শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হোচ্ছিলো। এখানে গুরুমহারাজের লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা থেকে লাইন তুলে তুলে পাঠকবৃন্দের কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করা হোচ্ছে। যেহেতু বাউলের মর্মকথা গ্রন্থটির বিষয়বস্তু সাধারণ পাঠকদের কাছে খুব সহজে গ্রহণযোগ্য বা বোধগম্য হয় না, তাই অল্প অল্প করে বইটির অংশবিশেষ তুলে ধরার চেষ্টা, যাতে আমরা সকলে ছোটো ছোটো অংশের কথাগুলির মর্মার্থ নিজেরাই চিন্তা-ভাবনার দ্বারা অনেকটা ধারণা করতে পারি। এই উদ্দেশ্যেই এই প্রচেষ্টা।
যাইহোক, আমরা আমাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলার চেষ্টা করি। আমরা এখন চলে যাচ্ছি উক্ত গ্রন্থের তৃতীয় পরিচ্ছেদে, যেখানে গুরু মহারাজ জিজ্ঞাসা-উত্তরের মাধ্যমে দেহতত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। সুতরাং আমরা এখন সেই ‘দেহতত্ত্বে’-র আলোচনায় চলে যাই। গুরুমহারাজ বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ ! তোমাকে ‘দেহতত্ত্ব’ সম্পর্কেই বলছি, তুমি অতি মনোযোগের সঙ্গে শ্রবণ করো।
বাউলমতে মানবদেহের মধ্যে চারটি সরোবর আছে। এইগুলি যথাক্রমে কাম সরোবর, মানস সরোবর, প্রেম সরোবর এবং অক্ষয় সরোবর। উক্ত সরোবরগুলির মধ্যে ‘কাম সরোবর’ ও ‘মানস সরোবর’ মানব দেহের বামার্ধে অবস্থিত, যা প্রকৃতি অঙ্গ নামে পরিচিত এবং ‘প্রেম সরোবর’ ও ‘অক্ষয় সরোবর’ মানবদেহের দক্ষিণার্ধে অবস্থিত – যা পুরুষ অঙ্গ নামে পরিচিত। বাউলমতে ‘অক্ষয় সরোবর’-টি সহস্রদল কমলেরই নামান্তর। ঐ সহস্রারেই ‘অক্ষয় সরোবর’-টি অবস্থিত, যেখানে ‘নিত্যের মানুষ’ বা ‘সহজ মানুষ’ বাস করেন। যেখানে জরা, মৃত্যু ও কালের কোনো বিক্রম নাই। ঐ স্থান জন্ম-মৃত্যুরূপ আবর্তনের ঊর্ধ্বে এবং চতুর্দশ ভুবনের পরপারে।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ – আমরা ছোটবেলা থেকেই একটা কথা শুনে এসেছি – ‘ভুল হয় না ভগবানের, আর ভুল হয় না শয়তানের !’ ভগবান (ঈশ্বর, আল্লাহ, গড) সবসময় সঠিক বিচার করেন। আমরা হয়তো আপাতদৃষ্টিতে দেখে অনেক সময় তাঁর কাজের ভুল ধরতে বসি, তাঁর কাজের সমালোচনা করি – কিন্তু জ্ঞানীগণ জানেন ঈশ্বরের কাজের কখনই কোনো ভুল হয় না। আর ভুল হয় না শয়তানের – কারণ সে যদি ভাবে বুকে ছুরি মারবে, তো ঠিকই নিখুঁত লক্ষ্যে মারবে ! তবে আমাদের আলোচনা ভগবানের কথা নিয়ে – তাই আমরা ভগবানের কথাতেই থাকবো। ভগবান পরমানন্দ এইবার বাউলমতে মানবদেহের ‘দেহতত্ত্ব’ নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং অবশ্যই যোগশাস্ত্রের সঙ্গে মিলও করিয়ে দিয়েছেন। যোগশাস্ত্রে রয়েছে ষটচক্রের কথা – মুলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্র এবং এইসবের ঊর্ধ্বে রয়েছে সহস্রার বা সপ্তমদ্বার যা সহস্রদল কমল দ্বারা শোভিত।
কিন্তু বাউলমতে মানবদেহকে চারটি সরোবরে ভাগ করা হয়েছে এবং সেগুলি হোলো ‘কাম সরোবর’, ‘মানস সরোবর’, ‘প্রেম সরোবর’ ও ‘অক্ষয় সরোবর’। এদের মধ্যে প্রথম দুটি অর্থাৎ ‘প্রেম সরোবর’ ও _মানস সরোবর’ মানবদেহের বামপার্শ্বে অবস্থিত – তাই এগুলি বামা (নারী) বা প্রকৃতি অঙ্গ এবং ‘প্রেম সরোবর’ ও ‘অক্ষয় সরোবর’ যেহেতু শরীরের ডানদিকে অবস্থিত – তাই একে পুরুষ অঙ্গ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এরপর গুরুমহারাজ ‘অক্ষয় সরোবর’-এর কথা বলেছেন, উনি বলেছেন – ‘অক্ষয় সরোবরটি সহস্রদল কমলেরই নামান্তর।’ আর তাছাড়াও বলেছেন – ‘ঐ সহস্রারেই অর্থাৎ অক্ষয় সরোবরেই নিত্যের মানুষ বা সহজ মানুষ বাস করেন।’ গুরুমহারাজ আরও বলেছেন (বাউলমত অনুযায়ী) – ‘এই স্থানটি অর্থাৎ ‘অক্ষয় সরোবর’ এমন একটা স্থিতি, যেখানে জরা, মৃত্যু এবং কালের প্রভাব কাজ করে না। এই স্থিতিতে যাঁরা অবস্থান করেন, তাঁরা জন্ম-মৃত্যুর আবর্তনে আর পড়েন না ! যার অর্থ হোলো এঁরাই প্রকৃত অর্থে মুক্ত – যেখানে কোনো বন্ধনই আর ক্রিয়াশীল নয়। তাছাড়াও গুরুমহারাজ বলেছেন এর(অক্ষয় সরোবরের) অবস্থান চতুর্দশ ভুবনের পারে।
এই ‘চতুর্দশ ভুবন’ ব্যাপারটা আবার কি ! গুরুমহারাজের কাছেই একদিন শুনেছিলাম পৃথিবীর নিম্নক্রমে সাতটি ‘লোক’ বা ভুবন রয়েছে এবং ঊর্ধ্বক্রমে পৃথিবীসহ আরো সপ্তলোক বা সপ্তভুবন রয়েছে। নিম্নক্রমগুলি হোলো যথাক্রমে – অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল এবং পাতাল * আর ঊর্ধ্ব সপ্তলোক বা সপ্তভুবন হোলো – ভূলোক, ভূবলোক, স্বর্গলোক, মহঃলোক, জনঃলোক, তপঃলক ও সত্যলোক। কিন্তু গুরুমহারাজের কথায় অর্থাৎ বাউলমতে ‘অক্ষয় সরোবর’ এই চতুর্দশ ‘লোক’ বা চতুর্দশ ভুবনেরও পারে। তাই তো এটি নিত্যলোক বা সহজপুর – যেখানে ‘নিত্যের মানুষ’ বা ‘সহজ মানুষ’ থাকেন। এই কথাগুলি থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারি যে, সাধক (বাউলমতের সাধকসহ যে কোনো সাধক) তার সাধনার চূড়ান্ত অবস্থায় আর সামান্য মানুষ বা সাধক মানুষ অবস্থায় থাকে না। ঐ মানুষ ‘সিদ্ধ’ অবস্থারও পারে চলে যান, তাঁর শরীরটা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষেরই মতো থাকে (যদিও এটা সত্যি যে, তাঁর শরীরেরও প্রভূত পরিবর্তন হয়ে যায়, লক্ষ মানুষের ভিড়ে মিশে থাকলেও একনজরে তাঁর শরীরিক বিশেষত্ব নজরে পড়ে যায়। যেটা আমরা গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের মধ্যে দেখেছি।), কিন্তু ঐ অবস্থায় ঐ শরীরধারীকে কেন্দ্র করে চলে মহাজগতিক শক্তির খেলা, ঘটে ঈশ্বরীয় শক্তির প্রকাশ – আর এই প্রকাশ ঘটে মহৎ-এর ইচ্ছায় এবং যুগোপযোগী। তাই তো সমস্ত মহাপুরুষের লীলা একইরকম হয় না, ভিন্ন ভিন্ন যুগে – ভিন্ন ভিন্ন স্থানে – একেবারে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে !!