স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন ৷ সময় ~ ১৯৯২, ডিসেম্বর। ।। উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ আশ্রমস্থ ও বহিরাগত ভক্তবৃন্দ ।।
জিজ্ঞাসু :— আচাৰ্য্য শঙ্করের ন্যায় ঈশ্বরাবতারকে দেশে দেশে পন্ডিতদের সাথে তর্ক করতে হয়েছিল কেন ?
গুরুমহারাজ :– শঙ্করাচার্য্যের আগে ভারতবর্ষে ষড়দর্শনের মধ্যে পাঁচটি দর্শন অর্থাৎ বৈশেষিক,ন্যায়,সাংখ্য,রোগ ও পূর্ব মীমাংসার সিদ্ধান্ত স্বীকৃত ছিল। আচাৰ্য্যশঙ্কর উত্তর মীমাংসায় ‘অদ্বৈতবাদ’কে প্রতিষ্ঠা করলেন। আচার্য্য প্রতিষ্ঠা করলেন—”সঃ ব্রহ্ম নির্বিশেষঃ”_এটাই বেদান্তের উত্তর মীমাংসা। যাইহােক ঘটনা হয়েছিল কি, কুমারিল ভট্টের সুযােগ্য শিষ্য মণ্ডন মিশ্র ন্যায়বাদী মহাপণ্ডিত ছিলেন। যুক্তিজাল সৃষ্টি করে বিভিন্ন মতকে খণ্ডন করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। উত্তর ভারতে তৎকালে তাঁরমতাে মহাপণ্ডিত আর কেউ ছিল না। সেইসময় এটাই নিয়ম ছিল যে, সেই অঞ্চলের বিখ্যাত বিখ্যাত পণ্ডিতদের তর্কে পরাজিত করতে পারলেই সেই অঞ্চলের বাকি সমস্ত পণ্ডিতরা ঐ বিজয়ী পণ্ডিতের মতকে গ্রহণ করবে অথবা তার শিষ্যদেরকে বিজয়ীর হাতে তুলে দিয়ে পরাজিত পন্ডিত অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে নিজে অগ্নিতে আত্মাহুতি দেবে।
শিবাবতার আচাৰ্য্যশঙ্কর যুগপ্রয়োজনে তাঁর দ্বারা সৃষ্ট_বেদান্তের শ্রেষ্ঠ প্রতিপাদ্য বিষয় ‘অদ্বৈতবাদ’ প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের জন্য অত্যল্প বয়স থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বিভিন্ন পণ্ডিত, সাধু-সন্ত, জ্ঞানী-গুণীজনের মধ্যে তাঁর এই মতকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। তখন বৌদ্ধ ধর্মাচার্যদের প্রভাব ভারতবর্ষে এত বেশি বিস্তারলাভ করেছিল যে, বৈদিক পণ্ডিতরা বৌদ্ধ পণ্ডিতদের সাথে এঁটে উঠতে পারছিল না। বিশেষত নাগার্জুনের ন্যায় মহাপণ্ডিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-সম্বলিত যুক্তির অবতারণা করে_ বৈদিক মতাদিকে খণ্ডন করে দিচ্ছিলেন। ফলে বৈদিক ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আচার্য্যের আগমন যে যুগােপযােগী ছিল _এতে কোন সন্দেহ নেই !
মণ্ডন মিশ্রের প্রথম গুরু কুমারিল ভট্র অবশ্য তার প্রথম জীবনের (কুমারিল প্রথম জীবনে ছাত্রাবস্থায় বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত জিজ্ঞাসাদিতে বৌদ্ধ বিহারের আচার্যদেরকে অতিষ্ঠ করে রাখতেন। এতে অন্য ছাত্ররা ইর্ষান্বিত হয়ে এবং শিক্ষকরা বিরক্ত হয়ে কুমারিলকে ছাদ থেকে পাথরের উপর ফেলে দিয়ে মারার চেষ্টা করেছিল। কয়েকজন সনাতনপন্থী সন্ন্যাসী তাকে বাঁচান এবং তাদের আশ্রয়ে রেখে ওকে সুপন্ডিত হিসাবে গড়ে তোলেন। এরপর থেকে কুমারিলের কাজই ছিল বৌদ্ধ পন্ডিতদের তর্কযূদ্ধে পরাজিত করে তাঁর স্বমতে আনা।) বৌদ্ধ গুরুকে তর্কে পরাজিত করেছিলেন ন্যায়ের যুক্তির সাহায্যেই। কুমারিলের আত্মবােধ বা ব্রহ্মবোধ ছিল না কিন্তু শুধুমাত্র বিদ্যা-বুদ্ধি-তর্ক ও যুক্তির সাহায্যে উনি তৎকালীন বৌদ্ধপন্ডিতদের মতকে খণ্ডন করতেন এবং ওনার ছোটবেলার বৌদ্ধগুরু ধর্মপালকেও একই যুক্তিতে পরাস্ত করেছিলেন। এতে ঐ বৌদ্ধগুরু লজ্জায়, পরাজয়ের গ্লানি সইতে না পেরে আত্মঘাতী হন। কুমারিল ক্রোধের বশে এবং ছোটবেলার ঘটনার প্রতিশোধস্পৃহায় গুরুকে পরাজিত করেছিলেন ঠিকই কিন্তু গুরুর ঐ করুন পরিণতির পর তিনিও আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হতে থাকেন। অবশেষে তিনি স্থির করেন যে, প্রয়াগের পুণ্যতীর্থে তুষানলে এই পার্থিব শরীরকে ধীরে ধীরে সজ্ঞানে দগ্ধ করে প্রাণত্যাগ করবেন যাতে গুরুহত্যাজনিত তাঁর পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয় !
এদিকে আচাৰ্য্য শঙ্কর যখন তাঁর ‘অদ্বৈতবাদ' প্রচারের জন্য উত্তর ভারতের বিভিন্ন পণ্ডিতদের আহ্বান করলেন বা তাঁদের কাছে গেলেন—তখন তিনি বিখ্যাত পণ্ডিত কুমারিলের নাম শােনেন। বিভিন্ন পণ্ডিতেরা তাকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, সমগ্র উত্তরভারতে একমাত্র কুমারিল ভট্টকে তর্কে পরাস্ত করতে পারলেই বাকিরা শঙ্করের এই নতুন মত মেনে নেবে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই সুদূর দক্ষিণ থেকে উত্তরে আগমন শঙ্করের। কুমারিলের আশ্রমে গিয়ে তিনি শুনলেন যে, কুমারিল গুরুহত্যার পাপ স্খলনের নিমিত্ত প্রয়াগে গিয়েছেন তুষানলে প্রাণত্যাগ করতে। ছুটলেন শঙ্কর সেখানেও, প্রয়াগে গিয়ে দেখেন কুমারিল দেহত্যাগের সঙ্কল্প গ্রহণ করে তুষানলে প্রবেশ করেছেন। অর্ধদগ্ধ অবস্থাতেই শঙ্কর শোনালেন উত্তর মীমাংসার সূত্রসমূহ –বােঝালেন ‘অদ্বৈতবাদ।' পরম শান্তি পেলেন মৃত্যুপথযাত্রী কুমারিল। খুব আশীর্বাদ করলেন এই নবীন সন্ন্যাসীকে আর বললেন ঃ “আমার আর সময় নেই নাহলে তােমার এই মত আমিই প্রচার করতাম । এখন আমার শিষ্য রয়েছে মণ্ডন মিশ্র, তাকে এই তত্ত্ব বােঝাও, সে গ্রহণ করলেই সমগ্র ভারতবর্ষে এই মতের বিরােধিতা আর কেউ করতে সাহস পাবে না। আর হে নবীন সন্ন্যাসী! জানিনা তুমি কে—তবু তােমার এই মীমাংসা ("অদ্বৈত-মত")মৃত্যুর পূর্বে আমার মনে অপার শান্তি এনে দিয়েছে! এর কারণ এই যে, আমি আমার বৌদ্ধগুরুর মতগুলি শুধু যুক্তিজাল দিয়ে খণ্ডন করেছিলাম—কোন বােধের স্থিতি থেকে নয়। কিন্তু তােমার “অদ্বৈত তত্ত্ব" শুনে বুঝলাম বেদ যথার্থ, বেদের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত, সুতরাং আমি মিথ্যাবাদী নই, আমার গুরুর মতই ভ্রান্ত ছিল— -এটা জানতে পেরে আমি খুবই শান্তিলাভ করেছি। আমার মৃত্যুতে আর কোন দুঃখ নাই।” এই বলে শঙ্করের সামনেই কুমারিল ধীরে ধীরে দেহত্যাগ করলেন। আর কুমারিলের কথামতাে শঙ্করকে যেতে হল মণ্ডন মিশ্রের গৃহে তার সাথে তর্কে প্রবৃত্ত হবার জন্য।
ভারতীয় ষড়দর্শনে গৌতমের ন্যায়দর্শন থেকেই যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। ন্যায়মতে সৃষ্টিকর্তা নিজ নিজ কর্ম অনুযায়ী জীবকে কর্মফল প্রদান করেন। কপিলমুনি তাঁর রচিত সাংখ্যে এই মতকে কিছুটা অস্বীকার করেন। সাংখ্য বলে—ভালাে কর্মের ভালাে ফল, খারাপ কর্মের খারাপ ফল, এতে আবার সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বরের কর্মফল প্রদানের ভূমিকাটি কি ? সৎকর্মবাদ—অসৎকর্মবাদ, এই যুক্তি খুবই strong, 'শ্রেয়' ও ‘প্রেয়’-র ধারণা দিল সাংখ্য। বলা হ’ল অনিত্য লাভের জন্য যা করা হয় তা ‘প্রেয়’, আর নিত্যবস্তু লাভের জন্য যা করা হয় তাই 'শ্রেয়'। সাধারণ জীবসকল 'প্রেয়’কে চেয়েই দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে আবার সে 'শ্রেয়' অভিলাষী হলেই তার শান্তিলাভ হবে। সুতরাং সাংখ্যমতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা তার কর্তৃত্বভাবকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
পূর্বমীমাংসায় জৈমিনি বললেন জ্ঞানশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও ক্রিয়াশক্তির কথা। ক্রিয়াশক্তির প্রভাবে যে কোন কাজই করা হােক না কেন তার পূর্বে ইচ্ছাশক্তির ভূমিকা রয়েছে। এই ইচ্ছাশক্তি আবার জ্ঞানশক্তির উপর নির্ভরশীল। এখানে পুরুষ ও প্রকৃতির কল্পনা করা হােল। বলা হােল—এক হতে বহু হবার যে ইচ্ছা এবং তারই ফলে প্রকাশিত প্রতীয়মান এই জগৎ, অর্থাৎ জ্ঞানশক্তির কারণে ইচ্ছাশক্তির দ্বারা ক্রিয়াশীল যা কিছু তাই “প্রকৃতি”, আর যাঁর জ্ঞানশক্তি তিনিই পরুষ। সাংখ্যে ঈশ্বরকে অস্বীকার করা হলেও পূর্বমীমাংসায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হ’ল। পুরুষ-প্রকৃতির এই দ্বৈতবাদ পুরুষ বা পরমেশ্বরকে স্বীকার করল। সৎকর্মবাদ এবং অসৎকর্মবাদের তত্ত্বও এই মীমাংসায় সিদ্ধ হােল। কারণ যে কেউ ইচ্ছা করলেই সৎকর্ম করতে পারে না, মানুষ তার নিজ নিজ স্বভাব বা প্রকৃতি অনুযায়ীই কর্ম করে। মানুষসহ সমস্ত জীবই প্রকৃতির অধীন। তাই অন্তঃপ্রকৃতি সহ বহিঃপ্রকৃতিকে জয় করার চেষ্টাই পরমেশ্বরের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
যাইহােক, এগুলি সবই ছিল যুক্তিভিত্তিক মতামত। এবার এলেন আচাৰ্য্যশঙ্কর। বেদান্তভাষ্য রচনা করলেন তিনি—এটাই উত্তর-মীমাংসা। তিনি সাধনার গভীরে ডুব দিয়ে বােধ করলেন প্রকৃত সত্য বােধে বােধ করলেন অদ্বৈত তত্ত্ব। এরপর তিনি প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হলেন অদ্বৈতবাদ। এটাই ভারতীয় ঋষিপরম্পরার ক্রম – আগে নিজে জানাে, তারপর অপরকে জানাও আগে নিজে বােঝ, তারপর অপরকে বােঝাও। “আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখায়”। উত্তর মীমাংসায় তিনি সিদ্ধান্ত করলেন—‘ব্রহ্ম সত্যং, জগন্মিথ্যা, জীবঃব্রহ্মৈব নাপরঃ’। তিনি জগৎকে ‘মায়া’ বা মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিলেন, বললেন _এক ব্রহ্মই রয়েছে দ্বিতীয় আর কোনকিছুই নেই–“একমেবাদ্বিতীয়ম”। ‘ন পূণ্যং ন পাপং ন সৌখ্যং ন দুঃখং…চিদানন্দরূপঃ শিবােহহং শিবােহহম।’ তিনি বললেন—সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ইত্যাদি কোন দ্বৈতই নেই, এসব যা কিছু প্রতীয়মান হচ্ছে সমস্তই অনিত্য, সমস্ত কল্পনা, সমস্ত মায়া। এক তিনিই আছেন, আর এটা যখন ‘বােধ’ হবে তখন দেখা যাবে “তিনিই আমি” সােহহং-সােহহং। “বিশ্ব অহং” আর “ব্যক্তি অহং” Universal ego এবং Individual ego ! ক্ষুদ্র অহং বা ব্যক্তি অহং ত্যাগ করতে পারলেই জীব বিশ্ব অহং বা Universal ego-র স্পর্শ পেয়ে যায়। তখন ব্রহ্মের বােধে বােধ হয়, তখনই সিদ্ধান্ত হয়, “সঃ ব্রহ্মঃ নির্বিশেষঃ”।
জিজ্ঞাসু :– কোরান এবং বাইবেলে অনেক মিল রয়েছে—এরূপ থাকার কারণ কি ?
গুরুমহারাজ :— কোরান, বাইবেল এসব ধর্ম গ্রন্থ পড়েছ কি ? যদি পড়ে থাকো, তাহলেও কিন্তু ভালাে করে পড়া হয়নি। কারণ ভালো ভাবে পড়া থাকলে কোথায় মিল রয়েছে_ কোথায় নেই ,তা বুঝতে পারতে ! দ্যাখাে _বেশিরভাগ মানুষ তােমারই মতাে ভাসাভাসা ধারণা নিয়ে চলে। জিজ্ঞাসা করতে হয়— তাই হয়তাে কিছু জিজ্ঞাসা করে বসলো এইরকমটা হয় আর কি ! আবার কেউ কেউ আসে আমাকে test করতে ! আরে আমাকে পরীক্ষা তাে নিশ্চয়ই করবি—কিন্তু আমি যদি তাের পরীক্ষা নিই—তখন কি হবে ? আমি তাে তােদের ভেতর-বার দুটোই দেখতে পাচ্ছি, তোর জীবনের কীর্তিকাহিনী সব বলে দিতে পারি! বললে_ সবার সামনে লজ্জা পাবি—তাই বলিনা !
খ্রীষ্টান এবং মুসলিম সম্প্রদায় এদের উভয়েরই origin তাে এক_ উভয়েরই Semitic-ধর্মমত। খ্রীষ্টানদেরআগে ছিল ইহুদী, আর খ্রীষ্টানদের পরে এসেছে ইসলাম ! হজরত মহম্মদের অনুগামীরা নিজেদেরকে ইসলামিয় বা মুসলিম বলে প্রচার করে। তাই ইহুদীদের ওল্ড টেস্টামেন্ট, খ্রীষ্টানদের নিউ টেস্টামেন্ট এবং ইসলামের আল্ কোরান-এর source বা origin একই ! এই তিনটি গ্রন্থের প্রথমটা বা পৃথিবী সৃষ্টি, মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারগুলো সবজায়গাতেই একই রয়েছে। আদিমানব আদম স্বর্গরাজ্যে ঈশ্বরের (আল্লা বা God) সাথে সুখে থাকতো। তাকে দেখতে পেতাে_ তার সাথে গল্প হতাে। তাকে ঈশ্বর তার নিজের মতাে করে মাটি থেকে তৈরি করেছিলেন। বহুদিন এভাবে কাটানাের পর আদম একদিন বিষন্ন হয়ে বসেছিল। কারণ জানতে চেয়ে ঈশ্বর বুঝলেন যে, আদমের একটি সঙ্গী দরকার। তাই তিনি তাকে ঘুম পাড়িয়ে আদমের বামদিকের পাজর থেকে ‘হাভা' (ঈভ)-কে সৃষ্টি করলেন। নারীশরীরের হাভাকে পেয়ে আদমের খুব স্ফূর্তি। তারা খুব আনন্দ করতো, খুব মজা করতো কিন্তু তাদের মনে কোন পাপবােধ ছিল না। পাপবোধ আনার জন্য এরপর ঘটল ইবলিসের আগমন(যদিও সে সবসময় আল্লাহ বা গডের কাছাকাছিই থাকতো এবং সে ও সমান শক্তি-সম্পন্ন)—জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ার জন্য হাভাকে প্রলােভন দেখানাে হোল ! হাভার কথায়-অনুরােধে-পীড়াপীড়িতে ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে আদমের জ্ঞানবৃক্ষের ফল পাড়া এবং দুজনের খাওয়াও হোল__এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাদের __‘স্বর্গ হইতে পতন' ! এরপর ওরা দু'জন পৃথিবীর দু’দিকে পড়ল_পড়ার পর প্রিয় মিলনের জন্য দুজনে পরস্পরের দিকে ছুটতে লাগলো। অবশেষে তাদের মিলন হােল আরবের মরুভূমিতে_ বর্তমান কাবাশরীফ যে স্থানে রয়েছে__সেই স্থানে ! এরপর ওদের ছেলে-পিলে হল, পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি হ’ল। কিন্তু সেই আদি পাপ(ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়া) আজও মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে ! তবু এদের মধ্যে মাঝে মাঝে দু'একজন ইনসান ঈশ্বরের (আল্লাহর) প্রিয়(এনারাই নবী বা ঈশ্বরের দূত অথবা রাসূল ইত্যাদি) হন, এঁরা ঈশ্বরের (আল্লাহর) বাণী পৌঁছে দেন মানুষের কাছে, যাতে আদমী ইনসান হয়ে ওঠে এবং ঈশ্বরের প্রতি যে “কর্জ” তা মুছে ফেলার জন্য সচেষ্ট হয় এবং শেষ নমাজের (রােজকেয়ামত) দিনে যেন ঈশ্বরের দূত জিব্রাইল তাদের আলাের পথ দেখিয়ে বেহেস্থে নিয়ে যান। সেখানে ঐ নবী বা রসুলরা সকলেই ঈশ্বরের (আল্লাহর) পাশে বসে রয়েছেন। এঁরাই ঐ ইনসানের ‘আরজি’ ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে দেবেন বা তাকে recommend করবেন যাতে ঈশ্বর (আল্লাহ) তাকে জেন্নাত বা হেভেন অর্থাৎ স্বর্গে থাকার অনুমতি প্রদান করেন। আর যদি তা না করেন_তাহলে দোজখ বা হেল অর্থাৎ নরকবাস করতে হবে এবং অসম্ভব দুর্গতি ভোগ করতে হবে।।
এই যে নবীরা রয়েছেন, এর মধ্যে আব্রাহাম বা ইব্রাহিম্, ইস্মাইল্ বা মোজাম্মেল, ইস্রায়েল্ বা ইসরাফিল্–এঁরাও রয়েছেন আবার মুসা, ঈশা এঁরাও রয়েছেন ! ইসলামিয় মতে রয়েছেন শেষ নবী _হজরত মহম্মদ। এই মতে এর পরে আর কোন নবী পৃথিবীতে আসবে না। অন্য নবীরা ঈশ্বর বা আল্লাহর প্রিয়, কিন্তু হজরত “হাবীবে রসুল”, অর্থাৎ ঈশ্বরের বন্ধুস্থানীয়। অন্যান্য নবীরা ঈশ্বরের আসন থেকে একটু দূরে বসেন কিন্তু হজরতের আসন আল্লাহর ঠিক পাশেই। এছাড়া শেষ বিচারের সময় হজরতের মতামত অন্যান্য নবীদের চেয়েও বিশেষভাবে গৃহীত হয়। আবার বলা হয়েছে যে__ হজরত তার প্রিয় নবী, তার বন্ধুস্থানীয়—এক কথায় প্রায় তাঁরই মতাে, তাই আল্লাহর বাণী বা আয়াৎ একমাত্র হজরতের মুখ থেকেই নিঃসৃত হত—অন্য নবীরা এর অধিকারী ছিল না।
যাইহােক, তােমার জিজ্ঞাসার উত্তরে আমাদের একটু Semitic ধর্মচর্চা হয়ে গেল। আশাকরি_ তুমি মিল-অমিলের ব্যাপারগুলাে কিছুটা হলেও ধরতে পারলে। যুগ-বিবর্তনে ধর্মমত পাল্টে পাল্টে যায়। নতুন যুগের জন্য প্রয়োজন হয় নতুন ধর্মমতের। কিন্তু এই সহজ সত্যকে সহজে গ্রহণ করতে না পারার জন্যই হয় সংঘাত! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সহজ কথায় বলেছিলেন--বাদশাহী আমলের মুদ্রা নবাবী আমলে চলে না। তাই প্রয়োজন হয় যুগধর্মের। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখবে স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী যেমন প্রকৃতি বা পরিবেশ ভিন্ন, তেমনি মানুষসহ সমস্ত জীবজন্তু ও ভিন্ন ভিন্ন। মরুভূমির উট কি মেরুপ্রদেশে বাঁচবে ___না মেরুপ্রদেশের পেঙ্গুইন মরুভূমিতে survive করবে ? তাহলে স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী ধর্মমত বা ধর্মাচরণও পৃথক পৃথক হয়ে যায়। সবার জন্য এক ফর্মুলা—এটাই প্রকৃতিবিরুদ্ধ। আর এর বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়েই যত বিপত্তি !