।
অবশ্য গুরুমহারাজ এ কথাও বলছেন যে, ‘এটা অতি গূঢ় (তত্ত্ব) এবং সহজে অনুধাবনযোগ্য নয়।’ তাছাড়া উনি বলেছেন – ‘এই সহজ মানুষ অযোনিজ বা সামান্য মানুষ ন’ন, এই ‘সহজ মানুষ’ নিত্যবৃন্দাবন সহজপুরে বিরাজ করেন৷ এই যে কথাগুলি এখানে ব্যবহার হচ্ছে – ‘নিত্যরাধা’, ‘নিত্যকৃষ্ণ’, ‘নিত্যবৃন্দাবন’ -এই শব্দগুলির সাথে আমরা সাধারণ মানুষেরা মোটেই পরিচিত নই, সেইজন্যই গুরুমহারাজ বলেছেন এই তত্ত্ব বোঝা খুবই দুরূহ। প্রকৃতপক্ষে এই পৃথিবীগ্রহের কোন স্থানে অথবা পৃথিবীগ্রহের বাইরে নক্ষত্রমন্ডলের কোনো গ্রহে এই নিত্যবৃন্দাবন অবস্থিত নয়। বাউলগানেই রয়েছে – ‘হৃদয়মাঝে বৃন্দাবন’, আর এই বৃন্দাবনের খোঁজেই পথে নামে বাউল এবং অবশেষে নিজের অন্তঃপুরেই খুঁজে পান সেই সহজপুরে থাকা ‘সহজ মানুষ’-কে।
এরপরে গুরুমহারাজ এই সহজপুর সম্বন্ধে বলেছেন – ” এই সহজপুর বা নিত্যবৃন্দাবন সৃষ্টির অন্তর্গত নয়। তার উন্মেষ হয় রাগে অর্থাৎ রাগানুগা ভজনে।” এইবার বোঝা গেল ‘নিত্যবৃন্দাবন’ বা ‘সহজপুর’-এর আসল রহস্য ! এটি সৃষ্টির অন্তর্গত নয় অর্থাৎ এইটি এই বিশ্বে বা মহাবিশ্বের কোনো স্থানে অবস্থিত নয়। গুরুমহারাজ বলেছেন – “এই সহজপুরের উন্মেষ হয় রাগে বা রাগানুগা ভজনে৷” নিত্যবৃন্দাবন বা সহজপুর প্রচলিত সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাপার নয় – তাই স্থূলভাবে এর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব থাকে না। এটি ভাবজগতের ব্যাপার, রাগানুগা ভজনের ব্যাপার। সাধক যখন সাধনার গভীরে প্রবেশ করেন তখন তিনি দেখতে পান অর্থাৎ ধারণা করতে পারেন যে, তার এই স্থুলদেহটাকে কেন্দ্র করে যে অন্তর্জগৎ রয়েছে তা সমগ্র মহাবিশ্ব তথা বহির্জগতেরই যেন ক্ষুদ্র সংস্করণ। বাউল সাধক অনুভব করতে থাকেন *ভান্ডে ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্ব*। এইভাবেই ভাবজগতের নিত্যবৃন্দাবন লীলা সাধকের অন্তর্জগতেই প্রকাশিত হোতে থাকে এবং তিনি তাঁর ভাবচক্ষু দ্বারা সেই সমস্ত লীলা দর্শন করেও থাকেন ! এ বড় বিচিত্র ব্যাপার ! গুরুমহারাজ এইজন্যেই বারে বারে বলতেন – ” আধ্যাত্মিক জগতের বিচিত্র বিধান !”