শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত এবং কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো। আমরা গুরুমহারাজের স্বহস্ত রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ বাউলের মর্মকথা-র চতুর্থ পরিচ্ছেদে বর্ণিত কামতত্ত্ব, রসতত্ত্ব, বিন্দু-বিসর্গের খেলা – ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনায় ছিলাম। এরপরে আমরা দেখবো – এইসব সম্বন্ধে গুরুমহারাজ আরো কি কি বলেছেন।
এরপরে উনি বলেছেন – ” শৈব এবং শাক্তগণ বিন্দুকে ‘শিব’ এবং বিসর্গকে ‘শক্তি’ বলে থাকেন। বৈদিকগণ বিন্দুকে ‘জ্ঞান’ বা ‘প্রকাশ’ এবং বিসর্গকে ‘কর্ম’ বা ‘বিমর্শ’ বলে থাকেন। যোগীগণ বিন্দুকে ‘পরমচৈতন্য’ এবং বিসর্গকে ‘প্রকৃতি’ বলে থাকেন। এইরূপ বৌদ্ধগণ বিন্দুকে ‘মহাশূন্য’ এবং বিসর্গকে ‘মহাসুখ’ বলে থাকেন। সহজিয়া বাউলগণ এই বিন্দু-বিসর্গের খেলাকে নিত্যবৃন্দাবনে ‘নিত্যরাসলীলা’ বা শ্রীরাধাকৃষ্ণের ‘কামকলাবিলাস’ বলে থাকেন। আর এই কামকলাবিলাস হোলো শ্রীরাধা-কৃষ্ণের ‘শৃঙ্গারক্রীড়া’ বা ‘রসরতি তত্ত্ব’।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ – গুরুমহারাজের কথার বিন্দু-বিসর্গ বুঝতে পারছেন কিছু ? শৈব ও শাক্ত মতে ঐ ‘বিন্দু’ হোলো শিব এবং বিসর্গ-ই শক্তি (কালী, দুর্গা ইত্যাদি)। বৈদিকমতে ঐ বিন্দু-ই হোলো ‘জ্ঞান বা প্রকাশ’ এবং বিসর্গ-কে কর্ম বা বিমর্শ বলা হয়ে থাকে। যোগশাস্ত্র অনুযায়ী যোগীগণ ঐ বিন্দুকে বলেন – পরমচৈতন্য এবং বিসর্গকে বলেন ‘প্রকৃতি’ ! বৌদ্ধগণ বিন্দুকে বলেন ‘মহাশূন্য’ এবং বিসর্গকে বলে থাকেন ‘মহাসুখ’ ! আর বাউলগণ এই বিন্দু-বিসর্গের খেলাকে বলেন – ‘নিত্যবৃন্দাবনে নিত্যরাসলীলা’ বা শ্রীরাধাকৃষ্ণের ‘কামকলাবিলাস !” – তাহলে ? তাহলে কি একটু হোলেও বোঝা গেল – ঐ আলোচনার বিন্দু-বিসর্গ বোঝা গেল কি? আমরা এটাই বুঝাতে পারলাম যে, বিন্দুই হোলো শিব, জ্ঞান, পরমচৈতন্য, মহাশূন্য অথবা পরমরসিক রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ ! আর বিসর্গ-ই হোলো শক্তিস্বরূপা, কর্ম বা বিমর্শ, প্রকৃতি, মহাসুখ বা মহাভাবময়ী শ্রীরাধা ! কিন্তু তাহলে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার মিলিত অবস্থাটা কি ? সেই মহাউল্লাসময় অবস্থাটার বর্ণনা দেওয়া যায় না, এটাই বোধহয় চিন্তা-মন-বাক্যেরও অতীত – অবাঙমনসােগোচর অবস্থা !
যাইহোক, আমরা আবার দেখবো – গুরুমহারাজ তারপরে আরো কি বলেছেন৷ এরপরে উনি বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্‌ – ঐ ক্রীড়া হোতে নিরন্তর ‘বাস্পোদ্গমের ন্যায়’ আনন্দরসের নির্গমন হোচ্ছে এবং তা প্লাবিত হয়ে সমগ্র বিশ্বে সঞ্চারিত হোচ্ছে। ঐ বিন্দু-বিসর্গের ক্রীড়া হোতে যে অমৃতস্রাব হোচ্ছে তাই শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলনজাত রসপ্রবাহের নামান্তর। ‘বিন্দু-বিসর্গে’-র খেলায় সংঘর্ষজনিত যে আনন্দরসের প্রাদুর্ভাব হোচ্ছে তা-ই মহাউল্লাসময় রসমাধুর্য্য। আর তা-ই ‘নন্দের নন্দন’।
এখন বুঝলে তো – শৃঙ্গারাত্মক কাম-কলাবিলাস কি ! রসিক বৈষ্ণবগণ একেই ‘উজ্জ্বল রস’ বলে বিশ্লেষণ করে থাকেন।”
প্রিয় পাঠক – সত্যি সত্যিই এইসব তত্ত্বকথা হৃদয়ঙ্গম করার মতো এতোটা উন্নত চেতনার মানুষ আমরা নই ! তাই গুরুমহারাজের উক্ত কথাগুলি একটু ভাসা ভাসা করেই আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের মধ্যে যারা সাধন-ভজনের দ্বারা নিজেদেরকে খানিকটা উন্নত করতে পেরেছেন – সে বা তারা হয়তো একটু বেশি বা একটু ভালো করে ধারণা করতে পারবে, ওটা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কম্মাে নয়। ‘বিন্দু-বিসর্গের যে খেলা নিরন্তর হয়ে চলেছে, সেখান থেকেই ‘বাষ্পোদ্গমের ন্যায়’ আনন্দ-রসের নির্গমন হোচ্ছে আর সেটাই সমগ্র বিশ্বে সঞ্চারিত হয়ে প্লাবিত করছে। অপ্রাকৃত শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধার (নিত্যকৃষ্ণ বা নিত্যরাধা) যুগলমিলনের যে কীর্তনগান প্রায়শঃই গাওয়া হয় – তার প্রকৃত রহস্য জানাটা কতটা দূরহ তা বুঝতে পারছেন কি? সৃষ্টিতত্ত্বের বিন্দু-বিসর্গের খেলা হোতে যে অমৃতসার বা আনন্দরস নির্গত হোচ্ছে – এটাই শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলনজাত রস হিসাবে প্রকৃত বৈষ্ণব এবং বাউলগণ বর্ণনা করেছেন। তাহলে আমরা সাধারণ মানুষেরা কি করে সেই সুগভীর অপার্থিব গূঢ়াতিগূঢ় রহস্যাবৃত তত্ত্বকে ধারণা করতে পারবো বলুন তো !!
এরপরের ছত্রে গুরুমহারাজ আবার আরও একটি গূঢ়াতিগূঢ় তত্ত্বের উল্লেখ করলেন, কারণ উনি বললেন – ” বিন্দু-বিসর্গের খেলায় সংঘর্ষজনিত সৃষ্ট আনন্দরস-ই মহাউল্লাসময় রসমাধুর্য্য এবং তাই ‘নন্দের নন্দন’ !” তাহলে কে-ই বা শ্রীকৃষ্ণ, কে-ই বা শ্রীরাধা, আর কে-ই বা ‘নন্দের নন্দন’ ! সবই তো মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল ! অবশ্য এই একাকার হওয়া (বহু থেকে দুই, দুই থেকে এক)-টাই বাউলগণের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ! যাইহোক, এরপরে গুরুমহারাজ বলেছেন – ‘ শৃঙ্গারাত্মক শ্রীরাধাকৃষ্ণের কামকলাবিলাস-কেই বৈষ্ণবগণ ‘উজ্জ্বল রস’ বলে থাকেন। তাহলে পরমবৈষ্ণব ষড়গোঁসাই-এর এক গোঁসাই শ্রীজীব গোস্বামী কেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম ‘উজ্জ্বল নীলমণি’ দিয়েছিলেন, তার একটু-আধটু ধারণা আমরা করতে পারলাম !
তারপরে এই পরিচ্ছেদের একেবারে শেষভাগে গুরুমহারাজ বলেছেন – ” প্রিয় আত্মন্ – সহজিয়া বাউলমতে পরমেশ্বরের অঙ্গকান্তি হোলো ব্রহ্ম। তাঁরা বলেন ব্রহ্ম জ্যোতিঃস্বরূপ। একেই ‘নিরঞ্জন’ বলে। যোগী, সিদ্ধ ও মুক্তগণ এই জ্যোতিঃস্বরূপ ব্রহ্মতেই চিত্ত প্রণিধান করেন।
তাঁদের(বাউলগণের) মতে শ্রীকৃষ্ণই পূর্ণব্রহ্ম। তিনি সনাতন দ্বিভূজ নরাকার। তিনি ব্রজপুরে অর্থাৎ সহজপুরে – নিত্যবৃন্দাবনে নিত্য বিহারশীল। তিনি চিরকিশোর, আর তাঁর অঙ্গছটাই হোলো জ্যোতিঃব্রহ্ম। চরাচর এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাঁর ঐ অঙ্গ ছটারূপ জ্যোতিঃব্রহ্ম হোতেই সৃষ্টি হয়ে থাকে।”