আমাদের বাড়ির পাশেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বাড়ি। ঠাকুরের বাড়িটি কেন্দ্র করে – তৈরি হয়েছে শ্রী রামকৃষ্ণ মঠ। মঠে প্রতিদিন সন্ধ্যা আরতি দেখি । উৎসব অনুষ্ঠানে মঠে থাকি। এই সময় ঠাকুরের কথামৃত , বিবেকানন্দ সমগ্র ,মা সারদার বই ও ভারতের সাধক ইত্যাদি আধ্যাত্মিক বই পড়ি ।মঠে বছরে দুবার , তিনবার দীক্ষা হয় কিন্তু মঠে দীক্ষা নিই না । ঠাকুর বলেছেন — “সময় হলে সৎগুরু দরজায় এসে কড়া নাড়বে “।—

পরমানন্দ কথা শুরু —


   [আমার প্রথম ❗সৎগুরু--দর্শন ❗]

    এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিন, আবহাওয়ায় হালকা গরম ভাব,  মনোরম পরিবেশ ! সময়টা_ মে মাস, ১৯৮২ সাল। তখন সকাল দশটা-এগারোটা হবে।  এমন সময়ে প্রশান্ত অর্থাৎ  স্বামী অসীমানন্দের ভাই আমাকে এসে বলল– "মৃণাল দা, আমাদের বাড়িতে চলো। আমার মেজদার সাথে মেজদার গুরুদেব (স্বামী পরমানন্দজী)এসেছেন । মেজদার কাছে শুনলাম উনি একজন মহাপুরুষ ।" এই শেষের কথাটা শোনামাত্রই মন-প্রাণ পুলকে নেচে উঠলো । বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলার মধ্যে মনেপ্রাণে অফুরন্ত আনন্দ-স্রোত বইতে লাগলো ! এইরকম একজনের সাথেই তো এতোদিন দেখা করতে চেয়েছি ! কত মহাপুরুষ কে রাত্রিতে স্বপ্নে দেখি কিন্তু সত্যি সত্যিই সামনাসামনি একজন মহাপুরুষের সাথে দেখা হবে_তা কখনো ভাবতে পারিনি।

একটু পরেই অসীমানন্দদের বাড়ি গেলাম ।দোতলা মাটির বাড়ি, লম্বা দুয়ার – পাঁচিল ঘেরা প্রশস্ত জায়গা । দেখলাম_ বাড়িতে বহু লোকজন ‌ এসেছেন_বেশিরভাগ‌ই ওনাদের বাড়ির আত্মিয়-স্বজন। আরামবাগের কাছে বালিবেলা, গোঘাট, ক্ষীরপাই, তাজপুর ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন ও আত্মীয়রা এসেছেন । মনে হচ্ছে বাড়িতে কোনো উৎসব অনুষ্ঠান হচ্ছে।

ভিতরে ঢুকে দেখলাম – দুয়ারের একদিকে এক দিব্য কান্তি অল্প বয়সের সাধু বসে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করছেন । তাঁর এমনি তীব্র আকর্ষণ যে , ওনার দিকে তাকানো মাত্রই মন আর দৃষ্টি অন্য দিকে যাচ্ছিল না ! হৃদয়ে যেন একটা আনন্দের ঢেউ উঠলো !

অসীমানন্দের ভাই রাজকুমার সরকার এমবিবিএস ডাক্তার , ফলে সে এ্যানাটমীর উপর বিভিন্ন জিজ্ঞাসা করছিল _  গুরু মহারাজ তৎক্ষণাৎ সেগুলির উত্তর দিয়ে দিচ্ছিলেন ! আর সেই উত্তর শুনে ডাক্তারবাবু খুবই সন্তুষ্ট‌ও হচ্ছিলেন__সেটা তার মুখ-চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। সেদিনের সিটিং-এ উপস্থিত একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, হোমিওপ্যাথি ঔষধের সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ডোজের সম্বন্ধে নানা কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন । গুরু মহারাজ সেগুলির এতো সুন্দর করে উত্তর দিচ্ছিলেন যে, শুধুমাত্র সেই হোমিওপ্যাথি ডাক্তার‌ই নয়_উপস্থিত সকলেই সুন্দর করে বুঝে যাচ্ছিল । ওখানেই ছিলেন একজন ইতিহাসে M.  A._ পাশ টিচার ! তিনি ইতিহাসের মাস্টার ডিগ্রি সিলেবাস-এর উপর জিজ্ঞাসা করছিলেন ! গুরু মহারাজ তৎক্ষণাৎ সেইসব কথার‌ও উত্তর দিচ্ছিলেন !

সেই সময় আমি উপনিষদ-সমগ্রের খন্ডগুলি পড়ছিলাম । ঐ বইগুলির মধ্যে দুই লাইনের শ্লোক আমি ঠিকমতো বুঝতে পারছিলাম না । অনেকের ভাষ্য‌ও পড়েছিলাম কিন্তু তাও মানেটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না ।

গুরু মহারাজ সবার সবরকম জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন এবং সেই উত্তর শুনে সবাই খুব খুশিও হচ্ছিল , সকলকে সন্তুষ্টচিত্ত দেখাচ্ছিলো। তাই আমার মনে হলো ঐ উপনিষদের শ্লোকের অর্থ, আমি এনাকে জিজ্ঞাসা করি ! উপনিষদের দু লাইনের সংস্কৃত শ্লোকটির 1/4 অংশ সবে বলেছি গুরু মহারাজ আমাকে আর বলতে না দিয়ে শ্লোকটির বাকি 3/4 অংশ বলে দিলেন ! এরপর উনি শ্লোকটির মানে এবং ব্যাখ্যা সুন্দর করে
বললেন ।

মনের মধ্যে বিস্ময় সৃষ্টি হলো , প্রশ্ন জেগে উঠলো__” এও কি সম্ভব– ?” একটা সমগ্র উনিষদের প্রায় এক হাজারের ওপর সংস্কৃত শ্লোক আছে , তা মুখস্ত করে রাখা –কারো পক্ষে কি সত্যিই সম্ভব ?

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে– ওনার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম ! দেখছিলাম_উনি সকলের জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন , কিন্তু কথা বলার ফাঁকে আমার দিকে মাঝে মাঝেই আনন্দময় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন । এইভাবে জিজ্ঞাসা ও উত্তর পর্ব সারা হবার কিছুক্ষণ পরে, উনি বাড়ির মায়েদের আহ্বানে দ্বিপ্রাহরিক ভোজন ও বিশ্রামের জন্য মাটির বাড়ির দোতলাতে উঠে গেলেন।

অসীমানন্দের মা এসে আমার হাতে মিষ্টি দিয়ে বললেন – ‘মহারাজের প্রসাদ খাও’ । প্রসাদ খেয়ে কিছুক্ষণ পরে মাটির ঘরের দো -তলাতে ওনার সাথে দেখা করতে গেলাম ! দেখি মহারাজ খাটের উপর বসে রয়েছেন। দরজার বাইরে থেকে জিজ্ঞাসা করলাম” আসবো”? উনি বললেন “ভিতরে এসো ।” ভিতরে ঢুকে প্রণাম করে মেঝেতে বসলাম। দু’চারটে আধ্যাত্মিক বই পড়ে ঈশ্বর-ব্রহ্ম এইসব সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ ধারণা হয়েছিল তাই সাহসে ভর করে জিজ্ঞাসা করলাম– “আপনি কি ব্রহ্ম-দর্শন করেছেন ?” উনি উত্তর দিলেন–”ব্রহ্মকে বোধে বোধ করেছি । তুমি কি আমাকে অনুসরণ করবে ? এত মিষ্টি করে কথাগুলো বললেন, আজও আমার মনে-প্রাণে বাজে ! আমি কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইলাম। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করলাম এই যে এত জন ব্যক্তি, বিভিন্ন রকমের জিজ্ঞাসা করছিল – , আর আপনি অনায়াসে উত্তর দিচ্ছিলেন এটা কিভাবে সম্ভব ? গুরু মহারাজ বললেনএই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড , ব্রহ্মের ভিতরেই অবস্থিত ! যে ব্রহ্মকে জেনেছে , তার কাছে এইসব জিজ্ঞাসা অতি তুচ্ছ ! তার কিছুই অজানা নয় ।” সদা আনন্দময় গুরু মহারাজকে (গুরুজীকে ) প্রণাম করে বললাম –”আসছি।” মহারাজ বললেন_ “বনগ্রামে এসো , আসবে তো ?” এতো মিষ্টি করে ভালোবেসে কথাগুলো বললেন– , এতো টান তাঁর কথার মধ্যে , তাঁর এতো প্রেম যে আমার মন- প্রাণ বিগলিত হয়ে যেন আপনা-আপনিই তাঁর চরণে সমর্পণ হয়ে গেল এবং আমি সেই চরণে ভক্তির অঞ্জলি দিলাম। যেন আমার অজান্তেই আমার মন-মুখ এক হয়ে এই সম্মতি দিল যে ইনি সত্যিই একজন উন্নত মহাপুরুষ ‌‌!

আমার ভিতরে তখন একটা উত্তেজনার ঝড় চলছিল, তার সাথে আনন্দে– যেন একটা আবেশের মধ্যে ছিলাম ! আমার মনে পড়ছিল_ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর দর্শন সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দের জিজ্ঞাসা এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের– উত্তর !!

                 (ক্রমশঃ)