(চৈঃ চ. অন্ত্যলীলা—১৪ পরি.)
–শ্রীমন্মহাপ্রভুর, বাউলরূপের বর্ণনা করেছেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ ! “দশেন্দ্রিয় শিষ্য করি–মহাবাউল নাম ধরি, শিষ্য লইয়া করিল গমন।” মহাপ্রভু যেখানেই যেতেন শিষ্যগণ সঙ্গে যেতেন – পরবর্তীতে উনি কাজের বিভাজন করে দেওয়ায় সবাই তাঁর সঙ্গে যেতে পারতেন না, কিন্তু আমাদের আলােচ্য
মহাজন শ্রীল বাসুদেব ঘােষ প্রায়শই মহাপ্রভুর সঙ্গে সঙ্গে থাকার সুযােগ পেতেন। আর সেই সুদুর্লভ সুযােগ পেয়েছিলেন বলেই বাসুদেব মহাপ্রভুর বিভিন্ন বয়সের লীলার কথা সুন্দরভাবে সুললিত ছন্দে লিখে রেখে যেতে পেরেছিলেন। তাছাড়া বাসুদেবের আরও গুণ ছিল উনি সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। আর মহাপ্রভু বাসুদেবের কণ্ঠে কীর্তনগান শুনতে খুবই ভালােবাসতেন। এমনও লিখিত আছে যে, বাসুদেবের গান শুনে মহাপ্রভু দুবাহু তুলে নৃত্য করতে শুরু করতেন। যাঁর অঙ্গুলি হেলনে এই জগৎসংসার সতত নৃত্যরত—তাঁকে নাচানাে বড় কম কথা নয় ! ধন্য ধন্য মহাভক্ত বাসুদেব ঘােষ, মহাধন্য তুমি। আর আজ বাসুদেবের ন্যায় মহাভক্তের জীবনী বা তাঁর রচনার স্বাদ গ্রহণ করতে পেরে আমরাও ধন্য হচ্ছি !
আগের সংখ্যায় বাসুদেবের পদে নিমাই-এর সন্ন্যাসপর্বের ঘটনা আমরা জানতে পেরেছিলাম। কাটোয়ার গঙ্গাতীরে কেশবভারতীর কাছে নিমাই সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন। ওনার কৃষ্ণবর্ণ কুঞ্চিত, আলুলায়িত কেশদাম কেটে ফেলে মস্তক মুণ্ডন করেছিল যে ব্যক্তি তার নাম ছিল মধু নাপিত। ঐ একটা কাজ করেই মধু ইতিহাসের বুকে স্থান করে নিল। মহাপ্রভু কাকে যে কিভাবে কৃপা করবেন–তা তিনি ছাড়া কেইবা বলতে পারে ।
যাইহােক, ফিরে আসি বাসুদেবের পদাবলীতে। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু তাে সন্ন্যাস নিলেন—আর নবদ্বীপের বাড়িতে তখন হাহাকার ! কাঁদছেন বিষ্ণুপ্রিয়া, কাঁদছেন শচীমাতা, কাঁদছেন পাড়াপড়শী, নবদ্বীপবাসী। তার বর্ণনা দিচ্ছেন বাসু। সন্ন্যাসের আগের দিন থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া চারিদিকে অমঙ্গল দর্শন করছেন—
“পাগলিনী বিষ্ণুপ্রিয়া ভিজা বস্ত্র চুলে,
ত্বরা করি বাড়ি আসি শাশুড়িরে বলে।
বলিতে না পারে কিছু কাঁদিয়া ফাঁপর,
শচী বলে মা গাে এত কি লাগি কাতর।৷
বিষ্ণুপ্রিয়া বলে আর কি কব জননী,
চারিদিকে অমঙ্গল কাঁপিছে পরানি।
নাহিতে পড়িল জলে নাকের বেশর,
ভাঙ্গিবে কপাল, মাথে পড়িবে বজর।
থাকি থাকি প্রাণ কাঁদে নাচে ডান আঁখি,
দক্ষিণে ভুজঙ্গ যেন রহি রহি দেখি।
কাঁদি কহে বাসু ঘােষ কি কহিব সতি,
আজি নবদ্বীপ ছাড়ি যাবে প্রাণপতি ॥”
—সেদিন রাত্রে সত্যি সত্যিই মহাপ্রভু সন্তর্পণে শয্যাত্যাগ করে বেরিয়ে চলে গেছেন—নিদ্রাভঙ্গের পর বিষ্ণুপ্রিয়া ঘরের ভিতরে বাহিরে আকুল হয়ে খুঁজছেন কিন্তু কোথাও পাচ্ছেন না প্রাণনাথ শ্রীগৌরাঙ্গকে। ভূমিতে পড়ে আলুথালু কেশে আছাড়িপিছাড়ি করে কাঁদছেন।
কাঁদে দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া নিজ অঙ্গ আছাড়িয়া
লােটাঞা লােটাঞা ভূমি তলে।
প্রাণনাথ কি করিলা পাথারে ভাসায় গেলা
কাঁদিতে কাঁদিতে ইহা বলে।
এ ঘর জননী ছাড়ি মােরে অনাথিনী এড়ি
কার বােলে করিলা সন্ন্যাস।৷
শচীমাতার কান্না ফুটে উঠেছে বাসু ঘােষের লেখনীতে–
“ইহার লাগিয়া যত পড়াইলাম ভাগবত
এ দুঃখ কহিব আমি কায়।
অনাথিনী করে মােরে যাবে রাজ্য দেশান্তরে।
বিষ্ণুপ্রিয়ার কি হবে উপায়।৷
এ ডাের কৌপিন পরি কি লাগিয়া দণ্ডধরি,
ঘরে ঘরে খাবে ভিক্ষা মাগি।
জীয়ন্ত থাকিতে মায়, ইহা নাকি সহা যায়,
কার বােলে হইলে বৈরাগী।৷”
আবার বাসু বিষ্ণুপ্রিয়ার ব্যথার কথা লিখেছেন–
হেদেরে পরান নিলাজিয়া এখনাে না গেলি তনু তেজিয়া
গৌরাঙ্গ ছাড়িয়া গেছে মাের আর কি গৌরব আছে তাের।
আর কি গৌরাঙ্গচাঁদে পাবে মিছে প্রেম-আশ আশে রবে।
সন্ন্যাসী হইয়া পঁহু গেল এ জনমের সুখ ফুরাইল।
কাঁদি বিষ্ণুপ্রিয়া কহে বাণী বাসু কহে না রহে পরানি।
–এবার বাসুদেবের কলমে আমরা দেখব মহাপ্রভুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে কাটোয়া থেকে শান্তিপুরে ফিরিয়ে নিয়ে আসার পর শচীমাতার সাথে সন্ন্যাসী পুত্রের মিলনের দৃশ্য ! এবার শুনুন শচীমাতা কি বলছেন–
“হে দেরে নদীয়ার চাঁদ বাছারে নিমাই,
অভাগিনী তাের মায়ের আর কেহ নাই,
এত বলি ধরি শচী গৌরাঙ্গের গলে,
স্নেহভাবে চুম্ব খায় বদন কমলে,
মুই বৃদ্ধ মাতা তাের, মােরে ফেলাইয়া,
বিষ্ণুপ্রিয়া বন্ধু দিলে গলায় গাঁথিয়া।
তাের লাগি কান্দে সব নদীয়ার লােক,
ঘরেতে চলয়ে বাছা দূরে থাউক শােক।
শ্রীনিবাস হরিদাস যত ভক্তজন,
তা সবারে লয়ে বাছা করহ কীর্তন।
মুরারী, মুকুন্দ, বাসু আর হরিদাস,
এসব ছাড়িয়া কেন করিলে সন্ন্যাস।
যে করিলা সে করিলা চলহ ফিরিয়া,
পুনঃ যজ্ঞসূত্র দিব ব্রাহ্মণ আনিয়া।
বাসুদেব ঘােষ কহে শুন মােরবাণী,
পুনরায় নদে চল গৌর গুণমণি।৷”
–নিমাই আর শচীমাতার আদরের দুলাল নিমাই নয়, তখন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ! তাই সেই সন্ন্যাসী শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য গর্ভধারিণীকে উদ্দেশ্য করে কোমলকণ্ঠে মধুর স্বরে বললেন—“মা । তুমি আমার জন্য জন্মান্তরের মা—আর আমি তােমার জন্ম-জন্মান্তরের পুত্র। তুমিই তাে ধ্রুবর জননী হয়ে ছেলেকে বৈরাগ্য শিখিয়েছিলে। তুমিই কৌশল্যা হয়ে বনবাসী রামের জন্য কত কেঁদেছিলে। তারপর কৃষ্ণ যখন মধুপুরে গেল তখন তাে তুমিই ছিলে নন্দরাণী ! তাই আজ আর কেন শােক করছ মা! যুগে যুগে অনেক কেঁদেছ, আর কেঁদো না, এবার আমায় বিদায় দাও! তবে কথা দিচ্ছি, যখনই তুমি ডাকবে, তখনই আমি তােমার কাছে চলে আসব। তুমি ঘরে ফিরে যাও, আর কৃষ্ণ ভজন করাে–কৃষ্ণই জগতের সার। কৃষ্ণ বিনা জগতে এত আপন আর কেউ নাই। এই কথায় শচীমাতা শান্ত হলেন। সকলের দিকে সু-দৃষ্টি ফেলে সকলের শােক হরণ করলেন প্রভু। তারপর মায়ের অনুমতি নিয়ে চলে গেলেন নীলাচলে।
বাসুদেব ঘােষ ভাষা শচীর এমন দশা
মরা হেন রহিল পড়িয়া।
শিরে করাঘাত করি ঈশানে দেখায় ঠারি
গােরা গেল নদীয়া ছাড়িয়া।
–মহাপ্রভূর নীলাচলে থাকাকালীন কিছু পদ আগে বর্ণনা করা হয়েছে। এবার আমরা মহাপ্রভুর অন্তর্দশার একটা পদ এখানে উল্লেখ করব–যেটি বাসুদেব ঘােষেরই লেখনী থেকে বেরিয়েছে। এ থেকে বােঝা যাবে যে বাল্যলীলা থেকে অন্তলীলা পর্যন্ত মহাপ্রভুর জীবনের সমস্ত সময়কার পদ রয়েছে বাসুর পদাবলীতে। বাসু ঘােষের সমস্ত পদের সঙ্কলন সেভাবে মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। তার কারণ হয়তাে তাঁর পদাবলী ঠিকমতাে সংরক্ষণ হয়নি অথবা তিনি হয়তাে প্রচারবিমুখ ছিলেন, তাই প্রচার করেননি। কিন্তু অন্যান্য প্রখ্যাত চৈতন্যচরিতামৃতকারের ন্যায় বাসু ঘােষও যে একজন পরিপূর্ণ চৈতন্য জীবনীকার ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্তলীলার যে পদটি উল্লেখ করা হবে, তা হােল —
“সিংহদ্বার ছড়ি গােরা সমুদ্রপথে ধায়
‘কোথাকৃষ্ণ’, ‘কোথাকৃষ্ণ’ সবারে শুধায়।
অতি দুর্বল দেহ ধরা নাহি যায়,
আছড়িয়া পড়ে অঙ্গ ভূমে গড়ি যায়।
দীঘল শরীর গোরা পড়ে মুরছায়
উত্তান নয়ন, মুখে ফেন বহি যায়।
চৌদিকে ভকতগণ কাঁন্দিয়া ভাসায়,
বাসুদেব ঘােষের হিয়া বিদরিয়া যায়।৷”
– মহাপ্রভু দক্ষিণভারত পরিভ্রমণ করে নীলাচলে অবস্থান করছেন। বাসুদেব ঘােষ সহ তাঁর অন্য দুই সহােদর ভ্রাতা (গােবিন্দ ও মাধব) তখন নীলাচলে মহাপ্রভুর সাথে। সেই সময় সপর্ষদ নিত্যানন্দ প্রভু পুরীধামে এসে উপস্থিত হলেন। কিন্তু সে বৎসর নিত্যানন্দ নীলাচলে আসায় মহাপ্রভু খুশী হননি। গৌড়বঙ্গে কত কাজ–সে সব কাজের ভার তিনি
নিতাই-এর হাতে দিয়ে নিশ্চিন্তে রয়েছেন। তাই বললেন –
নিত্যানন্দে কহে প্রভু-শুনহ শ্রীপাদ
এই আমি মানি তুমি করহ প্রসাদ ।
প্রতিবর্ষ নীলাচলে তুমি না আসিবা
গৌড়ে রহি মাের ইচ্ছা পুরণ করিবা।৷ (চৈঃ চঃ ৯৬ শ মধ্যলীলা)
–এই সময় নিত্যানন্দের সাথে বাসুদেব ঘোষ এবং মাধব ঘােষও গৌড়ে ফিরে আসেন। কিন্তু থাকবেন কোথায় ? মাধব দাঁইহাটে স্থিত হয়েছিলেন আর বাসুদেব চলে আসেন নবদ্বীপে। চৈতন্যবিহীন নবদ্বীপ যেন শশ্মানপুরীর ন্যায় মনে হ’ল বাসুর। তাই তিনি নবদ্বীপেও বেশীদিন থাকতে পারেননি। ঐখান থেকেই তিনি সরাসরি চলে আসেন মেদিনীপুরের তমলুকে। এই তমলুকই প্রাচীনকালে ‘তাম্রলিপ্ত’ নামে পরিচিত ছিল। মহাপ্রভু এসেছিলেন তমলুকে, তাই মহাপ্রভুর শ্রীপাদপূত পবিত্র চারণভূমি। মহাপ্রভু চারণভূমি। প্রভু এখানে সপার্ষদ নিশিযাপন করেছিলেন। সারারাতব্যাপী সঙ্কীর্তনে মুখরিত হয়েছিল তমলুকের আকাশ-বাতাস। প্রভু নিজে মাধুকরী করেছিলেন তমলুকের ঘরে ঘরে। তাই বাসুদেব স্থির করলেন—আর অন্য কোথাও নয়–এখন থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত মহাপ্রভুর নাম-গান গেয়ে তমলুকেই কাটিয়ে দেবেন। বৈষ্ণবাচার্য দর্পণ গ্রন্থে রয়েছে–
গুণতুঙ্গা সখী এবে বাসুদেব খ্যাতি।
গৌরাঙ্গের শাখা তমলুকেতে বসতি।৷
“শ্রীচৈতন্যং প্রভুং বন্দে বানােহপি পদনুগ্রহাৎ |
তরেন্নানামতগ্রাহ-ব্যাপ্তং সিদ্ধান্তসাগরম্।৷” (১/২ চৈঃ চ)
–(যাঁহার কৃপায় মূঢ়ব্যক্তিগণও নানামতরূপ গ্রাহসঙ্কুল (জলজ সমূহ) সিদ্ধান্তসমুদ্র সমুত্তীর্ণ হইয়া থাকেন, সেই চৈতন্যপ্রভুকে বন্দনা করি ! )
কৃষ্ণদাস কবিরাজ এই পরিচ্ছেদেই আরাে বলেছেন যে,
“সেই তাে গােবিন্দ সাক্ষাৎ চৈতন্য গোঁসাই।
জীব নিস্তারিতে ঐছে দয়ালু আর নাই।৷”
–সুতরাং আমরাও সেই দয়াল প্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের চরণ স্মরণ করে তাঁর অন্যতম এক পার্ষদ, চৈতন্য লীলা-কাহিনীকার বাসুদেব ঘােষের জীবনের অন্তিম অধ্যায় নিয়ে আলােচনা শুরু করি। আগের সংখ্যায় আমরা দেখেছিলাম বাসুঘােষের পদে বর্ণিত হয়েছে মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণের পর শান্তিপুরে গর্ভধারিণী জননী শচীমাতার সাথে তাঁর সাক্ষাৎকার এবং মাকে আশ্বস্ত করে মহাপ্রভুর নীলাচলে গমন। মহাপ্রভুর সাথে আরো অনেকের সাথে বাসুঘােষও সেখানে নিশ্চয়ই উপস্থিত ছিলেন। কারণ মহাপ্রভু নীলাচলে গিয়ে যখন জগন্নাথ মন্দিরে শ্রীবিগ্রহ দর্শন করে প্রেমাবেশে মূৰ্ছিত হয়ে গেলেন এবং সেই অবস্থা দর্শন করে বাসুদেব সার্বভৌম (রাজগুরু) গৌরাঙ্গকে বুকে করে স্বগৃহে নিয়ে গিয়ে মহাপ্রভুর ভাবাবস্থার মধ্যেই তাঁর মধ্যে নানা অবতারাদির প্রকাশ দর্শন করলেন, তখন বাসুও সেখানে ছিল। বাসু মহাপ্রভুর এই অলৌকিক রূপ দর্শন করে যা লিখেছিলেন তা পূর্বে কিছু উল্লেখ করা হয়েছে। তবু আর একবার বলা হল :–
“নরসিংহ রূপ প্রভুর দেখে একবার।
বটুক বামন রূপ দেখে পূণর্বার।৷
পুনঃ দেখে মৎস্য কূর্ম বরাহ আকার
পুনঃ ভৃগুরাম হস্তে ভীষণ কুঠার।
দূর্বাদল শ্যামরূপ দেখায় কখন
কখন মুরলীধর নীরদ বরণ ।৷
শচীর দুলাল যেই সেই ননীচোর
অন্তরেতে কালা কানু বাহিরেতে গৌর৷৷” (বাঃ পঃ -১৯৫)
–বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ‘বাসুদেবের পদাবলী’ নামে একটি সঙ্কলিত গ্রন্থ অতি সম্প্রতি প্রকাশ করে গৌর ভক্তকুলকে অনেকটাই আশ্বস্ত করেছে কারণ এর আগে বাসুঘােষের লেখা কোন গ্রন্থ ছিল না। বিভিন্ন প্রাচীন পুস্তককারদের রচনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু কিছু পদ পাওয়া যেতাে। আর কীর্তনীয়াগণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পালাকীর্তন গান করার আগে গৌরচন্দ্রিকার জন্য বাসুদেবের পদ ব্যবহার করতাে।
‘বাসুদেবের পদাবলী’ গ্রন্থে সংকলিত পদগুলির মধ্যে গৌরাঙ্গের বাল্যলীলার পদগুলির যেন তুলনা হয় না। উদাহরণ হিসাবে এখানে দুটি একটি দেওয়া হল–
[১] শচীর আঙিনায় নাচে বিশ্বম্ভর রায়।
হাসি হাসি ফিরি ফিরি মায়েরে লুকায় ॥
বয়নে বসন দিয়া বলে লুকাইনু।
শচী বলে বিশ্বম্ভর আমি না দেখিনু।৷
মায়ের অঞ্চল ধরি চঞ্চল চরণে।
নাচিয়া নাচিয়া যায় খঞ্জন গমনে ৷৷
বাসুদেব ঘােষ কয় অপরূপ শোভা।
শিশুরূপ দেখি হয় জগমনলােভা।৷ (বাসুঘােষের পদাবলী-৮)
[২] পূর্ণিমা রজনী চাঁদ গগনে উদয় ।
চাঁদ হেরি গােরাচাঁদের হরিষ হৃদয়।
“চাঁদি দেমা” বলি শিশু কাঁদে উভরায়।
হাত তুলি শচী ডাকে ”আয় চাঁদ আয়।”
আসে নিঠুর চাঁদ নিমাই ব্যাকুল।
কাঁদিয়া ধূলায় পড়ে হাতে ছিঁড়ে চুল।
রাধাকৃষ্ণ চিত্র এক মিত্ৰগৃহে ছিল।
পুত্র শান্তাইতে শচী তাহা হাতে দিল।
চিত্র পাঞা গােরাচাঁদের মনে বড় সুখ।
বাসু কহে পটে পহু (প্রভু) হের নিজ মুখ।৷” (বাঃ পঃ -৯)
[৩] “নাচে গােরা শচীর দুলালিয়া
চৌদিকে বালক মিলি দেয় তারা করতালি
হরিবােল হরিবােল বলিয়া ।
সুরঙ্গ চতুনা মাথে গলায় সোনার কাঁটি
সাধ করি পরায়েছে মায় ধড়া গাছি আঁটি।
সুন্দর চাঁচর কেশ সুবলিত তনু
ভুবনমোহন বেশ ভুরু কামধেনু।
রজত কাঞ্চন নানা আভরণ
অঙ্গে মনোহর সাজে।
রাঙা উৎপল চরণ-যুগল
তুলিতে নূপুর বাজে।
শচীর অঙ্গনে নাচয়ে সঘনে
বােলে আধ-সাধ বাণী।
বাসু ঘােষ বলে ধর ধর কোলে
গোরা যেন পরানের পরানী।৷” (বাঃ পঃ ১০)
–যাইহোক, বাসুঘােষের কাব্য প্রতিভার, ভক্তিরসের পরাকাষ্ঠার কিছু পরিচয় এখানে দেওয়া হােল। এবার আসি এই মহাপুরুষের অন্তিম সময়ের গবেষকদের মতে মহাপ্রভুর দেহান্তের সময়কাল ১৪৫৫ শকাব্দের ৩১শে আষাঢ়, ইংরাজী ১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দের ২৯শে জুন। সেইসময় বাসু ঘােষ ছিলেন তমলুকে। নীলাচল থেকে ফিরে এসে বাসু তাঁর স্বগৃহে কুলাই গ্রামে কোন আশ্রম স্থাপন করেননি –উনি পুরী বা নীলাচলের অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি তমলুকে চৈতন্যমহাপ্রভুর বিশ্রামস্থলটি চিহ্নিত করে সেখানেই কুটির নির্মাণ করে সাধন-ভজন করতেন। মহাপ্রভুর মহাপ্রয়াণের খবর পেয়ে শােকবিহ্বল বাসু স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু সেই সময় মহাপ্রভু নৃত্যরত নবীন বালকের বেশে তাঁকে দেখা দিয়ে বলেন “তুমি দেহত্যাগ করাে না—এই ‘নৃত্যরত’ বেশে আমার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে, তাঁর সেবা-পূজা করাে। এতেই বহু মানুষের কল্যাণ হবে।”
সেই নির্দেশমতাে বাসু তমলুকে মন্দির নির্মাণ ও ‘নৃত্যরত’ নবীন বেশী মহাপ্রভুর অভিনব মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মহাপ্রভু এখানে বালকবেশে ভক্তদের ‘অভয়’ ও ‘বর’ প্রদান করছেন। মহাপ্রভুর প্রয়াণ সংবাদ বাসুঘােষ দূর থেকে পেয়েছিলেন—
তাই তিনি জানতেন যে, তােটা গোপীনাথে প্রভুর শরীরপাত হয়েছে। উনি লিখেছিলেন–
”কি করিব কোথা যাব বচন না সরে ।
হারাইনু গােরাচাঁদ গােপীনাথের ঘরে।৷”
–মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর বহু বছর বাসুদেব ঘােষ তমলুকে থেকে বিগ্রহসেবা এবং সাধন-ভজন করেছিলেন। গবেষকদের অনুমান রূপ-সনাতনাদির ন্যায় বাসুদেব ঘােষও ১০০ বছরের অধিক কাল জীবিত ছিলেন। শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকার বা নরহরি ঠাকুরের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বাসু খুবই দুঃখিত হয়েছিলেন। বন্ধুপ্রতীম গুরুভ্রাতার মহাপ্রয়াণে বাসুর পদে প্রতি ছত্রে সেই শােক ও দুঃথের বেদনা ঝরে পড়েছে–
“গৌরাঙ্গ বিরহ জ্বরে হিয়া ছটফট করে,
জীবনে না বাঁধে যে হা।
না হেরিয়া চাঁদমুখ বিদরিতে চাহে বুক,
কেমনে করিতে চাহে থে হা।
প্রাণের হরি (নরহরি) ! হরি কহ মাের জীবন উপায়,
এ দুঃখে দুঃখিত যে এ দুঃখ জানয়ে সে
আর আমি নিবেদিব কায়।
গৌরাঙ্গ মুখের হাসি সুধা খসে রাশি রাশি,
তাহা আমি না পাই দেখিতে।
যত ছিল বন্ধুগণ সভে ভেল নিকরুণ,
আমি জিয়ে কি সখ খাইতে।
গদাধর আদি করি না দেখিয়া প্রাণে মরি,
মইলু মইলু মধুমতী না দেখিয়া।
যে মােরে করিত দয়া সে গেল নিঠুর হয়া,
বাসু কেন না গেল মরিয়া।” (বাঃ পঃ -১৪৯)
–বৈষ্ণব সমাজের মতে বৃন্দাবনের মধুমতী সখীই ছিলেন গৌরাঙ্গ পরিকর নরহরি ঠাকুর। নরহরি ঠাকুরের মৃত্যুর পরে পরেই বাসুদেব ঘােষের মৃত্যু হয়। সঠিক ইতিহাস না থাকায় পরবর্তী গবেষকরা এক একজন এক এক রকমের মতামত প্রকাশ করে গেছেন। তবু অনুমান করা হয় শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকার ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে এবং বাসুঘােষ ১৬০১ খ্রীষ্টাব্দে মারা গিয়েছিলেন। কথিত আছে বাসু প্রায় ১১৯-২০ বছর পরমায়ু লাভ করেছিলেন। জনশ্রুতি এটাও বলে যে, বাসু কিছুকাল সংসার জীবন যাপন করেন। কিন্তু বাসুর পদ অন্য কথা বলে। চৈতন্যচরণে নিবেদিত প্রাণ বাসুর জীবন-সাধনার আর্তি ফুটে উঠেছে এই পদে–
“গােরা মােরে দয়া না ছাড়িও
আপন করিয়া মােরে চরণে রাখিও।
তােমার চরণ লাগি সব তেয়াগিনু
শীতল চরণ পাঞা শরণ লইনু।
একুলে ওকুলে মুই দিনু তিলাঞ্জলি
রাখিও চরণে মােরে আপনার বলি।
বাসুদেব ঘােষ বলে চরণে ধরিয়া
কৃপা করি রাখ মােরে পদছায়া দিয়া ৷৷”
~o~ সমাপ্ত ~o~