২০১৩/৩/৪
।।ভাগবত-কথা।।
“কৃষ্ণবর্ণং ত্বিষাকৃষ্ণং সাঙ্গোপাঙ্গাস্ত্র-পার্ষদম্। যজ্ঞৈঃ সংকীর্তন-প্রায়ৈর্যজন্তি হি সুমেধসঃ।।”__যাঁর মুখে কৃষ্ণনাম, বর্ণ যার গৌর এবং অঙ্গ-উপাঙ্গরূপ অস্ত্র ও পার্ষদ নিয়তই যাঁর বর্তমান, তাঁকেই সুমেধাগণ নামসংকীর্তনরূপ যজ্ঞ দ্বারা উপাসনা করে থাকেন । শ্রীমদ্ভাগবতের 11/ 5 /29_ শ্লোকে যেন চৈতন্যপ্রভুর মহিমার কথাই বর্ণনা রয়েছে__ অন্তত কৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাশয় সেইরূপই _এর ব্যাখ্যা করেছেন । তিনি লিখেছেন __”কৃষ্ণ এই দুই বর্ণ সদা যাঁর মুখে / অথবা কৃষ্ণকে তিঁহো বর্ণে নিজ সুখে।।….. ………..
দেহকান্তা হয় তার অকৃষ্ণবরণ / অকৃষ্ণবরণে কহে পীতবরণ।।………………
অন্য অবতার সব সৈন্য শস্ত্র সঙ্গে/ চৈতন্যদেবের সৈন্য অঙ্গ-উপাঙ্গে।।
পুরাণপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য পদযুগলে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর পার্ষদকুলের জীবনালেখ্য বর্ণনার প্রয়াস করছি । এখনকার নিবেদন শ্রীজীব গোস্বামীর পূত জীবনচরিত, তা জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় কিছুটা প্রকাশিত হয়েছে, এই সংখ্যায় তার পরের অংশ। শ্রীজীব গোস্বামী নিত্যানন্দ প্রভুর আদেশে বৃন্দাবনে গিয়ে পৌঁছালেন, তখন তাঁর পিতৃব্যদ্বয় অর্থাৎ রূপ ও সনাতন বৈষ্ণবসমাজের শিরোমনি, তাঁদের তখন ওখানে একছত্র আধিপত্য । শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মাত্র কিছুদিন হোল অপ্রকট হয়েছেন, ফলে গোস্বামী বৈষ্ণব ভক্তদের মনের মধ্যে তখন গভীর শোকের ছায়া! রূপ-সনাতন নিজেরাই শোকে অধীর, তাঁরাই বা বাকিদের কি সান্তনা দেবেন ! শোনা যায় মহাপ্রভুর মহাপ্রয়াণের সংবাদ পাওয়ার পর সনাতনের এতো তীব্র শোক হয়েছিল যে, তাঁর সারা শরীর সর্বদা আগুনের ন্যায় উত্তপ্ত হয়ে থাকতো_জল পড়লে বাস্প হয়ে যেতো, শুস্কপত্র গায়ের উপর পড়লে তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতো!
সেই রকম একটা দুঃসময়ের মাঝে ঐ দুই মহাপুরুষের নিকট এসে উপস্থিত হোলেন শ্রীজীব। প্রথমেই তিনি গুরুজনদের চরণ বন্দনা করে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন । শ্রীরূপ-সনাতন লক্ষ্য করে বুঝতে পারলেন যে, তার অন্তরে কৃষ্ণপ্রেমের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে । তাঁদের বংশের একমাত্র উত্তরসূরির এই অবস্থা দেখে তাদের মনে যারপরনাই আনন্দ হোল। কুঞ্জে কুঞ্জে ঘুরে ঘুরে তাঁরা বিভিন্ন আচার্যদের সাথে শ্রীজীবের পরিচয় করিয়ে দিলেন । শ্রীজীবের নয়নাভিরাম মূর্তি, অতুলনীয় প্রতিভা ও শ্রদ্ধা ভক্তি সকলেরই প্রশংসা অর্জন করলো।
বৃন্দাবনে তখন বৈষ্ণবদের সুবর্ণযুগ, আগে থেকেই রূপ, সনাতন, রঘুনাথ ভট্ট, ছাড়াও লোকনাথ, ভুগর্ভ স্বামী, প্রবোধানন্দ প্রমূখ তৎকালের বৈষ্ণব শিরোমনিরা বৃন্দাবনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে দিয়েছেন । গোস্বামী কুলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য শ্রীজীবও যখন পাকাপাকিভাবে বৃন্দাবনে থাকতে এলেন_ তখন বৃন্দাবন যেন আলোয় ঝলমল করে উঠলো। কিছুদিনের মধ্যেই এই নবাগত সাধক বৈষ্ণবসমাজে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেললেন । ব্রজমন্ডলের ভক্তি-সাম্রাজ্যের ভাবী নায়ককে চিনতে ভক্তসমাজের বেশি দেরী হোলো না। সনাতন শ্রীরূপের হাতে শ্রীজীবকে সমর্পণ করে দিয়ে বললেন _”আমাদের সন্তানসম এই প্রিয়দর্শীকে তুমি বৈষ্ণবীয় দীক্ষা দান করে এর ভক্তি-সাধনার পথকে প্রশস্ত করে দাও!” সিদ্ধ সাধক শ্রীরূপের মন্ত্রদীক্ষা যেন চৈতন্যময় ! গুরু উপদিষ্ট সাধনপথে শ্রীজীব নিষ্ঠাভরে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং কিছু কালের মধ্যেই ভক্তিশাস্ত্রের নিগূঢ় তত্ত্বসমূহ অচিরেই তাঁর বোধগম্য হতে থাকলো। তাঁর সহজাত প্রতিভা ও মনীষা তো ছিলই, তার সাথে যুক্ত হোলো রূপ গোস্বামী প্রদত্ত সাধন বল।
ভারতের নানা প্রান্ত থেকে তখন নানান পণ্ডিতেরাও ব্রজমন্ডলে আসতো। রূপ-সনাতনের ন্যায় পরম জ্ঞানীদের সংস্পর্শে থেকে বা তাঁদের সাথে বিভিন্ন শাস্ত্র আলোচনা করে জ্ঞানসমৃদ্ধ হয়ে তারা আপন আপন স্থানে ফিরে যেতো। কিন্তু কেউ কেউ আসতো দিগ্বিজয় করার জন্য । তারা ভাবতো_রূপ গোস্বামী শাস্ত্রবিদ এবং বৈষ্ণব সমাজের নেতা, সুতরাং তাকে যদি তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করা যায়_ তাহলে বৃন্দাবনের সমস্ত পন্ডিতসমাজ তাকে শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নেবে। কিন্তু এইসব শাস্ত্রীয় কুটকাচালি বা তর্ক-বিতর্কে অংশগ্রহণ করা শ্রীরূপের একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। তাঁর কাছে কোনো পন্ডিত এইরূপ আবদার নিয়ে আসলে _শ্রীরূপ তাকে বিজয়পত্র লিখে দিতেন। নব্য যুবক শ্রীজীব গোস্বামী গুরু তথা পিতৃব্যের এই বিনয়কে মান্য করতেন কিন্তু যে ব্যক্তি শ্রীরূপের বিজয়পত্র লাভ করল তার অহংকারকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। একজন অনধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এতো বড় মহাত্মার অকারণ এতটা মহানুভবতার কারণ কি__ তা ঠিক বুঝে উঠতে পারতেন না। এই রকমই অসহিষ্ণু হয়ে পড়ায় ব্রজমন্ডলে একবার এক বিশাল কান্ড ঘটে গিয়েছিল। এবার সেই ঘটনার উল্লেখ করছি।
রূপ গোস্বামী সেই সময় তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’_ রচনায় ব্যস্ত । মহাসাধক যেন মহাসাধনায় মগ্ন _আহারে রুচি নাই, দেহের বোধ নাই_ শুধু সর্বদা ভক্তিরসামৃতে অবগাহন করে রয়েছেন। ভক্ত-শিষ্য শ্রীজীব প্রাণপনে তাঁর সেবা করে চলেছেন একমনে। তাঁর আহার, স্নান, নিদ্রার ব্যবস্থা করেন,কখনো কোনো পুঁথি খুঁজে দেন, কখনো আকর গ্রন্থ থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করে রূপকে সাহায্য করেন । দাক্ষিণাত্যের বৈষ্ণব নেতা বল্লভ ভট্র একদিন শ্রীরূপ গোস্বামীর কুটিরে এসে হাজির হোলেন । ভট্টজী বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায়ের প্রবর্তক, বৈষ্ণব সমাজের এক প্রতিষ্ঠাবান আচার্য । রূপ গোস্বামী তাঁকে পরম সমাদরে অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। সামান্য কুশল বিনিময় ও জল সেবনের পর শুরু হোলো ধর্মালোচনা, শাস্ত্র আলোচনা । আলোচনা প্রসঙ্গে সদ্য রচনারত গ্রন্থটির কথা উঠলো এবং সেখান থেকে দুই-এক সর্গ পাঠ করে ভট্টজিকে শোনালেন শ্রীরূপ গোঁসাই । ভট্টজির কপাল মন্দ _শুধুমাত্র মঙ্গলাচরণ পড়া সম্পন্ন হয়েছে বল্লভ তার স্বল্প ব্যাকরণ জ্ঞান দিয়েই রচনার ভুল ধরতে শুরু করে দিলেন। শ্রীজীব একপাশে বসে বসে কথাগুলি শুনছিলেন, তিনি স্পষ্টতই বল্লভের পল্লবগ্রাহী পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবহিত হোলেন কিন্তু গুরুর সন্মুখে কোন কথা বলতে পারছিলেন না। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, শ্রীরূপ গোস্বামী কিন্তু ভট্রের কথা মেনে নিলেন এবং তিনি যেখানে যেখানে ব্যাকরণগত ভুল ধরছিলেন সেইগুলোই তার কথামতো তৎক্ষণাৎ সংশোধন করে নিলেন।এটা দেখে বড় ব্যাথা পেলেন শ্রীজীব গোস্বামী । কিছুক্ষণ পর মধ্যাহ্ন আগত দেখে রুপ গোস্বামী স্নান আহ্নিকের জন্য উঠে যেতেই শ্রীজীব পণ্ডিতকে আহবান করে বললেন _”ভারী পন্ডিত তুমি! ব্যাকরনের তূমি কি বোঝো ? কত রকমের ব্যাকরন রয়েছে, আর কত রকম সূত্রের প্রয়োগ রয়েছে, ব্যতিক্রম রয়েছে আর্ষ প্রয়োগ রয়েছে __এসবের জ্ঞান রয়েছে তোমার? তুমি ভুল ধরতে এসেছো_ মহাজ্ঞানী শ্রীরূপ গোস্বামীর?”_ এই বলে তিনি ভক্তিশাস্ত্র থেকে অজস্র প্রমাণ উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়ে দিলেন এবং প্রমাণ করে দিলেন যে, তাঁর গুরুর লেখায় কোন ভুল তো ছিলই না বরং তা উৎকর্ষতার সৌকর্যে পূর্ণ। শ্রীজীবের মনীষা, অকাট্য যুক্তিজাল ও শাণিত মন্তব্যের আঘাতে ভট্রজী একেবারে দমিত, বিস্মিত, হতবাক হয়ে গেলেন ! শাস্ত্র বিচারে এমনভাবে পরাজিত তাকে কখনো হোতে হয়নি । ভাবতে লাগলেন _কে এই অতিমানবিক প্রতিভার অধিকারী! কে এই শাস্ত্রবিদ নবীন যুবক ! পরাজিত ও অপমানিত পন্ডিত সেই মুহূর্তেই স্থান ত্যাগ করার বাসনা করে সদলবলে বেরিয়ে পড়লেন কিন্তু পথিমধ্যে শ্রীরুপের সাথে দেখা! কি ব্যাপার ! অসময়ে অতিথি বিমুখ কেন? কি ঘটেছে? ভট্টজী সবিস্তারে জানালেন এবং তরুণের অসম্ভব প্রতিভার কথাও জানাতে ভুললেন না ! কিন্তু অতিথির মুখে সমস্ত ঘটনা অবগত হয়ে ক্ষণকালের জন্য শ্রীরূপের এতকালের সাধনা, আদর্শ ও সংযমের বাঁধ ভেঙে গেল! তার পরম দৈন্যময় রূপটি পরিবর্তিত হয়ে গেল ! ভজন কুটিরে প্রবেশ করেই তিনি আহ্বান করলেন শ্রীজীবকে! তিরস্কার করে তাকে বললেন_” মূর্খ শুধু শুধু প্রবীন এক আচার্যকে কেন আক্রমণ করেছো? আত্মসংযম যদি না থাকে_ তাহলে কেনো এই ত্যাগ ও বৈরাগ্যময় জীবন গ্রহণ করেছিলে? শুধু তিলক কেটে আর কন্ঠীধারণেই বৈষ্ণব হয় না, তোমার মতো মূঢ়ের আর মুখদর্শন করতে চাইনা ! দূর হও _আমার সন্মুখ থেকে ! রাঢ় বাংলার কবি কালিদাস রায় এই ঘটনাটি তার কবিতায় বর্ণনা করেছেন নিম্নরূপে_”শুচি হয়ে তুমি আসো নাই আজি স্নান করে যমুনায় / যশপ্রতিষ্ঠা শুকরীবিষ্ঠা মেখে এলে সারা গায়। মুখদর্শন করিব না তব__বৃথা তোমা পালিলাম / রাজসভা তব সুযোগ্য ঠাঁই, নহে এই ব্রজধাম!!” __গুরুর আদেশ অমান্য করা যায়না ! তাই কৃষ্ণা পাবার জন্য গুরুর পদপ্রান্তে পড়ে কতই কাঁদলেন শ্রীজীব! কিন্তু গুরু কঠোর, অনমনীয়। ধীরে ধীরে শান্তপদে ব্যথিত হৃদয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন শ্রীজীব _আশ্রয় নিলেন বৃন্দাবনের প্রান্তে যমুনার তীরে গভীর অরণ্যে । সেখানে শুরু হোলো তার কৃচ্ছব্রত ও কঠোর সাধনা! এ যেন “শাপে হোল বর!” গুরু-ই যেন তাঁর শিষ্যের সাধনার জোর বাড়াবার নিমিত্তই এই শাস্তি বিধান করেছেন । মেনে নিলেন শ্রীজীব_ নতুন আঙ্গিকে জীবনকে, জগতকে, ঈশ্বরকে দেখার মানসেই এই কঠোর, কঠিন ব্রত গ্রহণ করলেন । “মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন”! দীর্ঘ অনাহারে, কঠোর সাধনায় আর অন্তরের আত্মগ্লানির তুষানলে ধীরে ধীরে জীর্ণ হতে থাকলো শ্রীজীবের কুসুমকোমল তনু! আকাশবৃত্তি অবলম্বন করে অরণ্যে পর্ণকুটিরে একান্তে এই কঠোর সাধনজীবনের এটাই চরম পরিণতি! কবে হবে গুরুর কৃপা, কবে হবে ইষ্টদর্শন ! সে কি এই জীবনে না জন্মান্তরে ? সাধনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেন শ্রীজীব! প্রার্থনা করেন__” না না _জন্মান্তরে নয়, এই জন্মেই আমার সবকিছু ধুয়ে মুছে যাক্, যাক সবকিছু পুড়ে খাক হয়ে!”
সনাতন গোস্বামী তখন বৃন্দাবনের বাইরে ছিলেন, এত ঘটনা ঘটে গেছে_ তিনি কিছুই জানতেন না ! হঠাৎ হৃদয়ে কেমন যেন বেদনা অনুভব করলেন তিনি! বৃন্দাবনে ফেরার জন্য যেন প্রাণটা আনচান করে উঠলো_ ফিরলেন বৃন্দাবনের পথে ! সনাতন ফিরছেন বৃন্দাবনে! এই কথায় বৈষ্ণবসমাজে আলোড়ন পড়ে গেল! বৈষ্ণব শিরোমনি আসছেন _অনেকে প্রত্যুদ্গমনের উদ্দেশ্যে অনেকটা পথ এগিয়ে গেল ! বৃন্দাবনের নিকটবর্তী অরণ্যে পৌঁছে সনাতন শুনলেন_ এক অরণ্যচারী কৃচ্ছব্রত অবলম্বনকারী নবীন বৈষ্ণবের কথা ! অতি দ্রুত সেখানে পৌঁছে তিনি দেখলেন অনাহারক্লিষ্ট ও তপোক্লিষ্ট মৃতপ্রায় শ্রীজীবের শরীরে অবিরত চলছে কৃষ্ণমন্ত্র জপ । সস্নেহে কোলে তুলে নিলেন শ্রীজীবের মাথা । মহাপুরুষের সংস্পর্শে শরীরে শক্তির সঞ্চার হোলো তাঁর। তিনি চোখ মেলে চেয়ে পিতৃব্যকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে তাঁর চরণবন্দনা করলেন । পুনরায় তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সনাতন। দুজনের অশ্রুধারায় পবিত্র হোল বৃন্দাবনের সেই অরণ্য ! সব ঘটনা শুনে সনাতন শ্রীজীবকে বললেন_” তুমি মনে কোন খেদ রেখোনা_ মহাপ্রভুর কৃপায় এই দুঃখভোগের মধ্য দিয়েই তোমার জীবনে তথা বৈষ্ণবসমাজে আসতে চলেছে মহাকল্যাণ। আমি বৃন্দাবনে ফিরে গিয়েই রূপের অনুমতি নিয়ে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো বৃন্দাবনে।
ফিরে গিয়ে সনাতন মিলিত হলেন প্রাণের ভ্রাতা শ্রীরূপের সাথে । প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর সুকৌশলে সনাতন ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ গ্রন্থের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। রূপ উত্তর দিলেন গ্রন্থ এখনো অসম্পূর্ণ_ কারণ শ্রীজীব তাকে সবরকম সাহায্য কোরতো, এখন আর তা হচ্ছে না_ তাই গ্রন্থের কাজ অসম্পূর্ণ।
“শ্রীরূপ কহেন প্রায় হইল লিখন/ জীবন রহিলেই শীঘ্র হয় শোধন।/ গোস্বামী করেন জীব জিয়া মাত্র আছে / দেখিনু তাহার দেহ বাতাসে হালিছে।” _ভক্তিরত্নাকর।
প্রাণপ্রিয় শিষ্যের সবকথা সনাতনের কাছে শুনলেন রূপ গোস্বামী। সনাতন শ্রীরূপকে বোঝালেন __জিনিবারে অভিমান পারে নাই জীবন,এখনো বালক_ আমাদেরই সন্তান/ তুমি তার তাত, তুমি গুরু ভ্রাতঃ _পারিলেনা আজো হায় / বৈষ্ণব হয়ে রোষ জিনিবারে দোষ কিছু নাই তার / সেই আছিলায় ত্যজিব তোমায় ? দীনতার অভিমান_তাও অভিমান, বৈষ্ণব মনে তাও কেন পাবে স্থান?”_কবি কালিদাস রায় ।
একথা শুনে কেঁদে উঠল শ্রীরূপের প্রাণ ! বললেন _”বৈষ্ণব হয়ে ক্ষমা করিতেতো পারিনিকো সন্তানে/ না বুঝে অশনি হেনেছি জীবের কুসুমকোমল প্রাণে ।/ যাও ভাই যাও এক্ষুনি গিয়ে ডেকে নিয়ে এসো তারে / না জানি কত না_ পায় সে যাতনা এ মূঢ়ের অবিচারে ।।” কালিদাস রায়।
বৃন্দাবনের অরণ্যে কৃচ্ছসাধনার পর্ব শেষ করে শ্রীজীব যখন ফিরে এলেন, তখন তিনি অন্য মানুষ ! সাধন-জীবনের স্বর্ণসম্পদে আরো অধিক উজ্জ্বল ! ঐকান্তিক ভক্তি ও অহংবিলুপ্তির চরম লক্ষণ ফুটে উঠেছে তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষাময় জীবনে! সাধনবল আর মনীষার ঘটেছে এক অপূর্ব সমন্বয় । গুরুর দেওয়া আঘাতের মধ্য দিয়ে সারা অন্তর জুড়ে বসেছে অপার্থিব প্রেম, জীবে প্রেম ও মানবকল্যানের চিন্তা ! শিষ্যের অপরূপ রূপান্তর দর্শনে গুরুর যেমন চোখের জলের ধারা নিষেধ মানে না_ তেমনি আনন্দের‌ও সীমা রইল না ! এবার থেকে শ্রীজীবের জন্য নির্মিত হোলো পৃথক ভজনকুটির! সেখানে পৃথক বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হোল_ যার সেবার ভার দেওয়া হোল শ্রীজীব গোস্বামীকে । সেই প্রেমময় বিগ্রহই “শ্রীরাধা দামোদর”।।