পূণ্যভূমি এই বঙ্গদেশ। কত ঋষি, মুনি, যােগী, মহাযােগী এই বঙ্গভূমিতে আবির্ভূত হয়ে গেছেন তা বলা সম্ভব নয়। পতিতপাবনী গঙ্গার চরণ স্পর্শে ধন্য হয়েছেন এই বঙ্গ সন্তানগণ। কালে কালে যুগে যুগে এই মহাজনরা বঙ্গমাতার রত্নভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার জন্য এখানে আবির্ভূত হয়ে তাঁদের প্রেমের ফসল বিতরণ করে কালজয়ী হয়ে কালগর্ভে নিপতিত হয়েছেন, রেখে গেছেন অমরকীর্তি। এইরূপ এক কীর্তিমান কালজয়ী পুরুষ অবধূত নিত্যানন্দ। প্রেমের অবতার শ্রীগৌরাঙ্গের আবির্ভাবের কিছু পূর্বে তিনি আবির্ভূত হন বীরভূমের একচক্রা গ্রামের হাড়াই পণ্ডিতের ঘরে। হাড়াই পণ্ডিতের ভাল নাম মুকুন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। হাড়াই পণ্ডিতের স্ত্রীর নাম পদ্মাবতী। একচক্রার কাছে মৌড়েশ্বর শিবের মন্দির। হাড়াই ও তাঁর স্ত্রী দুজনে শিবভক্ত ও পূজারী। দুজনেই নিবিষ্টচিত্তে শিবের পুজোয় ব্রতী থাকতেন। মাঘী শুক্লা ত্রয়ােদশী তিথিতে হাড়াইয়ের ঘরে পদ্মাবতীর ক্রোড়ে জন্ম নিলেন এক দেবশিশু। দিব্যকান্তি শরীর, মাথা ভরা চুল আর সদা হাস্যময় এই শিশু। যে দেখে সেই আর চোখ ফেরাতে পারে না। এই শিশুকে পেয়ে বাবা-মায়ের আনন্দের সীমা নেই। মনে মনে ভাবে কলির জীবকে তারণ করার জন্য শিব নররূপে এসেছেন । সন্ধ্যারতির বাদ্যধ্বনি শুনলেই শিশু হাত-পা নাড়তে শুরু করেন। বাবা হাড়াই তার নাম রাখলেন কুবের। নাম রাখলেন বটে কিন্তু এই নামে বাবার বেশ মন ভরলাে না। এইভাবে দিন কাটে, মাস কাটে, কুবের বড় হতে থাকেন। যখনই যে কোন বাদ্যধ্বনি শােনেন তখনই হাততুলে নাচতে শুরু করেন। এক বৈষ্ণব হাড়াই পণ্ডিতের বাড়িতে এসে শিশুকে দেখে খুব খুশি হয়ে বলে, “পণ্ডিত ছেলের কি নাম রেখেছাে ?” সকলে বলল, ‘কুবের পণ্ডিত’। বৈষ্ণব বলল—এ ছেলে বড় হলে মহাযােগী হবে, এর নাম রাখ নিতাই বা নিত্যানন্দ। কারণ নিত্য বা সর্বদা এই শিশু আনন্দে থাকে তাই এর নাম হােক নিত্যানন্দ। বৈষ্ণবের কথায় হাড়াই পণ্ডিত সম্মত ও সন্তুষ্ট হলেন। ছােটবেলা থেকেই নিত্যানন্দের কি সব অদ্ভুত অদ্ভুত খেলা। বেশীরভাগ খেলা কৃষ্ণের কালীয়দমন, বকাসুর-বধ, পুতানা-বধ বা শকট-ভঞ্জন। কংসের ধনুর্যজ্ঞে কেমন ধনুক ভেঙ্গেছে, কেমন দুই মল্লযােদ্ধা চানুর ও মুষ্টিককে ঘায়েল করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মা, বাবা চিন্তা করেন—এই শিশু কি করে জানলাে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলার কথা। পাড়ার ছেলেরা সবাই নিতাইয়ের নিত্য খেলার সঙ্গী। নিতাইয়ের বয়স যখন ১২ বছর তখন নবদ্বীপে গৌরচন্দ্রের আবির্ভাব হল। নিতাই হুঙ্কার করে উঠলেন—খেলার সাথীরা ভাবল কি ব্যাপার । এই ঘটনার পর থেকেই নিতাইয়ের মন উচাটন হতে থাকে। ঘরের বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করতে থাকেন। নিতাই-এর চঞ্চলতায় হাড়াই তাঁকে জাপটে ধরেন, এ যেন ‘ধরিয়া ধরিয়া পুন আলিঙ্গন করে। ননীর পুতুলী যেন মিলায় শরীরে’। এরপর একদিন সুযােগ এসে গেল, হঠাৎ এক দিব্যকান্তি সন্ন্যাসী হাড়াই পণ্ডিতের ঘরে উপস্থিত। হাড়াই সন্ন্যাসীর সেবার ত্রুটি রাখলেন না। সন্ন্যাসী হাড়াই পণ্ডিতের আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হলেন এবং যাবার সময় নিতাইকে ভিক্ষা চাইলেন। প্রথমে হাড়াই ও পদ্মাবতী চিন্তিত ও বিস্মিত হলেন। পরে ভাবলেন সন্ন্যাসীর অভিলাষ পূরণ করাই বিধেয়। উভয়ে প্রসন্ন চিত্তে সন্ন্যাসীর কাছে নিবেদন করলেন নিতাইকে। কিন্তু কে এই সন্ন্যাসী ! এ সেই বিশ্বরূপ, নিমাইয়ের দাদা। সন্ন্যাস নাম শ্রীশঙ্করারণ্য পুরী। মাধবেন্দ্রপুরীর যিনি গুরু লক্ষ্মীপতি পুরী তাঁর কাছ থেকেই বিশ্বরূপের দীক্ষা। বিশ্বরূপই নিত্যানন্দের অভিন্ন সত্তা বলরাম। গৃহত্যাগ করে নিতাইকে নিয়ে তিনি প্রথমে গেলেন বক্রেশ্বর, পরে বৈদ্যনাথ, গয়া, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন হয়ে হস্তিনাপুর। সেখান থেকে নানা তীর্থ পরিক্রমা করে একেবারে কন্যাকুমারী পর্যন্ত। বেশবাস অবধূতের মত। কিন্তু “নিরন্তর কৃষ্ণাবেশে শরীর অবশ। ক্ষণে কাঁদে ক্ষণে হাসে কে বুঝে সে রস ।৷” দাক্ষিণাত্যে পাণ্ডুরপুরে হাজির হয়ে শঙ্করারণ্য নিত্যানন্দকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে তাঁর সমস্ত যােগসত্ত্ব নিতাইয়ের মধ্যে সঞ্চারিত করে তাঁতেই বিলীন হলেন। এরপর নিত্যানন্দ সহস্র সূর্য সম প্রদীপ্ত হলেন। নিত্যানন্দ একা একাই ঘুরতে লাগলেন। নাম নিলেন অবধূত নিত্যানন্দ। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ভক্তিরসের মূর্ত প্রতীক মাধবেন্দ্র পুরীর সঙ্গে দেখা। এতে নিত্যানন্দ অন্তরে বল পেলেন। নিত্যানন্দ মাধবেন্দ্র পুরীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “যেখানে যাই সেখানেই দেখি কৃষ্ণের আসন আচ্ছাদিত। তবে তিনি কোথায় গেলেন ?” মাধবেন্দ্র পুরী বললেন, “তিনি নদীয়ায় গিয়েছেন, নাম নিয়েছেন নিমাই।” তাঁর লীলা শীঘ্র শুরু হবে। অবশ্য নিত্যানন্দ সবই জানেন তবে প্রমাণ করে জানতে চাইছেন। এই জানাই তাে ভগবানের সঙ্গে একাত্মতা। গৌরলীলার প্রধান সহচরই তাে নিত্যানন্দ। ছায়ার সঙ্গে যেমন কায়ার যােগ তেমনি গৌর ও নিতাই হরিহরাত্মা।
গৌরসুন্দর যখন গয়া থেকে নবদ্বীপে ফিরে নামযজ্ঞ শুরু করেছেন সেই সময়েই নিত্যানন্দেরও আবির্ভাব ঘটল তথায়। গৌরহরি ভক্তদের বলছেন—রাত্রে এক মহাপুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল যেন মনে হয় হলধর বলরামের আবির্ভাব হয়েছে নবদ্বীপে। স্বপ্ন দর্শনের পর গৌরহরি চলে এলেন নন্দন আচার্যের বাড়িতে। এসে দেখলেন নিত্যানন্দ অবধূতবেশে বসে আছেন। দর্শনেই উভয়ের ভাবের পূর্ণতা এল। নিত্যানন্দ স্থির থাকতে না পেরে প্রেমাবশে নিমাইয়ের আলিঙ্গনে ধরা দিলেন। নিতাই চুপি চুপি তাকে বললেন, ‘তুই সেই কানাই না-রে ? কিন্তু তাের চুড়া আর বাঁশি কই ?’ নিমাইয়ের ধীর উত্তর— ‘ব্রজের খেলা দৌড়ােদৌড়ি, নদের খেলা গড়াগড়ি, ব্রজের খেলা বাঁশির কান, নদের খেলা হরিগান। ব্রজের বেশ ধরাচূড়া, নদের বেশ কৌপীন পরা।’ নিতাই ব্যাস-পুজো করবেন গুরুপূর্ণিমায়। নিমাই বললেন, “ব্যাসের আসন তৈরি করে তার উপর পূজা শুরু করাে।” সে এক অভিনব ব্যাপার—নিমাই বললে, “ব্যাসকে মালা দাও।” আনন্দে মত্ত হলেন নিত্যানন্দ। হাতের মালা গৌরসুন্দরের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন। গৌরসুন্দর তখন ষড়ভুজ মূর্তি ধরলেন—
‘শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম-শ্রীহল-মুষল।
দেখিয়া মূৰ্ছিত হৈল নিতাই বিহ্বল।৷’
শ্রীবাসকে পরীক্ষাচ্ছলে নিমাই বললেন, ‘তুমি যে নামগােত্রহীন অবধূতকে তােমার ঘরে আটকে রাখছো এটা কি ঠিক হচ্ছে ?’ শ্রীবাস প্রভুর বাক্যে কিছুটা অবাক হলেও বুঝতে পেরে তাঁকে বললেন- ‘নিত্যানন্দ যদি মদিরা ও যবনীতে আসক্ত হয় আর তার জন্য যদি আমার ধন-প্রাণ, কুল-মান যায় তবু তাঁর প্রতি আমার বিশ্বাস অটুট থাকবে।’ প্রভু তাঁর নিতাইয়ের প্রতি বিশ্বাস দেখে শ্রীবাসকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তােমাকে বর দিচ্ছি লক্ষ্মী যদি নগরে নগরে ভিক্ষে করেও বেড়ায় তবু তােমার ঘরে দারিদ্র হবে না। আমার নিতাই চাঁদকে তােমার হাতে সমর্পণ করলাম।” শচীমাতা নিতাইয়ের হাত দুটো ধরে একদিন বললেন, ‘তুমি কি আমার বিশ্বরূপ’ ? নিতাই বললেন, ‘একথা কাউকে বলাে না।’
মায়ের আদেশে নিমাই নিত্যানন্দকে ভিক্ষা গ্রহণের অনুরােধ জানালেন। যাইহােক নিতাই খুশি মনে নিমাই পণ্ডিতের আতিথেয়তা গ্রহণে সম্মতি জানালেন। নিমাই নিতাই দুজনে পাশাপাশি ভােজনে বসলেন। শচীমাতা দেখলেন, যেন দুটি পাঁচ বছরের শিশু খাচ্ছে। দু’জনেই চতুর্ভুজ। নিমাই শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মবিশিষ্ট আর নিতাই শঙ্খ-চক্র-হল-মুষল সজ্জিত। শচীমাতা এই দৃশ্য দেখে ভাবাবেশে মূৰ্ছিত হয়ে গেলেন। সম্বিৎ ফেরার পর মা নিতাইকে বললেন, তুমি তােমার ছােট ভাই নিমাইকে দেখাে।
শ্রীবাস-সহধর্মিণী মালিনী নিতাইয়ের মহিমায় তাঁকে স্তব করতে লাগলেন। নিতাই বললেন, “ওসব ছাড়াে আমাকে খেতে দাও”। শচীমাতা নিতাইকে পাঁচটি ক্ষীর সন্দেশ খেতে দিলেন। মহাভাবাবেশে নিতাই দিগম্বর হয়ে গিয়েছিলেন। নিমাই বসন পরিয়ে দিলেন। তারপর নিতাই একটি সন্দেশ খেয়ে বাকিগুলি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। শচীমাতা বললেন, “কোথায় ফেললি।” নিতাই বললেন, ‘দেখগে ঘরে পাবে’। ঘরে ঢুকে দেখেন সন্দেশ থালায় সাজান আছে, তবে একটু ধুলাে লেগেছে। সেই সন্দেশ এনে নিতাইকে দিতে গিয়ে দেখলেন নিতাই চারটি সন্দেশ হাতে নিয়ে খাচ্ছেন। তারপর গৌরসুন্দর নিজের হাতে নিতাইকে মালা-চন্দন দিয়ে সাজালেন ও স্তব করতে লাগলেন। স্তব শেষে বললেন, “তােমার একখানা কৌপীন আমায় দাও।” কৌপীন পেয়ে টুকরাে টুকরাে করে ভক্তদের দিয়ে বললেন, এই “পবিত্র বস্ত্রখণ্ড মাথায় বাঁধাে, দিয়ে কৃষ্ণদাস হয়ে যাও।”
প্রভু আদেশ করলেন নিত্যানন্দ ও হরিদাসকে ঘরে ঘরে গিয়ে কৃষ্ণ নাম প্রচার করতে। নিতাই কৃষ্ণের নামের পরিবর্তে ‘ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে। / যে জন গৌরাঙ্গ ভজে সে হয় আমার প্রাণ রে।’ গাইলেন। পথিমধ্যে তাঁরা দেখলেন, দুই মাতাল রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছে, এরা কারা? এরাই নবদ্বীপের জগাই, মাধাই। নদীয়ার নগর কোটাল। হেন দুষ্কর্ম নেই যা করে নি। চুরি, ডাকাতি, পরগৃহদাহ, মদ্যপান, নারীনির্যাতন পর্যন্ত। দু’জনে তাদের নাম শােনাতে গেলেন। এঁদের দেখে–’ধর ধর’ করে তাড়া করল জগাই, মাধাই। নিত্যানন্দ, হরিদাস ছুটে পালালেন। গৌরাঙ্গ বিবরণ শুনে বললেন, ‘কেটে টুকরাে টুকরাে করে ফেলবাে ওদের’। নিতাই মনে মনে ভাবলেন—এবার তাে প্রভুর এ লীলা নয় এবার হিংসা ছেড়ে অহিংসার লীলা। এই সময় একদিন রাত্রে নিত্যানন্দকে বাড়ি ফিরতে দেখে জগাই-মাধাই বলে উঠল—’এই ব্যাটাই তাে নাম বিলুচ্ছে !’ ‘মার ব্যাটাকে’ বলে মদের ভাঙ্গা কলসীর কানা ছুঁড়ে মারল নিত্যানন্দের কপালে। জোর আঘাতে কপাল ফেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল। ভগবানে সমর্পিতপ্রাণ নিত্যানন্দের তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই—ওদের বললেন, ‘তােরা শুধু একবার হরিনাম বল, তােদের সমস্ত জ্বালা দূর হবে’। ‘মেরেছিস্ কলসীর কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না।’
গৌরাঙ্গের কাছে খবর পৌঁছাতেই তিনি তীব্র বেগে ছুটে এলেন, রুদ্রমূর্তিতে সুদর্শনকে আহ্বান করলেন। নিত্যানন্দ তাঁকে নিরস্ত করলেন, বললেন, “তুমি যে প্রতিজ্ঞা করেছ এ অবতারে অস্ত্র ধরবে না। অহিংসামন্ত্রে জগৎ উদ্ধার করবে।” প্রভু তবুও শান্ত না হলে নিত্যানন্দ বললেন, “প্রভু মাধাই আমাকে দ্বিতীয়বার মারতে এলে জগাই আমাকে বাঁচিয়েছে।” তখন প্রভু জগাইকে কৃপা করলেন। পরে নিতাইয়ের কৃপায় মাধাইও প্রভুর কৃপালাভ করল। মাধাইকে আলিঙ্গন করে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত করলেন। জগাই-মাধাই উদ্ধার হল। তারা পরম বৈষ্ণবে রূপান্তরিত হল—পরশমণির স্পর্শে লােহা সােনায় পরিণত হল।
নিমাই নিত্যানন্দকে বললেন, “আমার নবদ্বীপ লীলা শেষ। আমি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস নেব তবে আমাকে দেখে মানুষ অভিমানশূন্য হবে—হরিনাম গ্রহণ করবে’। নিত্যানন্দ ‘মায়ের কি হবে ?’ একথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন—’তুমি তাে সব জান। সবাই কাঁদুক–ওদের কান্নায় মানুষের হৃদয় দ্রবীভূত হবে আর তুমি তাতে ভক্তিবীজ রােপণ করবে। নিত্যানন্দ গৌরাঙ্গের চিরসঙ্গী। সন্ন্যাস নেবার সময়–এমন কি নীলাচলে যখন চলেছেন সেই পুরুষােত্তম লীলার নিত্যসঙ্গী এই নিত্যানন্দ। তাইতাে গৌর ছাড়া যেমন নিতাই নেই, তেমনি নিতাই ছাড়া গৌর নেই। একে অন্যের পরিপূরক। ছায়ার সঙ্গে কায়ার মত। তবু মাঝে মাঝে লীলামাধুর্য প্রকাশের জন্যে মজা করেন। নিত্যানন্দ ভাবাবেশে পুরীর জগন্নাথক্ষেত্রে বলরামের গলার মালা নিজের গলায় পরলেন। সেবক বলল, ‘আমি মত্ত হাতি ধরে রাখতে পারি কিন্তু এই অবধূতকে ছুঁতে না ছুঁতে মেঝেতে ছিটকে পড়লাম। এ কি মানুষ না আর কেউ !’ এবার প্রভুর দক্ষিণ যাবার ইচ্ছা হল। দাদা বিশ্বরূপের অনুসন্ধানে। এ তাে শুধুমাত্র ছলনা। আসল উদ্দেশ্য—দক্ষিণ খণ্ড উদ্ধার। মহাপ্রভু কাউকে সঙ্গে নিতে চাইলেন না। কিন্তু নিত্যানন্দ ও অন্যান্য ভক্তদের ব্যাকুলতায় প্রভুর সঙ্গী হলেন ব্রাহ্মণ কুমার কৃষ্ণদাস। দুই বছর দাক্ষিণাত্য পরিক্রমা করে শ্রীচৈতন্য নীলাচলে ফিরলেন।
তারপর একদিন নিত্যানন্দকে নিয়ে বসলেন গােপনে। বললেন—তুমি সুরধনীর তীরে গিয়ে হরিনাম বিলােও। জীবের দ্বারে দ্বারে হরিনাম বিলােবার জন্যই তাে তােমার আগমন। জীব পিপাসার্ত—শুষ্ক বিরস হয়ে আছে, তুমি তাদের হরিনাম দিয়ে শীতল কর। কাউকে যেন বঞ্চিত করাে না। ‘মূর্খ নীচ পতিত দুঃখিত যে জন, ভক্তি দিয়া কর গিয়া সবার মােচন’। “নাম-প্রেমে বিশ্ব ভরে দেব বলেই আমার নাম বিশ্বম্ভর। তুমিই আমার লীলার সহায়, আমার বিশ্বম্ভর নাম সার্থক কর।” মহাপ্রভুর আদেশ পেয়েই প্রভু নিত্যানন্দের এবার লীলা শুরু হল।