জিজ্ঞাসু :– দেহসৌষ্ঠব বা দৈহিক সৌন্দর্যের দিক থেকে আরবীয়রা কি সুন্দর?
গুরুমহারাজ :– রুক্ষ্ম প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় আরবীয়দের। ফলে ওদের শরীর মজবুত হয়। ওই দেশের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সৌদিয়া আরবিয়া’ — যার অর্থ সৌভাগ্যের দেশ। হজরত মুহাম্মদের যেহেতু ওই দেশে জন্মগ্রহণ হয়েছিল— তাই সৌদিয়া আরবিয়া। তবে দ্যাখো, হজরতের জন্মের আগে দেশটার কি হাল ছিল? বেদুইন, যাযাবরের দল ! ধু ধু মরুভূমি আর মাঝে-মধ্যে কয়েকটি মরুদস্যুদের ট্যাঁবো, হয়ত কোন মরুদ্যানকে কেন্দ্র করে। পশুপালক যাযাবর জাতি ছিল ওরা। না কৃষ্টি-সংস্কৃতি, না চাষবাস, না সুস্থ সমাজজীবন ! রক্তপাত, লুটপাট, যুদ্ধবিগ্রহ এইসব নিয়েই ছিল আরবীয়দের সমাজ। খাদ্যের বা অর্থের প্রয়োজনে ওরা প্রায়ই পারস্য, মেসোপটেমিয়া এমনকি ভারত সীমান্তেও ঢুকে পড়তো, লুটপাট করতো। ধনরত্ন, খাদ্যসামগ্রী ছাড়াও নারীদের লুট করে নিয়ে যেতো। আরবীয়ান মেয়েরা বেশিরভাগ বন্ধ্যা হয়, তাছাড়া ওখানকার মেয়েদের বড় বড় গোঁফ হয়। তোমরা হাসছো — কিন্তু এটা ঘটনা। বোরখার আড়ালে হয়তো বোঝা যায় না কিন্তু যার কন্যা বা যার স্ত্রী তারা তো ব্যাপারটা জানে!
তুমি এখনই সৌন্দর্যের কথা বলছিলে, তোমার স্ত্রীর যদি বড় বড় গোঁফ থাকতো_ তো তোমার সৌন্দর্যবোধ ছুটে যেতো ! এইসব কারণেই আরবীয়ানরা অন্যান্য প্রদেশের মেয়েদের ধরে নিয়ে যেতো। অবশ্য এই ব্যাপারটা অর্থাৎ নারীপাচারের কাজটা এখনও চলছে । ভারত, পাকিস্তান বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশগুলি থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার নারী পাচার হয়ে ঐ সব দেশে চলে যায়।
কিন্তু আরবের আমূল পরিবর্তন ঘটালেন হজরত মুহাম্মদ। তিনিই আরব দুনিয়ার ত্রাণকর্তা। সমস্ত বেদুইন গোষ্ঠীকে united ও সমাজবদ্ধ করলেন তিনি। প্রথমজীবনে প্রচুর সাধনা করে উনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। ওনার উপর আল্লাহর নির্দেশ হলো এই জাতির ত্রাণকর্তা হিসাবে কাজ করতে। যুদ্ধপ্রিয়, যাযাবর, উচ্ছৃঙ্খল ও ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জীর্ণ জাতিটার তিনি সংস্কারসাধন করলেন। বড় কঠিন ছিল সেই কাজ। পিতার বংশ পৌত্তলিক, বাকিরা কেউ পেগান অথবা বে-দীন। উনি সকলকে একেশ্বরবাদের মন্ত্র শেখালেন — পৌত্তলিকতার অবসান ঘটালেন ! নিজে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করলেন, যুদ্ধে জিতে বাকিদের স্বমতে আনলেন। উনি জীবনে তিনবার যুদ্ধ করেছিলেন এবং "অহদের যুদ্ধে" তিনি সামান্য আহতও হয়েছিলেন। 'হজরত' শব্দের অর্থ মহান। মহান মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের জীবনে আচরণ করে তিনি সাথীদের শিক্ষা দিতেন। আরবের মরুভূমিতে নিত্য প্রয়োজনীয় যে কোনো সামগ্রীই "বহুত কিমতি চিজ্"। এখনও ওখানে কৃষ্টি ভালো নয়, শিল্প নেই বললেই চলে। তাহলে আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে কি ছিল! এখন তো তেল আছে অর্থাৎ পয়সার প্রাচুর্য রয়েছে, তখন তো তাও ছিল না — ফলে Hard-Life বলতে যা বোঝায় আরবীয়দের সমাজজীবন তাই ছিল। তাই তিনি খুব ছোটখাটো ব্যাপারেও অপচয় না করা বা সরল-সাধারণ জীবন-যাপনের ব্যাপারে শিক্ষা দিতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মানুষ তাঁর শিক্ষার যথার্থতা অনুভব করতে না পেরে তার ভুল প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগ করেছে।
যেমন তিনি নিজের জামা নিজে সেলাই করতেন, জীর্ণ হয়ে গেলেও তিনি তালি বা পট্টি লাগিয়ে পরতেন। অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন জীর্ণ পোশাকের ভালো অংশগুলো কেটে কেটে নিয়ে একটা আলাদা বস্ত্র বানিয়ে সেটাকেই গায়ে পরতেন। পরবর্তীকালে ফকির, আউল, দরবেশ ইত্যাদিরা নতুন নতুন ভিন্ন রঙের ছিট কিনে ওই ধরনের জামা বা আলখাল্লা পোশাক হিসাবে ব্যবহার করে। তিনি কি শেখাতে চাইলেন আরএরা কি শিখল! মরুভূমিতে জল হচ্ছে সোনা-দানা বা হীরা-জহরতের থেকেও দামী। তাই জলের অপচয় রোধ করার জন্য তিনি এক “বদনা” বা এক লোটা জলেই পাঁচওয়াক্ত নামাজের ‘ওজু’ সারতে বলতেন। কিন্তু ‘ইসলাম’ যখন এসব দেশে অর্থাৎ সমভূমিতে প্রচারিত হলো তখন আর এটাতো আরবের মরুভূমি নয়_এখানে প্রচুর জল, ফলে এখানে সুন্দরভাবে বেশি জল খরচ করেই ওজু করা যায় — তাই নয় কি? কিন্তু এখানকার লোকেরা এখনো মসজিদে প্রচুর অ্যালুমিনিয়ামের বদনা রাখে আর সেই জলেই পাঁচ বার ‘ওজু’ সারে!
উনি(হজরত) হাত ধোয়ার জল, আঁচানোর জল সাধারণত উনি যেখানে খেতেন সেই স্থানের সামনেই ফেলতেন ! এর কারণ হিসাবে বলা যায় যেহেতু এ সমস্ত অঞ্চল পুরোটাই মরুভূমি তাই একটু হাওয়া দিলেই প্রচন্ড বালি উড়ে এসে পড়ে। এইজন্যেই উনি সামনেটায় জল ফেলতেনফলে বালি ভিজে যেতো এবং তা উড়ে এসে ভেতরে ঢুকতো না। কিন্তু সেই রীতি follow করে এখানকার কোন গ্রামের লোক যদি তার ঘরের সামনেটায় এঁটো জল ফেলে কাদা জবজব করে রাখে, তাহলে সেটা বোকামি হবে এবং বাড়িটায় চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হয়ে যাবে। তারপর যদি দু-চারটে মুরগি থাকে-তাহলে তো আর দেখতে হবে নাসে বাড়িতে ঢোকাই দায়ের !
তৎকালীন ধনী মহিলা খাদিজাকে বিবাহ করার পর থেকেই তাঁর অর্থের অভাব কখনো হয়নি, তবু তিনি সবসময় সহজ-সরল-অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। অল্প খাদ্যগ্রহণ এবং সারাদিনে অল্প জল খরচ করতেন। ভিন্ন ভিন্ন বেদুইন গোষ্ঠীকে এক ছত্রছায়ায় এনে তাদেরকে জীবনের কলা ও বাঁচার মন্ত্র শিখিয়েছিলেন হজরত মুহাম্মদ।
তুমি একটু আগে আরবীয়দের সৌন্দর্যের কথা বলছিলে না__তাই আরবের সবচাইতে সুন্দর মানুষটির(হজরত মুহাম্মদ) কথাই আমার মনে পড়ল। প্রকৃত সুন্দরের গুণগান গেয়েই তো মানুষ সুন্দর হয়ে ওঠে। তাই মহাজনগণ বলেন "Be good, see good, do good."
জিজ্ঞাসু :– আপনি বিভিন্ন dimension-এর কথা বলেন — সেগুলি ঠিক ঠিক যদি একটু বুঝিয়ে বলেন?
গুরুমহারাজ :— হ্যাঁ, সাতটা dimension রয়েছে। তারমধ্যে three dimension সম্বন্ধে তোমাদের সকলেরই ধারণা রয়েছে অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা। এই যে পরিদৃশ্যমান জগৎ অর্থাৎ গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, বাড়িঘর ও জীবজন্তু নিয়ে যে জগৎ — এটা three dimension। One dimension হবে বিন্দু, Two dimension-এ যে কোন ছবি অর্থাৎ যার দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ আছে। আর three dimension হচ্ছে যে কোন স্থুল বস্তু_যাদের দৈর্ঘ্য,প্রস্থ এবং উচ্চতা রয়েছে। তাহলে এক, দুই, তিন বুঝলে এবার fourth dimension হচ্ছে time বা কাল। যে কোন বস্তুর আকার, অবস্থান, ধর্ম সবই কিন্তু একটা নির্দিষ্ট time-এর মধ্যে একরকম থাকছে, আবার ঐ সময়ের পর বস্তুটির আকার, অবস্থান ও ধর্মের পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। সমস্ত ক্ষেত্রেই এই একই নিয়ম প্রযোজ্য! তাই ‘কাল’ বা time হোল fourth dimension। আধুনিক কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টীফেন্স হকিন্স তো “কাল” নিয়ে কালজয়ী একটা বই লিখে ফেলেছেন — “A brief history of time.”
Fifth dimension-এ আসছে মন। যা কিছু দেখছ, ভাবছ, উপলব্ধি করছ এসবই মন নিয়ে। কতকগুলো উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি! একটা খ্যাপা-পাগল রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেও সে কিন্তু অনেক কিছুই দ্যাখে না কারণ তার মনোজগতে বিশৃঙ্খলা চলছে ! শিশুরা অপরিণত মস্তিষ্কসেখানেও মনোজগতের ক্রিয়া স্বাভাবিকের তুলনায় কম, সেইজন্য তারাও অনেক কিছু দেখে_ কিছু বোঝে বড়দেরমতো অতটা গুরুত্ব দেয় না বা বোঝে না ! কোন ব্যক্তির যদি মন ভাল না থাকে তাহলে চিত্তাকর্ষক বস্তু বা উল্লেখযোগ্য ঘটনাও সেই মুহূর্তে তাকে প্রভাবিত করতে পারে না ! আবার দেখা যায়গভীর মনঃসংযোগ হয়ে গেলে তখন আর বাইরের দৃশ্য চোখে দেখা যায় না, বাইরের শব্দ কানে শোনা যায় না — এটা যারাই ধ্যান করে তারা প্রত্যক্ষ করেছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছিপে মাছ ধরতে বসা কোন ব্যক্তির মাছে টোপ ধরলে যেমন মন একাগ্র থাকেতার উদাহরণ দিতেন!
Sixth dimension-হোল বুদ্ধি। কারণ মন সবকিছুকে receive করে, কিন্তু বুদ্ধিই তাকে নিশ্চয় করে। বুদ্ধি সেই বিষয়কে না ধরলে তা মনেও বেশিক্ষণ স্থান পায় না। আর Seventh dimension-এ হচ্ছে অহংতত্ত্ব।
মানুষেরা যে বস্তুকে Three dimension দেখে পিঁপড়েরা সেটাকেই Two dimension-এ দেখে। পিঁপড়ের উচ্চতাবোধ থাকলে খাড়া উঠতে পারতো না। আবার fourth dimension থেকে যদি কোন three dimensional বস্তুকে দ্যাখো তাহলে সেটা হয়ে যাবে বৃত্তাকার ! ওই একই বস্তুকে fifth dimension থেকে যদি কেউ দেখে তাহলে সে শুধুই আলো বা জ্যোতি দেখবে। Sixth dimension থেকে সেই বস্তুকেই দেখবে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তারার মতো ঝিকমিক্ ঝিকমিক্ অবস্থা। আর seventh dimension থেকে দেখবে সবকিছুই যেন বিস্ফারগর্ভ ঘননীল। এরপর অবাঙমনসগোচর। যারা নিয়মিত ধ্যানাভ্যাস করে তাদের প্রত্যেকেরই উন্নততর কোন না কোন dimension-এর রূপদর্শনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
Seventh dimension-কে যিনি করায়ত্ত করেছেন, তিনি একস্থানে বসে দূরবর্তী যে কোন স্থানের সব খবর বলতে পারেন। তাঁর কাছে দূর বলে কিছু নেই। এই অবস্থায় শুধু নিজে দেখা নয় তিনি অপরকে দেখাতেও পারেন। এমনকি তাঁর নিজের অন্তঃস্থ শক্তি মে কোন নির্দিষ্ট রূপকে Three dimension-এ projection-ও করতে পারেন। ফলে শুধু তিনি নিজে নন তাঁর আশেপাশের জনও Projected রূপ দেখতে পেতে পারে। একই সময়ে তিনি নিজে অনেক রূপ পরিগ্রহ করে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিরাজ করতেও পারেন। এগুলো অলৌকিক কিছু নয়, উন্নত বিজ্ঞানের প্রয়োগমাত্র !
Sixth dimension-এর স্থিতিতে যাঁরা আছেন, তাঁরাও একস্থানে থেকে অন্য দূরবর্তী স্থানের ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এমনকি চিন্তার তরঙ্গ পাঠিয়ে তাকে নির্দেশ দেওয়া বা তার কোন মঙ্গলসাধনও করতে পারেন। উচ্চকোটির মহাত্মারা এইভাবেই কোন গিরিগুহায় থেকেও দূরবর্তী কোন শরণাগত ভক্তকে রক্ষা করেন ও তার পথভ্রষ্ট অবস্থা থেকে উন্নীত করেন বা তার আধ্যাত্মিক জীবনে উন্নতির পথ সুগম করে দেন। এসবের বহু নজির সাধুসমাজে রয়েছে।
এবার কথা হচ্ছে মানুষ কি করে বিভিন্ন dimension-এর অবস্থা লাভ করতে পারবে? উপায় একটাই — নিষ্ঠাপূর্বক সাধন-ভজন করে যাওয়া, গুরু যে পথ বলেই দিয়েছেন, তোমার কাজ শুধু নিষ্ঠাপূর্বক সেই পথ ধরে সাধন করে যাওয়া। আমি তোমাদের যে Art of life- Art of living-এর কথা বলি — এই ‘জীবনের কলা’র বা ‘বাঁচার কলা’র মূলভিত্তি কি বলো তো — সংযম ! কোন মানুষের জীবনে যদি সংযম একবার করায়ত্ত হয়, তাহলে সে অনেকটাই এগিয়ে গেল। সংযমই তাকে অভীষ্টের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে। বহু সাধকের জীবনে সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় সেই জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে। এই যে কথাটা_ “সংযমের বাঁধ” বা আগল, তার মানে টা বুঝলে কি এটি সাধককে সর্বদা অধঃপতন থেকে রক্ষা করে।
সাধনার একদম শেষে আসে শরণাগতি, সেই অবস্থায় আর প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় না_ এটাই বেদ-বিধি বহির্ভূত অবস্থা। কোন নিয়ম, কোন বিধি-নিষেধের আর প্রয়োজন নেই। শরণাগত অবস্থার জীবনটাই তখন আবার সমাজে অন্যদের কাছে অনুসরণের জীবন, আদর্শের জীবন হয়ে ওঠে। তাই আধ্যাত্মিক জগতেউন্নতির জন্য প্রথম শর্ত সদগুরুর আশ্রয়ে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ এবং নিষ্ঠাপূর্বক সাধন-ভজন করা ! দ্বিতীয় শর্ত জীবনে সংযমের বাঁধ বেঁধে দেওয়া ! তাহলে ধীরে ধীরে শরণাগত অবস্থা এমনিতেই এসে যাবে — তখন সেই হয়ে উঠবে প্রকৃত অর্থে_ “জগদম্বার বালক”।