শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা ছিলাম গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র কথায় ! আমরা উক্ত গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদে বর্ণিত ‘কামতত্ত্ব’ বা ‘রসতত্ত্ব’ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এখন আমরা দেখবো – এই ব্যাপারে গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছেন ! এরপরে উনি বলেছেন – “– ‘এক’ এবং ‘বহু’-র মধ্যবর্তী অবস্থা হলো ‘দুই’, আর এই ‘দুই’-কে আশ্রয় না করলে ‘এক’ কখনও বহুরূপে প্রকাশিত হোতে পারে না।
এইজন্য ‘বহু’-র অবস্থাতেই ভেদ পরিদৃশ্যমান হয়। কিন্তু যখন ভেদ অপসারিত হয়, তখন যাবতীয় ভেদ, অভেদের মধ্যেই একাত্ম হয়ে থাকে।
সুতরাং যেখানে কেবল একই সত্তা এবং যেখানে একের মধ্যে দ্বিতীয়ের আভাস বিদ্যমান থাকে না, সেখানে ‘এক’ নিজেকে অপরোক্ষ অনুভব করতে পারে না। আর তা চিৎ-স্বরূপ হোলেও চেতন নয়। কারণ, আপন স্বরূপ সে আপনি ‘বোধেবোধ’ করতে পারে না ঐ অবস্থাতে। আর ‘বোধে বোধ’ বা আত্ম-সাক্ষাৎকার ব্যতীত আনন্দের – আস্বাদনও নাই।
তাই ‘এক’ অবিভক্ত সত্তার মধ্যেই ‘দ্বিতীয়’ সত্তার স্ফুরণ হয়ে ঐ অবস্থায় আনন্দের আস্বাদন হয়ে থাকে। এইজন্যেই বাউলগণ বলেন – নিত্যবৃন্দাবনে নিত্যলীলাবিলাস অনন্তভাবে অনন্তরূপে নিত্যনতুনভাবে প্রকাশিত হোচ্ছে। আর পরমরসিক রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ আপন স্বরূপশক্তি হ্লাদিনী স্বরূপিনী মহাভাবরূপা শ্রীরাধাকে দিয়ে নব নব লীলারস আস্বাদন করছেন। সহজিয়া বাউলগণ বলেন – এটাই নিত্যবৃন্দাবনে নিত্যরাস।”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! একটু বেশি পরিমাণ উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরা হোলো। এইটা করা হোলো – তার কারণ ‘এক’ ও ‘বহু’-র মধ্যবর্তী যে ‘দুই’ – এই ‘এক’, ‘দুই’ এবং ‘বহু’-র ব্যাপারটা ঠিকমতো বুঝতে গেলে এতোটা অংশ একসাথে করতেই হোতো – না হলে ঠিকমতো ব্যাপারটা ধরা যাচ্ছিলো না।
উপরোক্ত কথাগুলি থেকে একটা সহজ সত্যকথা যেন গুরুমহারাজের কাছে নতুন করে শিখলাম। সত্যিই তো – ‘এক’ এবং ‘বহু’-র মধ্যবর্তী অবস্থা হোলো ‘দুই’ ! কারণ এই ‘দুই’ না হোলে তো ‘বহু’ হোতেই পারবে না। এটাই তো চিরন্তন সত্যি কথা ! এরপরে উনি বলেছেন – ” বহুর মধ্যেই ভেদ দেখা যায়, কিন্তু যে সমস্ত সাধকের ‘ভেদদৃষ্টি’ (সাধনার দ্বারা) দূরীভূত হয়েছে – তখন সে বোধ করে যে, সমস্ত ভেদ, অভেদের মধ্যেই একাত্ম হয়ে রয়েছে।”
সুতরাং আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সাধনার প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য হওয়া উচিত মনোজগৎ থেকে, চিন্তার জগৎ থেকে ভেদভাব অপসারিত করা। এইবার গুরুমহারাজ আলোচনা করেছেন সেই ‘এক’ – ‘বহু’ হোলো কেন ? এর কারণ কি ? এই ব্যাপারে উনি বলেছেন – ‘যেখানে কেবল একই সত্তা এবং যেখানে ‘একে’র মধ্যে ‘দ্বিতীয়ে’-র আভাস বিদ্যমান নাই, সেখানে অপরোক্ষ অনুভব থাকে না। ঐ অবস্থাতে আপন স্বরূপ আপনি বোধে বোধ করা যায় না। ঐ অবস্থা ‘চিৎস্বরূপ’ কিন্তু তাকে ‘চেতন’ বলা যায় না। আর ঐ ‘এক’ অবস্থায় ‘বোধে-বোধ’ বা আত্মসাক্ষাৎকার হয় না বলেই আনন্দের আস্বাদনও হয় না ! কিন্তু ‘আনন্দ-আস্বাদন’-ই সেই ‘একে’-র বা সেই ‘মহৎ’-এর ইচ্ছা ! তাই তো অবিভক্ত সত্ত্বার মধ্যেই দ্বিতীয়ের স্ফূরণ হয়ে আনন্দের আস্বাদন হয়ে থাকে।
এরপরে গুরুমহারাজ বাউলমতের যে কথাটি তুলে ধরেছেন, সেটা হোলো – ‘ নিত্যবৃন্দাবনে নিত্যলীলাবিলাস অনন্ত ‘ভাবে’, অনন্ত ‘রূপে’ নিত্যনতুনভাবে প্রকাশিত হোচ্ছে। আর পরমরসিক রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ আপন স্বরূপশক্তি হ্লাদিনীস্বরূপিণী মহাভাবরূপা শ্রীরাধাকে দিয়ে নব নব লীলারস মাধুর্য্য আস্বাদন করছেন।’ প্রিয় পাঠক – এখানে কিন্তু “শ্রীরাধাকে দিয়ে আস্বাদন করাচ্ছেন”-ও বলা যেতো ! কিন্তু যেহেতু ‘হ্লাদিনীস্বরূপিণী মহাভাবরূপা শ্রীরাধা’,– সেই পরমরসিক রসরাজ শ্রীকৃষ্ণেরই আপন শক্তি – সেই অর্থে ‘করছেন’ বা ‘করাচ্ছেন’ একই কথা ! আদপে সেই অদ্বৈত ‘এক’ ও ‘অদ্বিতীয়’ পরমপুরুষই তো আপন স্বরূপশক্তি-স্বরূপা শ্রীরাধারূপে ‘দুই’ হয়েছেন – তাই সব রস তাঁর, সব রস তিনি – ” রসঃ বৈ সঃ “!
কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার খুবই মনোযোগ আকর্ষণ করছে, আর তা হোলো – ‘অনন্তভাবে অনন্তরূপে নিত্যনতুনভাবে প্রকাশিত নিত্যবৃন্দাবনে হওয়া যে লীলাবিলাস – এই ব্যাপারটি কি !! এটাই কি সর্বজীবের মধ্যে ঈশ্বরবোধ করা অথবা সকল পুরুষে শ্রীকৃষ্ণ এবং সকল নারীতে শ্রীরাধা আরোপ করে সাধনা করা ?? দেখুন – পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মমতেরই সৃষ্টিতত্ত্বের কথায় পুরুষ-প্রকৃতি, আদম-ইভ, শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীরাধা – ইত্যাদি কথাগুলি আছে। কিন্তু গুরুমহারাজ যেভাবে সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা করলেন – এমন রসযুক্ত করে বা এমন স্বচ্ছ-সাবলীল-সহজভাবে বললেন যে, আর কোথাও(কোনো ধর্মমতের শাশ্ত্রে) এই নিগূঢ় রহস্য ব্যক্ত করা হয়নি।
যাইহোক, আমরা এটাই বুঝলাম যে, সমস্ত জীবজগতের মধ্যে যত রস রয়েছে, যতরকম আনন্দের উপকরণ রয়েছে, আনন্দের আস্বাদন রয়েছে – সব আনন্দের উৎসই হোলো সেই রসিকরাজ রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ এবং এই মাধুর্য আস্বাদনের মাধ্যম হোলো ‘এক’ থেকে ‘দুই’ হওয়া অর্থাৎ রসরাজের স্বরূপশক্তি হ্লাদিনী-স্বরূপিণী মহাভাবরূপা শ্রীরাধার প্রকাশ।৷