শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র বাউলতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনায় ছিলাম। আমরা উক্ত গ্রন্থের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের একেবারে শেষ অংশে এসে পৌঁছেছি, এখন আমরা দেখবো – পূর্ববর্তী আলোচনার পরে গুরুজী ঐ সম্বন্ধে আরো কি কি বলেছেন। এরপরে উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – স্বরূপের মধ্যেই সহজ মানুষের অবস্থান, রসিকজনই কেবলমাত্র তাঁকে বোধে-বোধ করতে পারেন। আর বাউলের সাধনা হোলো – রূপের মাধ্যমে স্বরূপে উন্নীত হওয়া।”
গুরু মহারাজের উপরিউক্ত কথাগুলি পূর্বের আলোচনাতেও আমরা পেয়েছি, এখানে যেন সেই কথাগুলিরই পুনরাবৃত্তি – কিন্তু একটু অন্যভাবে। কোনো তত্ত্বকে বোঝাতে বিভিন্ন কথা ব্যবহার করে পুনরুক্তি করা বা repeatation – এই ব্যাপারটা আমরা পরমগুরুদেব স্বামী বাউলানন্দের লেখাতেও পেয়েছি। খুব সম্ভবতঃ (এটা আমার নিজস্ব ধারনা) গুরুমহারাজ গুরুদেব স্বামী বাউলানন্দের ধারাকেই পরবর্তীতে follow করেছেন। যার জন্য আমরা গুরুমহারাজের লেখাতেও একই ‘ভাব’ বা ‘তত্ত্বে’-র ব্যাখ্যায় বিভিন্ন কথামালার সাহায্যে যেন একই কথার repeatation পাই। তবে, এটাও ঠিক গুরুমহারাজ কেন এমনটা করতেন – তার সম্বন্ধে কোনো কথা বলাটা চরম ধৃষ্টতাই শুধু নয়, এটা চরম অপরাধ ! তবু আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হোলো এবং এরজন্য আমি সমস্ত পাঠকবৃন্দের কাছে এবং অবশ্যই শ্রীভগবান স্বামী পরমানন্দের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী !
যাইহোক, এখানে গুরুমহারাজ বাউলতত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে বাউলমতের কথা বলেছিলেন। ঐ বাউলমত অনুযায়ী – প্রতিটি মানুষের স্বরূপের মধ্যেই ‘সহজ মানুষ’, ‘নিত্যের মানুষ’ বা ‘অপ্রাকৃত মানুষ’-এর অবস্থান রয়েছে । এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, সাধক সাধনার দ্বারা ‘স্বরূপের বোধ’ প্রাপ্ত হোলে_ সেই মানুষটাই ‘সহজ মানুষে’ বা ‘নিত্যের মানুষে’ অথবা ‘অপ্রাকৃত মানুষ’-এর রূপান্তরিত হয়ে যায়। কিন্তু শর্ত একটাই _এরজন্য মানুষকে (সাধককে) ‘রসিক'(বাউল সাধনায় সিদ্ধ) হোতে হবে। এই জন্যেই দেখবেন, বাউল গানের মাধ্যমে যাচঞা করা হয়েছে – ” আমি প্রেম-রসিকা হবো কেমনে?” কারণ ‘রসিক’ ছাড়া ‘রসতত্ত্বে’র ধারণা হবে কি করে, রসাভাস হতে পারে কিন্তু – রসোল্লাস হবে না। ‘রূপের মধ্যে দিয়ে স্বরূপে উন্নীত হওয়া’- এটা তো চূড়ান্ত সাধনা ছাড়া সম্ভব হয় না। তাই বাউলমতের ‘রসিক’ হওয়া মানেই হোলো সাধনায় সিদ্ধ হওয়া। প্রকৃতপক্ষে সিদ্ধ সাধকের মধ্যেই ঈশ্বরতত্ত্ব তথা ভগবৎতত্ত্ব বা কৃষ্ণতত্ত্বের প্রকাশ ঘটে। আর এই অবস্থাতেই প্রাকৃত দেহী সাধক অপ্রাকৃত সহজ মানুষ হয়ে ওঠে, তার মধ্যেই কৃষ্ণত্বের প্রকাশ ঘটে।
আমরা এখন দেখবো গুরুমহারাজ ‘বাউলতত্ত্ব’ বিষয়ে আরো কি কি বলেছেন। উনি এরপরে বলেছেন – ” বাউলরা বলেন – কন্দর্প শ্রীকৃষ্ণ এবং মদন স্বরূপিনী শ্রীরাধার মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বর্তমান – একের অবর্তমানে অন্যে থাকতে পারেন না, অর্থাৎ একে অপর হোতে অভিন্ন। এই যুগলরূপ নিত্যবৃন্দাবনে বিরাজমান। আর ঐ নিত্যবৃন্দাবন গোলকেরও ঊর্ধদেশে অবস্থিত।– এই রহস্যগুলি ধারণা করতে হোলে দেহতত্ত্বের জ্ঞান একান্তভাবে প্রয়োজন। দেহতত্ত্ব না জানলে কিছুই বোঝা যায় না, কারণ দেহকে ঘিরেই দেহাতীতের লীলা।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ, গুরুমহারাজ আবার এখানে ‘বাউলগণ বলেন’-এই কথাটার উল্লেখ করে বাকি কথাগুলি বললেন। সে যাই হোক, কিন্তু এখানে আমাদের কাছে উপরোক্ত কথাগুলি একটু হেঁয়ালি বা একটু ধন্দের সৃষ্টি করেছে। কারণ, আমরা এতদিন জানতাম – কামদেব ‘মদন’-এরই আর এক নাম ‘কন্দর্প’ ! অথচ এখানে বলা হোলো – কন্দর্প শ্রীকৃষ্ণ এবং মদন স্বরূপিনী শ্রীরাধা ! তবে আমাদের এই ধন্দ খানিকটা কেটেও গেল যখন উনি বললেন – ‘এদের(রাধা ও কৃষ্ণের) মধ্যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক এবং একের অবর্তমানে অন্যে থাকতে পারেন না অর্থাৎ একে অপর হোতে অভিন্ন।’ তাহলে যারা নামে ভিন্ন কিন্তু স্বরূপতঃ অভিন্ন – সেখানে ‘কন্দর্প’ ও ‘মদন’ তো অভিন্ন হবেনই। তবে আমরা সাধারণ মানুষ, আমরা বহুদিন ধরেই শুনে আসছি যে রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব দুই-এ মিলে এক যুগলতত্ত্ব – কিন্তু সেসব কথা কি আমরা ধারণায় আনতে পারি ? আমরা তো রাধাকৃষ্ণের নারী ও পুরুষ রূপের ছবি এঁকে মনের অন্দরমহলে একেবারে বসিয়ে রেখেছি। নানান পৌরাণিক গল্প, কাহিনীর দ্বারা রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমের রগরগে রসগাথার ব্যাপক প্রচার করে ফেলেছি আমরা !!
ফলে সেখান থেকে আমাদের মনকে – দুই তত্ত্বের ‘এক’-তত্ত্বে আসা বা যুগলতত্ত্বের ধারণা করা কি এতোই সহজ ? কিন্তু বাউলগণ এটা মানেন, আর তারা মানেন বলেই প্রতিটি নরের মধ্যে তাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে এবং প্রতিটি নারীর মধ্যে শ্রীরাধাকে স্থাপন করে সাধনায় রত হ’ন। আর এইভাবে সাধনা করতে করতে তাঁরা একদিন প্রাকৃত তত্ত্ব থেকে অপ্রাকৃত তত্ত্বে উন্নীত হয়, তারা নিজেরাই স্বরূপতত্ত্বে উপনীত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা হয়ে ওঠেন এবং লীলারস মাধুর্য আস্বাদন করেন। গুরুমহারাজ এই প্রসঙ্গে আরো যে উল্লেখযোগ্য কথা এখানে বলেছেন, তা হোলো – “দেহতত্ত্বের জ্ঞান না হোলে দেহাতীতের লীলা বোঝা যায় না।” এর মানে হোলো – যোগসাধনায় যে কুলকুন্ডলিনীকে জাগ্রত করে ষটচক্র ভেদের কথা রয়েছে – বাউল সাধনাতেও সেই একই ক্রিয়া সাধিত হয়।