জিজ্ঞাসা– আচ্ছা বাবা, আপনি রস-সাধনার ধারাকে অব্যাহত রাখতে বিল্বমঙ্গল আদি পঞ্চরসিককেই কেন নির্বাচন করলেন ?
উত্তর– ভারতবর্ষে রস-সাধনার ধারাকে বিশেষভাবে ধরে রেখেছিলেন এবং এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এই পাঁচজনই। এই পঞ্চসিকের রসতত্ত্ব বা রস-রতিতত্ত্ব বাউল সাধনার এক অতি গুহ্য ও দুরূহ সাধন-প্রণালী । নারী এবং পুরুষের প্রাকৃত প্রেম বা ভালবাসাকে অবলম্বন করে অপ্রাকৃত রাধাতত্ত্বে বা কৃষ্ণতত্ত্বে পৌঁছানাে প্রকৃত অর্থেই এক অতি দুরূহ ও দুর্লভ সাধন প্রক্রিয়া। এঁরা পাঁচজন এই দুরূহ দুর্গম পথ অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছিলেন–দেহজ কামকে অতিক্রম করে চরম প্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং অন্তিমে কৃষ্ণসাক্ষাৎকার রূপ পরম লক্ষ্যে উপনীত হতে পেরেছিলেন । এই জন্যই এঁরা রসতত্বের পথিকৃৎ–এই ধারার পথপ্রদর্শক। বাউল পরম্পরায় নারী নিয়ে যাঁরা সাধন করেন তাঁদের কাছে আজও বিধমঙ্গল-চিন্তামণি অথবা জয়দেব-পদ্মাবতীর আদর্শস্বরূপ হয়ে রয়েছেন।
জিজ্ঞাসা– যদি কৃপা করে রসিক বিল্বমঙ্গলের অপূর্ব জীবনকথা কিছু বলেন, তাহলে বড়ই আনন্দিত হই।
উত্তর— বহুপূর্বে দাক্ষিণাত্যে কৃষ্ণবেণা নদীর তীরে এক কর্মমুখর গ্রামে বিশ্বমঙ্গল নামে এক ইন্দ্রিয়পরায়ণ ব্রাহ্মণসন্তান বাস করত ৷ প্রকৃতপক্ষে তার নাম ছিল লীলাশুক । নদীর অপর পারের গ্রামটিতে চিন্তামণি নামে একটি যুবতী নারী তার অনুপম রূপ ও যৌবনের দ্বারা বিভিন্ন পুরুষের মনােরঞ্জন করে জীবিকা নির্বাহ করত। পতঙ্গ যেমন অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে আগুনে ঝাঁপ দেয় এবং পুড়ে মরে, তেমনি বিল্বমঙ্গল তার প্রথম যৌবনের জোয়ারে ঐ নারীর রূপ-যৌবনের ফাঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিছুদিনের মধ্যেই বিল্বঙ্গলের চিন্তামণির প্রতি আকর্ষণ এত তীব্র হল যে, চিন্তার অদর্শন যেন বিল্বর কাছে অসহ্য মনে হল। যে কোন প্রকারে সহস্র কাজের ফাঁকে, সহস্র লাঞ্ছনাগঞ্জনা সহ্য করেও বিল্ব নদী পার হয়ে হাজির হােত চিন্তার দুয়ারে । তৎকালীন সমাজ-ব্যবস্থায় একজন ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে সামান্যা দেহােপজীবিনী এক নারীর সঙ্গ করা খুবই গর্হিত কাজ বলে বিবেচিত ছিল । ফলে বিল্বর পরিবারে তার পিতার উপর সামাজিক চাপ সৃষ্টি হতে লাগল । পিতা নানাভাবে বিল্বকে বােঝাতে লাগলেন। কিন্তু ‘চোর না মানে ধর্মের কাহিনী’। বিমঙ্গলের প্রথম বয়সের উন্মাদ দুর্দম কাম-বাসনা, তীব্র আসঙ্গলিপ্সা কিছুতেই তাকে ঘরে থাকতে দিত না, শত বাধা ছিন্ন করে ঠিক ছিটকে বেরিয়ে যেতাে চিন্তামণির কাছে। এতে অনেক সময় চিন্তামণিও বিরক্ত হােত। দরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তান তাে তাকে বেশী অর্থ-সামগ্রী দিতে পারে না ! আর অন্যান্য ধনীরা যারা তার কাছে আসে তারা চিন্তাকে অনেক অর্থ দেয়। কিন্তু বিশ্বমঙ্গল শুধু চিন্তাকে চায়, শুধু তার হয়েই থাকতে চায়। চিন্তা বুঝতে পারে বিল্বর দুর্নিবার প্রেমের স্পর্শ কিন্তু তার জীবনের ভবিষ্যৎ ভাবনাও তাকে ভাবিত করে। এই রকম উভয়সংকটে পড়ে একরকম করে কাটছিল দুজনার জীবন । এমন সময় একটা ঘটনা ঘটে গেল তাদের জীবনে যা জীবনদ্বয়কে সম্পূর্ণরূপে উলটে-পালটে দিয়ে গেল।
সামাজিক চাপ-নির্যাতন ও অপমান সহ্য করতে পেরে বিল্বমঙ্গলের পিতা অকস্মাৎ একদিন মারা গেলেন। সদ্য যুবক বিল্বমঙ্গল সংসারের কিছুই বােঝে না, জানে না সমাজের আইন-কানুন, বাস্তবের রূঢ়তা। বিধবা মাতার মর্মভেদী কান্না আর চারিপাশের শূন্যতা প্রথমটায় তাকে যেন বিহ্বল করে তুলল, ঘটনার আকস্মিকতা তাকে যেন ঘাবড়ে দিল । এই প্রাথমিক ঘাের কাটতে কাটতেই ক’দিন কেটে গেল–কিন্তু অকস্মাৎ চিন্তামণির কথা মনে এসে যাওয়াতে তার প্রাণটা যেন হু-হু করে উঠল। মনে হতে লাগল যদি পাখীর মত পাখা থাকত তাহলে এখুনি উড়ে গিয়ে চিন্তামণির কণ্ঠলগ্না হতে পারত সে। কিন্তু এদিকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা বিধান দিয়েছে যে, বিল্ব যদি অশৌচ অবস্থায় চিন্তার দ্বারস্থ হয় তাহলে পিতৃশ্রাদ্ধের দিন কোন ব্রাহ্মণ সেখানে উপস্থিত হবে না। মায়ের কাতর অনুনয় আর সাশ্রুনয়নের দিকে তাকিয়ে এবং পিতার প্রতি চির অকর্তব্যপরায়ণতার কথা স্মরণ করে কোনক্রমে দশটি দিন কাটিয়ে দিল বিল্বমঙ্গল ৷ আর তারপরেই সমস্ত ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন করে গভীর রাত্রে বেরিয়ে গেল চিন্তামণির উদ্দেশ্যে। সে রাত্রি ছিল বর্ষণমুখর–দুর্যোগপূর্ণ রাত্রি । পল্লীর প্রান্তর জনমানবশূন্য। অতিবড় দুঃসাহসীরাও গৃহকোণকে সুরক্ষার জন্য গ্রহণ করে নিশ্চিন্ত হয়েছে। শুধু বাইরের জগতের একমাত্র পথিক লীলাশুকরূপী বিশ্বমঙ্গল। চিন্তার রূপের মােহ আর যৌবনের আকর্ষণ তাকে পাগলের মত ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে। দুকূলপ্লাবী নদীর তীরে পৌঁছে লীলাশুক দেখল ঘাটের মাঝি তার পারানি নৌকা নিয়ে সন্ধ্যার প্রাক্কালেই স্বগৃহে চলে গিয়েছে, কিন্তু একখানা কলার ভেলার ন্যায় অবলম্বন ঘাটে আটকা রয়েছে। চিন্তার চিন্তায় বিভাের বাহ্যজ্ঞানশূন্য বিল্ব ভাবল নিশ্চয়ই চিন্তামণি তার জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছে। ফলে চিন্তামণিকে স্মরণ করে নিশ্চিন্ত হয়ে সেই ভেলাকে অবলম্বন করে সাঁতরে ওপারে পৌঁছে গেল তার বাড়ির দরজায়, আহ্বান করতে লাগল চিন্তামণিকে। কিন্তু বর্ষার ঝরঝর শব্দ আর ঘন ঘন বজ্রপাতের শব্দে নিদ্রামগ্ন চিন্তার কানে সেই শব্দ পৌঁছল না। অনন্যোপায় বিল্ব বাড়ীর চারিদিকের পাঁচিল অনুসন্ধান করতেই দেখল এক জায়গায় দড়ির মতো কি যেন একটা ঝুলছে। বিল্ব ভাবল চিন্তাই তার জন্য দড়ি ঝুলিয়ে রেখেছে পাঁচিল টপকানাের জন্য । খুশিতে ডগমগ বিল্ব সেই দড়ি অবলম্বন করে পাঁচিল ডিঙিয়ে চিন্তার ঘরের দুয়ারে করাঘাত করল। দরজা খুলে ঐ দুর্যোগের রাত্রে সর্বাঙ্গসিক্ত সদ্য পিতৃশ্রাদ্ধ-সম্পন্নকারী বিল্বকে দেখে চিন্তা অবাক ! ‘ কি করে এত রাত্রে এখানে এলে ?’ জিজ্ঞাসা করল চিন্তামণি । ‘ সর্বাঙ্গে দুর্গন্ধ মেখে মুণ্ডিত মস্তকে কৌপীনসর্বস্ব হয়ে এই কি তােমার অভিসার বেশ ?’ মিলনাকাঙ্খায় ব্যাকুল তখন বিল্ব উত্তর দিল, ‘কেন প্রেয়সী ! তুমিই তাে আমার আগমনের জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছিলে! ঘাটে ভেলা রেখেছিলে, প্রাচীরে দড়ি ঝুলিয়ে রেখেছিলে !’ বিস্মিত চিন্তা বলল, ‘সে কি! আমি তাে এসব করিনি, চল তাে দেখি কোথায় দড়ি, কোথায় ভেলা ?’ আলাে হাতে প্রাচীরের কাছে গিয়ে দেখা গেল এক বিষধর প্রকাণ্ড সাপ মরে ঝুলছে, যা বিল্বর শরীরের ভারের টানে মরে গেছে এবং একেই বিল্ব দড়ি ভেবে ধরে প্রাচীর টপকে ভিতরে এসেছে। এবার দুজনে ঘাটে এসে ভেলাটির দিকে তাকিয়ে দেখে একটি গলিত শবদেহ, যাকে অবলম্বন করে বিল্ব দুর্দাম কৃষ্ণবেণা নদী অতিক্রম করে এপারে এসেছে, তাই তার গায়ে এত দুর্গন্ধ ।
এই সমস্ত দেখে চিন্তামণি অবাক হয়ে গেল । এই ব্রাহ্মণ পুত্রের তার জন্য এত টান, এত আকর্ষণ ! সমস্ত ভয়কে অগ্রাহ্য করে–সমাজ-সংসারকে তুচ্ছ করে–এক হতভাগ্যা, পতিতা রমণীর জন্য এত ক্লেশভােগ ! এত প্রচেষ্টা—যেখানে মৃত্যুর হাতছানিও তুচ্ছ হয়ে যায় ! পতিতা রমণীর মধ্যে মা জগদম্বার লীলা প্রস্ফুটিত হল—সেই রমণী তীব্র ভৎর্সনা করে উঠলেন লীলাশুককে ; ‘হে ব্রাহ্মণতনয়, সামান্য রমণী চিন্তামণির রূপ-যৌবনের নেশায় পিতৃশ্রাদ্ধের অশৌচব্রত লঙ্ঘন করে তুমি যে উন্মাদের ন্যায় আচরণ করেছ, যেভাবে তীব্র আকর্ষণ ও ব্যাকুলতায় নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে বাহ্যজ্ঞান রহিত হয়ে এমন কর্ম করেছ–সেই আকর্ষণ, সেই উন্মাদনা যদি তুমি জগৎচিন্তামণির প্রতি সমর্পণ করতে, তাহলে তুমি জগতের রূপ-ঐশ্বর্য কেন স্বয়ং জগদীশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করতে পারতে! তােমার প্রেম জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারতাে!’ গভীর আবেগে সামান্যা রমণীর এই ভৎর্সনা, কামাতুর, রূপ-যৌবন-পিয়াসী লীলাশুকের অন্তর্জগতে তীব্র আলােড়ন তুলল। সে ভুলে গেল তার উদ্দেশ্য। প্রত্যাখানের নিদারুণ ব্যথা আর বিবেকের কষাঘাত তাকে চঞ্চল করে তুলল। সে ছুটে বেরিয়ে গেল সেই স্থান থেকে–বুকের মধ্যে তীব্র অনুরাগের দহন নিয়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় অনুতপ্ত চিন্তার জীবনেও নেমে এল আশ্চর্য পরিবর্তন। অতীতের অন্ধকার মুছে ফেলে চিন্তামণি ধীরে ধীরে হয়ে উঠল পরম বৈষ্ণবী।
এদিকে তীব্র অন্তর্দহ নিয়ে লীলাশুক ছুটে বেড়াতে লাগল একস্থান থেকে অন্যস্থানে। ‘ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর । পর কৈনু অাপন, আপন কৈনু পর।’ –সে এক নিদারুণ অবস্থা ! প্রাকৃত চিন্তামণি তখন অচিন্ত্য জগৎচিন্তামণি রূপে বিল্বর চিন্তাজগতের সমগ্র স্থান জুড়ে বিরাজ করছে । এই অবস্থার পূর্ণতা পরবর্তীকালে আমরা পাই শ্রীমন্মহাপ্রভুর জীবনে, তিনিও ‘হা কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ’ রবে বিলাপ করতে করতে বৃন্দাবনের পথে ছুটে চলেছিলেন। যাইহােক বিল্বর এই ভাববিভাের অবস্থায় তাঁর সামনে একদিন হঠাৎ হাজির হলেন সােমগিরি নামে একজন শৈব সাধক, যিনি পঞ্চাক্ষর শিব মন্ত্রের উপাসক। মুখে সর্বদা “ওঁ নমঃ শিবায়, শিবায় নমঃ’ –এই মন্ত্র জপ করে চলেছেন। সােমগিরি ঈশ্বর-আদিষ্ট হলেন, দেখলেন ভাবীকালের ভক্তিরসের স্রষ্টাকে। তাই তিনি নিজে শৈব হয়েও লীলাশুককে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত করলেন। সম্ভবত বিল্বমঙ্গল নাম তিনিই দিয়েছিলেন । কুষ্ণবেণা নদীতীরের গ্রাম্য ব্রাহ্মণ যুবক লীলাশুক আগামীদিনের ভক্তিরসের পথ প্রদর্শক বিল্বমঙ্গলে পরিণত হলেন । দীক্ষালাভ করে বিল্বমঙ্গলের হৃদয়ে কৃষ্ণপ্রেম শতগুণে বেড়ে গেল। “আজিও সেই বৃন্দাবনে বাঁশী বাজেরে, বাঁশীর সুরে যমুনার জল উজান বহেরে” –কোথায় সেই বৃন্দাবন, কোথায় সেই পবিত্র ধূলি, যেখানে কৃষ্ণের পদচিহ্ন আজও বিদ্যমান। কোথায় সেই যমুনা যেখানকার পবিত্র সলিলে কৃষ্ণতনু গন্ধ । কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদ বিমঙ্গল বৃন্দাবনের পথে।
অকস্মাৎ একি হােল, ‘মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম:’। এক সরােবরের তীরে বৃক্ষতলে ক্ষণিক বিশ্রামের নিমিত্ত বসে থাকার সময় সরােবরে স্নানরতা এক গৃহবধূকে দেখে বিল্বমঙ্গলের মনে বিকার উপস্থিত হােল। অতীতের সুখ-স্মৃতি, ইন্দ্রিয়ানুভূতি যেন সহস্র গুণে বর্ধিত হয়ে তার শরীর-মনকে গ্রাস করতে চাইল। কিন্তু বিল্বমঙ্গল আর সেদিনের লীলাশুক নয়। এখন বিল্বমঙ্গল কৃষ্ণচরণে নিবেদিতপ্রাণ পরমভক্ত, পরম ভাগবত। তাই বিবেকের প্রহরী তাঁর উন্মাদনার জোয়ারকে আটকে দিল । বিল্বমঙ্গল ঐ রমণীর স্নান সেরে সিক্তবসনে ফিরে যাওয়া লক্ষ্য করে তার পশ্চাদবর্তী হল । পোঁছে গেল সেই গৃহবধূর গৃহে। বধূটি লজ্জাবনত হয়ে দ্রুতপদে ঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করল । বিল্বমঙ্গল নির্নিমেষ নয়নে নিষ্ক্রান্তা বধূর বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। । গৃহস্বামী একজন সাধুর এইরূপ আচরণে কিছুটা বিব্রত বােধ করলেও তাকে ভিতরে আহ্বান করে তার সেবা করা কর্তব্য বলে মনে করলেন। তখন পাদ্যার্ঘ্য প্রদানের পর গৃহস্বামী বিল্বকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তিনি কিভাবে সাধুর সেবা করতে পারেন। গৃহস্বামীকে অবাক করে বিল্বমঙ্গল উত্তর দিল যে, তার স্ত্রীকে যদি তিনি একান্তে ঘরের ভিতর তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাতে দেন, তবেই অভিলাষ পূর্ণ হয় । উভয়সঙ্কটে পড়লেন গৃহস্বামী। একদিকে সতীর সতীত্বরক্ষা, অন্যদিকে গৃহস্থের ধর্মরক্ষা ! অবশেষে তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে পরামর্শ করে ধর্মরক্ষার তাগিদে সাধুর প্রস্তাবেই সম্মত হওয়া শ্রেয় বিবেচনা করলেন। রুদ্ধদ্বারে একাকী সন্ন্যাসী বিল্বমঙ্গল বধূটির অপূর্ব রূপলাবণ্য পরিদর্শন করতে লাগল নিবিষ্টভাবে। অনেকক্ষণ দেখার পর অন্তর থেকে তাঁর বিবেক বলে উঠল রে মন ! এই রক্তমাংস ক্লেদ-বিষ্ঠা-পূর্ণ নারীশরীরের প্রতি তাের এত লালসা! রে চক্ষু ! তুই প্রলােভিত করিস মনকে, তাই মন কৃষ্ণপাদপদ্ম থেকে উঠে এসে হাড়-মাংসের খাঁচার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে । অতএব এই চক্ষুর আর দরকার নেই। বিমঙ্গল রমণীকে বলল, ‘মা, তােমার মাথার কাঁটাদুটি তুলে ফেল, তােমাকে আলুলায়িত কুন্তলারূপে একবার দেখি। তারপর কাঁটাদুটি আমার হাতে দাও।’ রমণী সন্ন্যাসীর কথা মতই কাজ করল । তখন কাঁটাদুটি হাতে পেয়েই চকিতে বিল্বমঙ্গল সে দুটিকে গেঁথে দিল তার নিজের সুন্দর চোখে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে মুখমণ্ডলকে প্লাবিত করতে লাগল–নিদারুণ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল সাধু বিমঙ্গল। অসহায়া রমণী তার স্বামীকে আহ্বান করে ঘরে নিয়ে এলেন। তারা উভয়েই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য সচেষ্ট হলেন এবং বারম্বার সাধুর নিকট তাদের অপরাধের ভাগী করার কারণ জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। বিমঙ্গল বলল, “মা আপনাদের কোন অপরাধ হয়নি, পূর্ব সংস্কার কাটাতে বাধা দিচ্ছিল আমার এই চক্ষু, তাই তাকে অন্ধ করে বন্ধ করে দেওয়া হােল প্রাকৃত রূপতৃষ্ণাকে। আর আমার বিষয় কৃষ্ণদর্শনের কোন বাধা থাকল না। তােমাদের মঙ্গল হােক।” এই বলে অন্ধ বিল্বমঙ্গল দ্রুতপদে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার হাঁটতে লাগল বৃন্দাবনের পথে। কানে বাজছে বাঁশরীর সুর আর যমুনার কলকল শব্দ। মনে হচ্ছে এই বুঝি কাছেই বৃন্দাবন আর বেশি দূর নেই। অন্ধ ব্যক্তির পথচলা যে কি কঠিন, তা অন্ধজন ছাড়া কে বুঝবে ! বারবার মাটিতে আছাড় খেতে খেতে সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল তাঁর। কণ্টকাবৃত জঙ্গলে সহস্র কণ্টক বিদ্ধ হতে থাকল সারা দেহে। কতদূর আর কতদূর ! এখনও কি পরীক্ষার বাকি আছে প্রভু ! এখনও কি হয়নি প্রারব্ধের অন্ত! আর যে পারি না প্রভু ! চলচ্ছক্তিহীন অসহায় অন্ধ ভক্তের হাত ধরে তুমি নিয়ে চল প্রভু –তােমার মধুর বৃন্দাবনে, যেখানে গেলে তােমার দর্শন হবে। নিরন্তর হৃদয়বিদারী প্রার্থনায় কতক্ষণ আর চিন্ময়রূপী শ্রীকৃষ্ণ তত্ত্বরূপে–ঈশ্বররূপে থাকতে পারেন । ভক্তের কাছেই যে ভগবান ধরা দেন—তাই এক্ষেত্রেও তিনি বিল্বমঙ্গলের সামনে অবির্ভূত হয়ে ধরলেন তার হাত ৷ ‘কে?’ একি অপার্থিব স্পর্শ! সুন্দরী রমণীর শিহরণ মাখা স্পর্শ, পিতার স্নেহস্পর্শ ও মাতার মমতামাখা স্পর্শের থেকেও সহস্র গুণে মধুর এই দিব্য স্পর্শে বিশ্বমঙ্গলের দেহ-মন জুড়িয়ে গেল। মধুময় পদ্মগন্ধে আমােদিত হ’ল চারিপাশ। বিল্বমঙ্গল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে তুমি বালক?’ ‘আমি তো ঐ গাঁয়ের গােপবালক, আমার মা তােমার জন্যে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে, আর বলে দিয়েছে, তােমার হাত ধরে বৃন্দাবনে পৌঁছে দিয়ে আসতে।’ – বালক হেসে হেসে উত্তর দেয়। ‘আহা! প্রাণ জুড়ানাে কথা, এ যেন মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে আসা সঙ্গীতময় বাণী ৷ তাহলে তুমি আমাকে খাইয়ে দাও–আমি তাে খাদ্য দেখতে পাই না’—বিমঙ্গলের চালাকি। চতুর চূড়ামণির সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, “ওসব আমি পারবো না, তুমি ঐ গাছতলায় বসে নিজে নিজে খাও ।” এই বলে হাত ছাড়িয়ে চলে যায় বালক কিছুটা দূরে। ‘ওগাে ! আমি যে অন্ধ, আমার যে দিন-রাত সমান, কোথায় গাছ আর কোথায় তার তলা সেসব যে কিছুই জানি না আমি, তুমি আমাকে না চেনালে কি করে চিনব জগৎকে, তুমি না জানালে কি করে জানব জগতের রহস্য !’ আর্তনাদ করে উঠল বিমঙ্গলের হৃদয় ৷ আবার বালক এসে হাত ধরল, ‘তাহলে চল’। এবার আবার চালাকি করে বিল্বমঙ্গল নিজেই দুহাতে চেপে ধরল বালকের হাত । চতুর শ্রেষ্ঠের চতুরালি যে আরও বাড়া। কাঁকিয়ে কেঁদে উঠল বালক, ‘ছাড়াে ছাড়ো, আমার যে ব্যথা লাগছে?’ জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিল বালক। ছাড়া পেয়েই অমনি একটু দূরে গিয়ে বালকের সে কি খিল খিল করে হাসি!- ‘কেমন তােমাকে ঠকালুম !’ হাত ছেড়ে দেওয়ায় পথক্লান্ত বিল্বমঙ্গল পথের পার্শ্বে একটি কাঁটার ঝোপে গিয়ে পড়ল। সর্বাঙ্গ কাঁটা ফুটে রক্তাক্ত হয়ে গেল দেহ। কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়াল বিল্বমঙ্গল । ওর এরূপ অবস্থা দেখে বালকের সে কি হাসি–দেখলে তাে হাত ছাড়িয়ে নেবার মজাটা ! ভক্তপ্রবর, ভক্ত শ্রেষ্ঠ বিল্বমঙ্গল তখন ভক্তিরসের পরমভূমিতে অবস্থান করছে, তাই বীরভাবে বলে উঠলেন—
“হস্তমুৎক্ষিপ্য যাতােহসি বলাৎ কৃষ্ণ ! কিমদ্ভূত।
হৃদয়াদ্যদি নির্যাসি পৌরুষং গণয়ামি তে ।৷”
–“হে কৃষ্ণ! তুমি জোর করে আমার হাত ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছ, এতে আর বিচিত্র কি ? যদি বলপূর্বক আমার হৃদয় ছেড়ে চলে যেতে পারো, তাহলেই বুঝব তােমার পৌরুষ ।” এতবড় কথা বলা বা ভগবানকে এরূপ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার ক্ষমতা কি মহাজন ছাড়া আর কারও সাধ্য আছে। যার ভিতর, বাহির কৃষ্ণপ্রেমে আপ্লুত হয়ে আছে, সেই বীর ছাড়া—এ কথা কে বলতে পারে ! আর এই কথা শােনার পর কি কৃষ্ণ দূরে থাকতে পারেন, তিনি তাে দূরে নেই, তিনি তাঁর নিকটে, অতি নিকটে তাঁর কাছে–হৃদয় মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয়েই রয়েছেন ৷ তাই ভক্তাধীন ভগবান এবার শক্ত করে তাঁর হাত ধরলেন ৷ বিমঙ্গল বলল, ‘ আমি অন্ধ তাই বলে কি তােমার শ্রীরূপ দর্শন করতে পারবাে না ?’ ভগবান বললেন, ‘’চর্মচক্ষুতে যদি দেখা যেত তাহলে সহস্র সহস্র জীবগণ সদা-সর্বদা আমাকে দর্শন করত। আমি তােমার তৃতীয় চক্ষুর উন্মীলন ঘটাচ্ছি, তুমি সেই চোখ দিয়ে আমাকে প্রত্যক্ষ কর আর আমার অপরূপ লীলমাধুরী, ভক্তিরস ভক্তজনের মধ্যে ছড়িয়ে দাও।” বৃন্দাবনে পৌঁছে শ্রীকৃষ্ণনির্দেশিত পথে চলতে চলতেই একদিন বিল্বমঙ্গলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সাধিকা পরম বৈষ্ণবী চিন্তামণির সঙ্গে। বিমঙ্গলের গৃহত্যাগের পর সেও কৃষ্ণ অনুরাগিণী হয়ে গৃহত্যাগ করে। আর নির্দেশ হয় যে, বৃন্দাবনে তার সঙ্গে বিল্বঙ্গলের আবার দেখা হবে। এইভাবেই উভয়ের পরবর্তী কালের যুগল-সাধনা বা রস-সাধনার চরম উৎকর্ষতা ঘটতে থাকে । ফলস্বরূপ উভয়েরই কৃষ্ণসাক্ষাৎকার হয় এবং উভয়ের কাছেই শ্রীকৃষ্ণলীলা প্রকটিত হতে থাকে।
অপার্থিব জগতের সন্ধান পেয়ে বিশ্বমঙ্গলের সহায়তায় চিন্তামণিও দেখল তার আরাধ্য ও ইষ্টকে। বিল্বমঙ্গল প্রত্যক্ষ করতে থাকল প্রভুর লীলাময় রূপ। শ্লোকে শ্লোকে তার মুখ থেকে ঝরতে থাকল ভক্তিতত্ত্ব রসামৃত । যা পরবর্তীকালে “শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃত” গ্রন্থ নামে দক্ষিণ ভারতের ভক্তিরসের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হিসাবে অসাধারণ কদর লাভ করেছে। শ্ৰীমন্মহাপ্রভু দক্ষিণ ভারত থেকে এই গ্রন্থ আনিয়ে পূর্ব ও উত্তর ভারতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এইভাবে সামান্য ঘৃণ্যজীবন থেকে শুরু করেও এই মহাসাধক-সাধিকা উত্তরকালের জন্য এক পরম্পরার মহান পথিকৃৎ হয়ে আজও বেঁচে আছে সহস্র সহস্র সহজিয়া, মরমিয়া ভক্তের হৃদয়ে। ভক্তরা এখনও গানে গানে এদের বন্দনা করেন – ‘বিল্বমঙ্গল চিন্তামণি–এরাই প্রেমের শিরােমনি।