জিজ্ঞাসু:—(সেদিন ঐ গ্রামে অগ্রহায়ণ মাসে পান্ত নবান্ন বা বাসি নবান্ন উপলক্ষে মাঠে ফুটবল প্রতিযোগিতার “ফাইনাল” খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। তাতে জোরে জোরে মাইক বাজছিল । তাছাড়া গুরু মহারাজের আসনের জায়গাটা নিয়েও একটু অসুবিধা ছিল। তাই একজন জিজ্ঞাসা করলো….)গ্রামের মাঠে আজ ফুটবলের ফাইনাল খেলা হোচ্ছে । সেইজন্য মাইক বাজছে। এতে আপনার কথা বলতে কোনো অসুবিধা হোচ্ছে না তো?( ওনার বসার জায়গাটা যেহেতু একবার বদলাতে হয়েছিল! সেইজন্যেও অসুবিধা হোচ্ছে কি না তা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল।) গুরু মহারাজ:—না,না ! অসুবিধা আবার কী ? দ্যাখো, সেই অর্থে পৃথিবী গ্রহটাই তো অসুবিধার জায়গা ! এখানে গ্রীষ্মকালে গরম, শীতকালে ঠান্ডা, বর্ষাকালে প্যাচপ্যাচে জল-কাদা তাই বলে কি মানুষ পৃথিবীগ্রহ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে নাকি ? এখানে অসুবিধাকে ‘সুবিধা’ করে নিতে হয়, তবেই মানুষ সুস্থচিত্তে, শান্তিতে এখানে বসবাস করতে পারে ! এটাই তো প্রকৃত অভিযোজন বা adaptation ! যে কোনো অবস্থাতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া ! অর্থাৎ যেখানে যেমন-সেখানে তেমন, যার যেমন- তার তেমন, যখন যেমন- তখন তেমন !! সে যাই হোক, ওই যে বলছিলে ফুটবল খেলার কথা, তা_ ফুটবল খেলা শুরুর ইতিহাস জানো তো ? Roman dynasty-র সময় রোমানদের সঙ্গে তৎকালীন ইউরোপের বিভিন্ন গোষ্ঠীর (স্যাক্সন, নরম্যান্ডি ইত্যাদি) যুদ্ধ লেগেই থাকতো ! নর্ম্যান্ডিরাই একসময় ইংল্যান্ড শাসন করেছিল, তবে বর্তমানে ফ্রান্সে বসবাসকারী অধিবাসীরা তৎকালীন নর্ম্যান্ডিদের বংশধর ! আর এখন যারা ইংল্যান্ডের অধিবাসী, তারা সবাই প্রাচীন অ্যাংলো-স্যাক্সনের বংশধর !
যাইহোক যে কথা বলছিলাম রোমানদের সঙ্গে যখন ইউরোপের বিভিন্ন গোষ্ঠীর যুদ্ধ হোতো, তখন রোমান সৈন্যদেরকে আদেশ দেওয়া হোতো তাদের মধ্যে যে যতোজন শত্রু পক্ষের লোক মারতে পারবে, তাদেরকে ততোটাই বেশি পুরস্কার দেওয়া হবে পুরস্কারের যোগ্য হিসাবে বিবেচিত করা হবে ! এই কারণে যুদ্ধের শেষে রোমান সৈন্যরা জয়লাভ করলে যে সৈন্য যতজন বিপক্ষ-সৈন্য মারতে পেরেছে, তাদের মাথাগুলো কেটে তাদের কমান্ডার বা সেনানায়কদের কাছে নিয়ে এসে দেখাতো ! ফলে, যে সব থেকে বেশি সৈন্য মারতে পারতো, তারা বেশি বেশি পুরস্কার পেতো ! এর ফলে বিজয়ী দলের সৈন্যরা কি কোরতো ওরা কাটা মুন্ডুগুলিকে লাথি মারতে মারতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গড়াতে গড়াতে সেনানায়কের ছাউনি পর্যন্ত নিয়ে আসতো ! এই দীর্ঘ যাত্রাপথে ওরা একে অপরের কাছ থেকে মুন্ড কেড়ে নিয়ে নিজের সংখ্যা বাড়াতেও চাইতো, ফলে পায়ে পায়ে মুন্ডু কাড়াকাড়িও হোতো।
যুদ্ধ মিটে গেলে সৈন্যরা চলে যেতো, কিন্তু ওই অঞ্চলের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের মনে ঐ যুদ্ধের প্রভাব বহুদিন পর্যন্ত থেকে যেতো ! তারাও খেলার ছলে একজনকে সেনানায়ক বানাতো এবং বাকিরা ছোটো ছোটো গোল গোল কাদার শুকনো তাল, অথবা ঘাস-খড়-পাতা ইত্যাদি দিয়ে বেঁধে বেঁধে প্রস্তুত গোল গোল জিনিসকে মুন্ডুর মতো বানাতো ! এরপর তারা লাথি মারতে মারতে এগুলি একটু দূরে বসে থাকা সেনানায়কের কাছে নিয়ে আসতো এবং নিয়ে আসার সময় নিজেদের মধ্যে কৃত্রিম মুন্ডুগুলি কেড়ে নিয়ে নিজের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করতো । এইভাবে ওই বল কাড়াকাড়ি করতে করতে কে আগে পৌঁছাবে সেই নিয়ে ছুটোছুটি চলতো, লড়াই চলতো ! এইভাবেই গোল একটা বস্তুকে কাড়াকাড়ি করা থেকেই ফুটবল খেলার সূত্রপাত হয়েছিল !
পরবর্তীকালে নানারকম বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকের ফুটবল খেলা এসেছে ! তবে, এখনো নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে প্রতিনিয়ত পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে খেলার ধরন-ধারণ বা নিয়ম কানুন।
তবে জানো, যেহেতু এই খেলার সূচনা হয়েছিল নরম্যান্ডি আর স্যাক্সনদের যুদ্ধের সময়কালে কাটা মুণ্ডু নিয়ে ! তাই এখনও দেখা যায় ইতালি এবং ইংল্যান্ডের যখন খেলা হয়__ তখন ওই দুই দেশের জনগণের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা শুরু হয়ে যায় ! ওদের মধ্যে খেলাগুলোও খুব tough game হয়, ‘হুলিগান’ বা ফুটবল গুন্ডারা মাঠে উপস্থিত হয়ে নানারকম ভাঙচুর করে, অশান্তি সৃষ্টি করে ! এইরকম বহুবার রক্তাক্ত এবং ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে ফুটবল মাঠে !
আমি যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরছিলাম (কিছুদিন আগেই গুরুমহারাজ ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে এসেছিলেন) তখন দেখেছিলাম যে, ইতালিয়ানরা এখনো ফুটবল পাগল ! ব্রাজিলিয়ানদেরকেও ফুটবল পাগল বলা হয় কিন্তু এই craze-টা ওদের আগে ছিল না, পরপর কয়েকবার বিশ্বকাপ পাওয়ায় ওই দেশের মানুষের মধ্যে এই উন্মাদনাটার সৃষ্টি হয়েছে ! কিন্তু ইতালিয়ানরা প্রকৃতই ফুটবল পাগল !ওই দেশের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা তাদের আয়ের একটা বড়ো অংশ ফুটবল ক্লাবগুলোর পিছনে খরচা করে ! ভাবতে পারবে নাএই ব্যাপারে ওদের craze ঠিক কতোখানি ! ওদের বিভিন্ন tournament -এর খেলাগুলো বা বিশ্বকাপের খেলাগুলো দেখলেই বুঝতে পারবে মনে হবে ওরা যেন প্রাণ বাজি রেখে খেলছে ! পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশ ফুটবলে ভীষণ উন্নতি করেছে ! এখন তো খেলাটা একটা শিল্পের পর্যায়ে চলে গেছে ! তবুও ইতালির ফুটবল খেলায় একটা প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় !