বৈষ্ণব বাবার কথা বলতে বলতে গুরুজী বৈষ্ণবতত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করতে লাগলেন। বৈষ্ণববাবা ছিলেন প্রকৃতই তত্ত্বজ্ঞানী, ফলে পরম ছলনাময় গুরুজীর স্বেচ্ছাপ্রসূত জিজ্ঞাসাসমূহের যথার্থ মীমাংসা করতে করতে তিনিও তত্ত্বের গভীরে ঢুকতে লাগলেন।
বৈষ্ণববাবা বলতে লাগলেন– দেখুন ভগবান ভক্তের জন্য কি না করতে পারেন, কিন্তু এটা জেনে রাখুন প্রকৃত ভক্ত হওয়া শক্ত কথা। ভগবান সর্বদাই ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য ব্যস্ত। গুরুজী এসব শোনার পর বললেন– আপনার কাছে ভক্ত-ভগবানের লীলামাধুর্য শুনে খুবই আনন্দ লাগল। কিন্তু আমার মনে একটা জিজ্ঞাসা রয়েছে–এই যে রাধা-কৃষ্ণ তত্ত্ব–এই রাধাটি কে ?
বৈষ্ণববাবা– বৈষ্ণবশাস্ত্রে রাধা হলেন বৃষভানুসূতা, আয়ানঘরণী। কিন্তু তত্ত্বগতরূপটি হল—রাধা হ্লাদিনী শক্তি, যােগশাস্ত্রে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি। কৃষ্ণ আহ্লাদে আহ্লাদিনী তাই হ্লাদিনী। রাধা হলেন শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপশক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তি।এই রাধাতত্ত্বকে আশ্রয় করে রসরাজ শ্রীকৃষ্ণ রাস রচনা করেন। তাই রাধাতত্ত্বকে আশ্রয় না করলে, এই তত্ত্ব না জানলে, কৃষ্ণতত্ত্ব কখনো জানা সম্ভব নয়। সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণই শ্রীরাধাকে আশ্রয় করে নিজেকে আস্বাদন করেন। তাই রাধারাণীর কৃপা ব্যতিরেকে শ্রীকৃষ্ণকে বােধ করা বা তাঁর কৃপা পাওয়া সম্ভব নয়। ঠিক তেমনিই জানবে নিত্যানন্দের কৃপা না পেলে চৈতন্যের দরজায় পৌঁছানো যাবে না। এইভাবেই জানবে এসব তত্ত্ব একে অপরের পরিপূরক। যথার্থ তত্ত্ববেত্তা বৈষ্ণববাবার কথা শুনে গুরুজীর হৃদয় অভিভূত হয়ে গেল। আর প্রেমিকের কাছে এসে–প্রেমময়ের অন্তরেও প্রেমের প্রবাহ বইতে লাগল, যার স্পর্শ বৈষ্ণববাবাও পেতে থাকলেন। কারণ তাঁর শরীরেও অশ্রু, স্বেদ, পুলক ইত্যাদি অষ্টসাত্ত্বিক ভাবের পুনঃ পুনঃ প্রকাশ হতে থাকল। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বৈষ্ণপ্রবর এবার গােপীদের সম্বন্ধে গুরুজীর কাছেই কিছু কথা জানতে চাইলেন । গুরুজী পরম প্রেমে উত্তর দিতে লাগলেন। বৈষ্ণববাবা জানতে চাইলেন গােপীদের প্রেমভক্তি সম্বন্ধে।
গুরুজী বললেন– যারা গােপনে গােবিন্দকে ভজনা করে তারাই গােপী। গােপীরা কতবড় ভাগ্যবান এবং কতবড় যােগিনী যে, তারা অহরহ মনে মনে গােপনে গোবিন্দকে ভজনা করে চলেছে। গােপীদের ভক্তি অবৈধী ভক্তি, গােপীদের প্রেম পরকীয়া প্রেম।
বৈষ্ণববাবা— অবৈধী ভক্তি কি ?
গুরুজী বললেন— যা বৈধ নয়, তাই অবৈধী৷ তিনি আলােচনা করতে লাগলেন– সাধারণ ভক্তরা বিধিবৎ ভক্তি করে, পূজা-অর্চনা করে ফুল, মালা, ধূপ-দীপ, ইত্যাদি সহকারে । এইভাবেই তারা ভগবানের আরাধনা করে থাকে এবং এর মাধ্যমেই তারা ভগবানকে তুষ্ট করতে চায় বা তাঁর কৃপালাভ করতে চায়। এগুলিই বৈধী ভক্তি। অর্থাৎ শাস্ত্রে যেমন যেমন নির্দেশ রয়েছে, ঠিক তেমনি করে থাকে। কিন্তু গােপীদের আরাধনা অবৈধী অর্থাৎ কোন বিধিবদ্ধ আচরণ বা অর্চনা নয় । আরাধ্যের প্রীতির জন্য সর্বদাই সচেষ্ট, নিজেদের কোন চাওয়া-পাওয়া বা আত্মতুষ্টির স্থান সেখানে নেই। এটা বােঝাতে একটা গল্পের অবতারণা করা যাক–তাহলেই ব্যাপারটা বােঝা যাবে। ভক্তপ্রবর নারদের একবার অহঙ্কার হয়েছিল যে, তার মত পরম প্রেমিক বা ভগবৎভক্ত আর জগতে কেউ নেই। অন্তর্যামী নারায়ণ সবই জানতে পারলেন এবং নারদকে শিক্ষা দেবার জন্য সময়ের অপেক্ষায় থাকলেন। যথারীতি একদিন নারদ ঢেঁকিবাহনে চেপে ভগবান সন্দর্শনে হাজির হলেন। কিন্তু গিয়ে দেখলেন ভগবানের শরীর খুবই অসুস্থ, তিনি মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছেন৷ নারদ তো এই অবস্থা দেখে খুবই ব্যাকুল হলেন এবং ভগবানকেই .জিজ্ঞাসা করলেন কি করলে তিনি যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পাবেন। ভগবান বললেন— ভক্ত-পদরজ: পেলে তবেই তিনি সুস্থ হবেন অথবা নয় । নারদ নিজে ভগবানের পরমভক্ত কিন্তু তাঁর শক্তি বৈধী, তাঁর পায়ের ধুলো ভগবানের মাথায় বোলাতে হবে একথা ভেবেই তিনি শিহরিত হয়ে গেলেন। ফলে অন্য কোন ভক্তের কাছে এটা পাওয়া যায় কিনা তার সন্ধানে বের হলেন । বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভক্তদের কাছে গিয়ে তিনি প্রভুর অসুস্থতার কথা জানালেন, কিন্তু সকলেই এক বাক্যে বললেন– ‘দেখুন যাঁর পদরজঃ পাবার জন্য আমরা দিবানিশি চিন্তা করছি, তাঁকে কি আমাদের পদরজঃ দিতে পারি।’
এই ভাবে সর্বত্র বিফল হয়ে নারদ এলেন ব্রজধামে, সেখানে ব্রজসুন্দরীরা যমুনায় জল আনতে যাচ্ছিল। নারদ গিয়ে পৌঁছাতেই তারাই জিজ্ঞাসা করল–’কি গো নারদঠাকুর, আমাদের প্রেমময়, রসরাজ কেমন আছে, তার শরীর কুশল তাে?’ বিরসমুখে নারদ বললেন, ‘তাঁর কথা অশিক্ষিত, সাধন-ভজনহীনা তােমরা শুনে আর কি করবে ! তবে এক সময় তিনি এখানে ছিলেন–তােমাদের কৃপা করেছিলেন, তাই বলছি তিনি খুবই অসুস্থ ।’ তিনি অসুস্থ একথা শুনেই কাঁখের কলস ফেলে দিয়ে গােপিনীরা ছুটে এল নারদের কাছে, বলল, ‘বল কি ! অসুখ, তাহলে কি করলে তা সারবে ? – আমরা যে কোন মূল্যে তা সারিয়ে তুলব।’ তাদের ব্যাকুলতা দেখে নারদ বিস্মিত হলেন, বললেন– ‘তােমাদের মনের এত জোর ! এত জোর তােমরা পেলে কোথায় ! যাইহোক, তাঁর সুস্থতার জন্য যা দরকার তা তোমরা দিতে পারবে না, কত মহা মহা ভক্তদের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম। দাও দেখি তােমাদের পায়ের ধুলো, যা মাথায় ঠেকালে প্রভুর মাথার যন্ত্রণা দূর হবে।’ একথা শুনে ব্রজগােপিনীদের সে কি হাসি। তারা বলল, ‘ও ঠাকুর এই কথা ! এই দ্যাখাে ধুলোয় পা মাখামাখি করে রেখেছি, এবার তােমার আঁচল পাতাে–নাও, কত ধূলাে নেবে নাও। তারপর তােমার প্রভুকে গিয়ে দাওগে যাও।’ এই বলে এক আঁচল ধুলাে সকলে দিয়ে আবার তারা যমুনার দিকে পা বাড়াল। নারদ এক আঁচল ধুলাে নিয়ে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল । শুধু একবার বলল, ‘তােমাদের পায়ের ধুলাে ভগবানের মাথায় লাগালে তােমাদের পাপ হবে না !’ ওরা যেতে যেতে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘ওসব পাপ-পুণ্য নিয়ে তােমরা মাথা ঘামিও, আমাদের রসরাজের যন্ত্রণামুক্তি ঘটবে–এটাই আমাদের কাছে বড় কথা। আমাদের কি হবে এনিয়ে আমরা কখনই চিন্তা করিনি আর এখনও করছি না। তুমি বরং দেরি না করে তাড়াতাড়ি যাও; প্রভুর রােগমুক্তি ঘটাও।’ নারদ কালক্ষেপ না করে ভগবানের কাছে পৌঁছে দেখলেন–ভগবান সুস্থ হয়ে বসে তাঁর দিকে চেয়ে মুচকি হাসছেন। নারদ সব বুঝতে পারলেন এবং সেই দিন থেকে তাঁর দর্পচূর্ণ হল এবং গােপিনীদের প্রেমই যথার্থ নিষ্কাম ও তারা নিষ্কপট, তা বুঝতে পারলেন । দ্যাখো, গোপীরা কোন তপস্যা করেনি, কিন্তু সততই তারা দু’নয়নে কৃষ্ণরূপ দর্শন করত, সর্বদা কৃষ্ণের বংশীরব শুনতে পেতো। তারা কৃষ্ণের মাধুর্যে সর্বদা বিভাের থাকত। আর গােপীদের এই যে প্রেম-মাধুর্য, তা নিজের সুখের জন্য নয়, কৃষ্ণের সুখের জন্য। তাদের প্রেমে কামের গন্ধমাত্র নেই। তারা সম্পূর্ণভাবে শ্রীকৃষ্ণচরণে নিজেদের সমর্পণ করেছে।
বৈষ্ণব বাবা– গােপীদের পরকীয়া প্রেম সম্বন্ধে কিছু বলুন ?
গুরুজী— দেখুন, পরতত্ত্ব হল সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ। তিনি হলেন পরমাত্মা । আর ঐ পরতত্ত্বে একান্ত ভালবাসা বা পরমাত্মা কৃষ্ণে প্রগাঢ় মতিই হল ‘পরকীয়া প্রেম’। এই গােপীরা সংসারের অনিত্যতা উপলব্ধি করে যা নিত্য শাশ্বত সনাতন সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই ভালবেসেছিল। তাদের সবকিছু ছিল শ্রীকৃষ্ণমুখী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি গােপীদের এই একান্ত মতিই হল পরকীয়া প্রেম। স্বকীয়া ভাবের চেয়ে পরকীয় ভাবের উচ্ছ্বাস অধিকতর । কারণ পরকীয়াতেই প্রেমের আধিক্য, কারণ সে প্রেম দেহাতীত, নিকষিত হেমস্বরূপ। সে শুধু প্রেমের জন্য প্রেম, অহেতুকী প্রেম । লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, বাধা–সমস্ত সমাজ-সংসার অতিক্রম করা বিশুদ্ধ রতি। এই দেহাতীত প্রেম সাধারণের মন-বুদ্ধির অগম্য। তাই এখানে সমালোচনা বেশী । আর বহু প্রয়াসে, বহু বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে শেষে রাসে প্রবেশ। তাই এর স্বাদে অপূর্ব স্নিগ্ধতা, অখণ্ড চমৎকারিতা। স্বকীয়াতে সেই মাধুর্য নেই। এইজন্য পরকীয়া রসেই উৎকর্ষতা বেশী । গুরুমহারাজের ঐ পরকীয়া তত্ত্বের ব্যাখ্যা শুনে আমারও মনে হল–পরকীয়া ভাব একমাত্র ব্রজধামে। এই ভাব বৈকুণ্ঠ, দ্বারকা বা কোথাও নেই। কৃষ্ণের সঙ্গে অপার্থিব প্রেম-সম্পর্ক গােপিনীদের। তাই তারা কৃষ্ণের নিত্যকান্তা। তাদের দেহ, মন, জীবন, তাদের ইহকাল-পরকাল—সর্বস্বই কৃষ্ণার্পণ। শুধু যােগমায়া কৃষ্ণ ইচ্ছায় কৃষ্ণকে উপপতি বানিয়েছে, ছল করে গােপীদের বিবাহকৃত পতিলাভ ঘটিয়েছে। যােগমায়ার দ্বারাই এই ভানের অবতারণা। কৃষ্ণের নিত্যকান্তা হয়েও পরোঢ়ার মত ব্যবহার করা। এতেই রসের পূর্ণতা। আর এই ভাবের পরিপূর্ণতা আনেন মহাভাব স্বরূপিণী শ্রীরাধা ।
আর একটা ব্যাপার—যিনি অধর্ম নাশ করে ধর্ম-সংস্থাপনের জন্য জগতে আবিভূত হয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে কিছুই দোষের নয়, যেমন সর্বভূক অগ্নিতে কোন দোষ স্পর্শ করতে পারে না, ভগবানের ক্ষেত্রেও তদ্রূপ। যিনি গোপীদের, তাদের পতিদের–এমনকি সকল প্রাণীর দেহে-মনে থেকে নিরন্তর রমণ করে চলেছেন, যিনি জগৎস্বামী –তাঁর প্রতি প্রেমই তাে যথার্থ প্রেম । তবে প্ৰকটলীলায় রসাস্বাদনের বৈচিত্র্যের জন্য আত্মারাম পুরুষ নিজের মায়াতেই একটি পরকীয়া-ভান বিস্তার করেন । এই ভানহেতু গোপীরা তাদের পতিকে অস্বীকার করতে পারেনি আর কৃষ্ণে সংগত হবার সময়ও জানতে পারেনি যে, আসলে তারা শ্রীকৃষ্ণেরই স্বরূপকন্তি। এই স্বরূপ সম্বন্ধের জ্ঞানটি যােগমায়ার কৌশলে আবৃত ছিল বলেই পরকীয়া অভিমানে এই উল্লাস-উৎকর্ষ ।
যাইহোক গুরুমহারাজ অাবার বলতে লাগলেন– নটবর শ্রীকৃষ্ণের বা প্রেমিক রসিকরাজের এই প্রেমলীলার পথ ধরে পরবর্তীকালে অবতীর্ণ হয়ছিলেন পরকীয়া প্রেম-সাধনার মহাজনগণ, যেমন– বিল্বমঙ্গল, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস ইত্যাদি। এঁদের প্রত্যেকের জীবনেও দেখা যায় প্রেমের উৎকর্ষতা ও মাধুর্য । এঁরা প্রত্যেকেই নিজের জীবনে যোজনা করে দেখিয়ে গেলেন পরকীয়া প্রেমের স্বরূপ। আর মানুষের কাছে মহাজন হয়ে বেঁচে রইলেন । তবে এঁদের সমস্ত ভাব রাশিকে একত্রিত করে প্রেমের প্লাবন আনলেন গৌরসুন্দর । জীবের চরম চাওয়া-পাওয়ার শেষ দেখালেন গৌরহরি। তাঁর নিজের মধ্যেই রাধা-কৃষ্ণের নিত্যলীলার প্রকাশ দেখা গেল। তাঁর মধ্যে কখনও অন্তঃকৃষ্ণ বহিঃরাধা, কখনও বহিঃকৃষ্ণ আন্তঃরাধা–এই ভাবের প্রকাশ ঘটত । আবার কখনও অখণ্ড মহাভাবসত্তায় তিনি নিমজ্জিত হতেন। এইভাবে অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব তাঁরমধ্যে মূর্ত হয়েছিল।– এতদুর পর্যন্ত বলে গুরুমহারাজ প্রসঙ্গের ইতি টানলেন। আমরা যারা ভক্তিরসপিপাসু, তারা অবাক বিস্ময়ে এক বৈষ্ণব তত্ত্ববেত্তা এবং সাক্ষাৎ তত্ত্বস্বরূপ গুরুমহারাজের অপূর্ব সাক্ষাৎকার এবং কথোপকথনের রস আস্বাদন করেছিলাম। এতক্ষণ যেন কোন অমৃতলোকে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কথা শেষ হতেই আমরা আবার বাস্তব জগতে ফিরে এলাম। ভাবতে লাগলাম–এই জ্বালাময় সংসার, গৃহকর্ম ইত্যাদির মাঝেও গুরুমহারাজ এবং তাঁর সঙ্গলাভ ও অমৃতকন্ঠের অমৃতবাণী শ্রবণ সত্যই দুর্লভ। সত্যই বনগ্রাম ধন্য আর ধন্য এই গৃহ। বৈকুণ্ঠপতির পুণ্য অবস্থানে সত্যই এই গৃহ আজ বৈকুণ্ঠধাম।