স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন । সময় ~ ১৯৯০(জুন-জুলাই) ৷ উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ সব্যসাচী মান্না, ধীরেনবাবু, গঙ্গাবাবু ও অন্যান্যরা ৷
জিজ্ঞাসু :– নটরাজ মূর্তির রহস্য সম্বন্ধে যদি একটু বুঝিয়ে বলেন ?
গুরুমহারাজ :– নটরাজ মূর্তি যেন Cosmic dance-এর মূর্তরূপ ! দ্যাখো_ এই মহাবিশ্বপ্রকৃতিতে দুটো মহাজাগতিক নাদ রয়েছে। চেতনার গভীরে গেলে এই দুটিরই পৃথক পৃথক অস্তিত্ব ধরা যায়, একটি ‘ওঁ’ আর একটি ‘ব্যোম’। ওঁ-এর শব্দ Continuous ওঁ…….। ওং—ওং এরূপ নয়—নিরবচ্ছিন্ন একটা শব্দের প্রবাহ ! কিন্তু অপরটি ছেদযুক্ত__ ব্যোম্-ব্যোম্-ব্যোম্ এইরূপ ! প্রথমটিতে এই মহাজগতের সৃষ্টি আর শেষেরটিতে লয়। মধ্যিখানটাই যে কোন বস্তুর বা জগতের স্থিতিকাল। বর্তমানে Cosmology-তে Black-hole নিয়ে যে গবেষণা চলছে, তাতে বর্তমান বিজ্ঞানীরা এই hole-গুলির চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। Black-hole, White-hole সম্বন্ধে ওরাও ধারণা করছে, কোনটায় সৃষ্টি আবার কোনটায় লয়।
প্রকৃতপক্ষে এই যে প্রলয়ের নটরাজ-নৃত্য বা মহাজাগতিক নৃত্য অথবা Cosmic dance—এটিই মহেশ্বর তত্ত্ব বা লয় তত্ত্ব। অনাদিকাল থেকে সৃষ্টির সাথে সাথেই লয়ও হয়ে চলেছে। রুদ্র যেন সদা-সর্বদা "তা-থৈয়া- তাতা-থৈয়া" নেচে চলেছেন __আর তার নৃত্যপথে যখন যে আসছে তা গ্রহ-নক্ষত্রই হােক বা সৌরমণ্ডল অথবা গ্যালাক্সিই হােক না কেন __তা মুহূর্তে লয় হয়ে যাচ্ছে মহাকালের গহ্বরে ! কালী যেন তাকে মুহূর্তে গ্রাস করে নিচ্ছে। এই অবস্থাটা 'Beyond time and dimension', যা মহাজাগতিক গহ্বর বা কৃষ্ণগহ্বর অথবা Black-hole নামে চিহ্নিত হচ্ছে।
চৈতন্য মহাপ্রভুর নৃত্যের স্পর্শ যেই পেতাে _সে যেমন তার নিজস্বতা হারিয়ে প্রেমাপ্লুত হয়ে যেতাে—এখানে তেমনিই Cosmic dance-এর স্পর্শ পেয়ে গ্রহ-নক্ষত্রাদি, সৌরমণ্ডলও মুহুর্তে তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে Vacuum হয়ে যাচ্ছে ! এই নৃত্যের কিন্তু বিরাম নেই, নিরবচ্ছিন্নভাবে এই নাচ হয়ে চলেছে মহাজগতের প্রতিটি কোনায় কোনায় ! এই নৃত্যের কোন নির্দিষ্ট গতিপথ নেই, শুধু নির্দিষ্ট ছন্দ রয়েছে _আর সেই ছন্দে অন্য কিছু ছন্দিত হোলেই তার লয় ! এই ছন্দময় dance-এর গতিপথের বাইরে যখন যেগুলি থেকে যাচ্ছে __সেটাই মহাজগৎরূপে প্রতিভাসিত হচ্ছে ! এখন আমরা যেমনটা দেখছি_ এই গ্যালাক্সি, এই সৌরমণ্ডল বা এই পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহাদি। কিন্তু Cosmic dance-এর একটু সামান্য স্পর্শেই এই সবকিছু মুহূর্তে finish হয়ে যেতে পারে !
এই 'লয়তত্ত্ব'-টি জেনে _ সব মানুষ যদি জীবননির্বাহ করে, তাহলে কি অহংকার নামক ব্যাপারটি মানুষের মধ্যে জন্ম নিতাে—বােধ হয় না! যাইহােক__ ঐ যে বলছিলাম ওঁ এবং ব্যোম্- এর কথা অর্থাৎ সৃষ্টিএবং লয়, এই দুটির মধ্যের অবস্থাটাই "স্থিতি"। এই যে পৃথিবীটা দেখছাে—এও একদিন ওঁ তত্ত্বে সৃষ্টি হয়েছে _আবার একদিন ঐ Cosmic dance-এ পড়ে লয়প্রাপ্ত হবে ! কিন্তু তা যতদিন না হচ্ছে ততদিনই এই পৃথিবীগ্রহে জীব-বিবর্তন, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, জীবনের হাসিকান্না। তারপর যখন এই খেলাঘর একদিন ভেঙে যাবে __তখন বসবে অন্য কোথাও আবার নতুন কোন খেলার আসর !
প্রকৃতিতে সর্বদাই এইভাবে সৃষ্টি-স্থিতি ও প্রলয় ঘটে চলেছে। পুঞ্জীভূত শক্তির এক-একটা বিরাট গুচ্ছ যেন এইরূপ ধ্বংসকার্য করে চলেছে, তাই ব্যোম্- ব্যোম্ শব্দ। বলা হচ্ছে vacuum কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাে vacuum নয়, শক্তিকণার একটা অতি ঘনীভূত–একটা অন্যরকম অবস্থা—পঞ্চমহাভূত তত্ত্বের মধ্যে (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম্) এটা ব্যোম্ বা space অবস্থা।
তবে নৃত্যরত নটরাজের যে ছন্দময় মূর্তির কথা তুমি বলছো_ এটার চারটে হাতের দ্বারা চার প্রকার মহাজাগতিক force বা বলের কথা বােঝানাে হয়েছে। সেগুলি হল Strong force, weak force, Electromagnetic force, Gravitational force, এইগুলির যে কোন একটি সাম্যতা হারালেই বস্তু তার অস্তিত্ব হারাবে। পায়ের নীচে গােলােক রাখা হয়েছে, তার দ্বারা এই মহাজগৎকে বোঝানো হয়েছে। জগৎকর্তা নৃত্যের ছন্দে যেন নিজেই নিজে বিভাের যেখানে অন্য কোন ভালােলাগা বোধ অথবা অন্যকোন তত্ত্ব ক্রিয়াশীল নয় !
ভারতীয় ঋষিগণ দুটো নৃত্যরত মুদ্রার চিত্ররূপ দিয়েছেন—নটরাজ এবং নটবর। এই যে পরিদৃশ্যমান জগতের বস্তু, বৃক্ষলতা, পশুপাখী, মানুষ আবার পাহাড়, পর্বত, নদী-সমুদ্র, আকাশ—আবার যতকিছু সূক্ষ্ম বা কারণরূপ—এককথায় এই মহাবিশ্বের যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য _ এসব বােঝাতেই ‘নটবর’ মূর্তি। । এরও নির্দিষ্ট গতি আছে, ছন্দ আছে ! সেই ছন্দ বা সেই গতিকে খুঁজে বের করাই জীবনের সাধনা। কারণ সেই ছন্দে জীবনকে ছন্দায়িত করতে পারলে জীবন সহজ হয়ে যায় এবং তখন সহজেই সহজ-স্থিতি লাভ করা যায়। আর এই ছন্দের সন্ধান না পেলে জীবন অসহজ, বিকৃত যেটা আমরা আমাদের চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ পিলপিল করছে—কিন্তু অধিকাংশই যেন অসহজ, বিকৃত ! সহজ মানুষ খুঁজে পেলে তার কাছে জেনে নিতে হয় সহজ হবার মূলমন্ত্র। সংসারের সার খুঁজছে সবাই, সবাই চাইছে রস কিন্তু আভাসমাত্র পাচ্ছে তার। সবারই তাই রসাভাস হচ্ছে রসবােধ আর হচ্ছে না। রসবােধ না হলে পরমানন্দের আস্বাদ কি করে পাবে ! সংসার যে লীলাময়ের লীলা __সেটা তাে বােধ হচ্ছে না, কেবল মনে হচ্ছে সংসার যেন জ্বালা !
কিন্তু জগৎ-সংসারের যা কিছু_ তা আনন্দ থেকেই উৎপত্তি, আনন্দেই স্থিতি, আবার আনন্দেই লয়। তাহলে জ্বালাটা এল কোথা থেকে ? এটাই ভ্রান্তি—যা নেই তাকে আছে মনে করে কষ্ট পাচ্ছে জীব। কিন্তু উপায় তাে কিছু নেই-—যতক্ষণ না তুমি নিজে আত্মবোধে ব্রতী হয়ে “বােধে বােধ ” করার চেষ্টা করছ, ততক্ষণ লীলাকে জ্বালাই বােধ হবে ! স্বপ্নে যেমন মানুষ বাঘ দেখে, ভূত-প্রেত দেখে ভয় পায় – ঘেমে যায়—কেউ কেউ পায়খানা-প্রস্রাবও করে ফেলে–এখানেও ব্যাপারটা তেমনি হয়।
জিজ্ঞাসু :– আপনি সকলকেই ভালােবাসেন কিন্তু মানুষও আপনাকে ভালােবাসে, নয় কি ?
গুরুমহারাজ :– আমার দেহটাকে ভালােবাসে, ‘আমাকে’ আর কই ভালােবাসতে পারল ! তবে ভালােবাসার অত্যাচারটা আমাকে খুবই ভোগ করতে হয়_সেটা জানিস না তাে ! এখানেই অনেকে আছে যারা প্রণাম করার সময় আমার পায়ে কামড়ে দেয়, আঁচড়ে দেয়—জানিস এসব ? মেয়েরা প্রণাম করার সময় আমারপায়ে সিঁথির সিঁদুর ঘসতে গিয়ে কাপড়ে, বসার আসনে সিঁদুরে মাখামাখি করে। ওগুলাে আবার আমাকে সাবান দিয়ে ঘসে ঘসে তুলতে হয়। আর আমার চামড়া এত নরম যে, একটু ঘসলেই জ্বালা করে-লাল হয়ে যায় ! বেশী লােকজন এলে প্রচুর দানাদার(মিষ্টি) প্রসাদ দিতে হয়, এতে দানা দানা চিনি থাকে ! ফলে আমার ডান হাতের বিশেষ তিনটি আঙুলের ডগা বারবার চিনির সাথে ঘসা খেয়ে এমন ক্ষয়ে যায় যে, অনেক সময় আঙুলের ডগা দিয়ে রক্ত পড়ে।
আবার কারও বাড়ি গেলে “বাবা”র(গুরু মহারাজ) জন্য পঞ্চব্যঞ্জন রাঁধতে গিয়ে হয় দেরি করে খেতে দেয়, না হয় কোনটায় নুন বেশী, কোনটায় এত ঝাল দেয় যে ভালো করে খাওয়াই যায় না। কিন্তু তাদের ভালােবাসার মান রাখতে গিয়ে কিছুটা খেতেও হয়।
পুরুলিয়ার একটা বাড়িতে ভাতের সঙ্গে এক রকমের ভাজা দিয়েছে, আমি ভাবছি হয়ত চিংড়িমাছ ভাজা। খাওয়ার শেষে ওদের একজন বলল,_ ‘বাবা কি খেলে বল দেখি—ওগুলাে পলুপােকা ভাজা’। ভাবো একবার!
গঙ্গাবাবুর সাথে একবার গাড়িতে আসানসােল যাচ্ছিলাম, হঠাৎ গঙ্গাবাবুর খেয়াল হােল যে, দুর্গাপুরে ওদের এক আত্মীয়ের বাড়ি আমাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিয়ে যাবে। গঙ্গাবাবুর অনুরােধ ফেলতে পারলাম না_ গেলাম সেখানে। ওরা তাে কিছুই জানে না ফলে ওদেরও একটা অপ্রস্তুত অবস্থা ! বাড়িতে কোন বেটাছেলে নেই, সবাই কাজে বেড়িয়েছে এবং বাড়ির গৃহিণী তখন সবে খেতে বসেছে—এমন সময় দরজায় খটখট্। এবার ভাবাে সেই মহিলার অবস্থাটা কি ! একে গঙ্গাবাবুই তাদের কাছে গুরুতুল্য_ আবার তার সাথে গঙ্গাবাবুর গুরুদেব !ঐ বাড়ির ভদ্রমহিলা এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, আমাকেই বলতে হল–"আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমরা বসছি আপনি খেয়ে নিন_ আমরা এক্ষুনি চলে যাব।” ভদ্রমহিলার আর খাওয়া হয় ? কোনক্রমে উঠে জায়গাটা পরিষ্কার করে এসে প্রণাম ইত্যাদি সারলো। বাড়িতে কেউ নেই দেখে গঙ্গাবাবু বললেন, “মা_ আমরা তাহলে এখন যাই।" সে কি হয়–কিছু না খেলে যে গৃহস্থের চরম অকল্যাণ ! তখন বলা হল যে, "শুধু একগ্লাস জল।” এবার উনি পাশের ঘরে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘটর ঘটর করে কি করছেন কিছুই বুঝতে পারছি না, আমাদেরও দেরি হচ্ছে -–অধৈর্য হয়ে উঠছে গঙ্গাবাবুও। তারপর দেখা গেল উনি চেয়ার লাগিয়ে উপরের বাঙ্কে থাকা বাক্স থেকে ঠাকুরের ব্যবহারের পাথরের গ্লাস পাড়ছেন। কারণ গঙ্গাবাবুর গুরুদেবকে তাে আর যে সে গ্লাসে জল দেওয়া যায় না!
এরপর সেই গ্লাস ধােয়ামাজা করে যখন আধঘণ্টা পর জল এসে পৌঁছালো_ তখন দেখি ঘােলাজল ! আমি বুঝলাম যেহেতু originally এরা কাটোয়া অঞ্চলের লোক তাই এটি কাটোয়ার গঙ্গা থেকে ঠাকুরের জন্য আনা গঙ্গাজল ! কি আর করা যায়–ভক্তের ভক্তির মান রাখতে তাই এক ঢােক গিলে নিলাম, তারপর ওখান থেকে বিদায়। এসব শুনে কি তােমাদের মনে হচ্ছে না যে গুরুদেব হয়ে আর কাজ নেই।
আসানসােলে যাদের বাড়ি গেলাম, তাদের বাড়ির ছেলে নিজেদের গাড়ি নিয়ে আমাকে ঘোরানোর সময় G.T.Road-এ উঠে গাড়ির স্পীড ৮০ থেকে বাড়িয়ে ১০০- ১০৫ কিমি পর্যন্ত দিয়ে দিচ্ছিল। এর কারণ জানতে চাইলে ও বলেছিল যে, গুরু মহারাজ গাড়িতে থাকলে তাে আর accident হবে না। এমনিতে এত speed-এ চালাতে পারি না ভয়ে, তাই এখন মহারাজকে গাড়িতে চাপিয়ে শখ মিটিয়ে নিচ্ছি ! তাহলে ভালােবাসার মান রাখতে গিয়ে আমি শখ মেটাবার মাধ্যমও হলাম। এরকম কত অত্যাচারের কথা বলব ? বেশী বললেই তােমাদের মন খারাপ হয়ে যাবে, তােমরা তাে আর মজাটাকে মজা হিসাবে নিতে পারাে না।