মাতরিশ্রীর আশীর্বাদ প্রাপ্তির পর দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন শৈলশিখরে সিদ্ধপীঠ কনকদুর্গা-মায়ের দর্শনের জন্য গিয়েছিলেন । পরে ওনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল—কনকদুর্গামূর্তির বৈশিষ্ট্য কি ? উত্তরে উনি বলেছিলেন, “মহামায়ার অনন্ত ইচ্ছা – মহাপ্রকৃতির কখন যে কি বৈশিষ্ট্য তা একমাত্র শিবই জানেন, জীব কি তা জানতে পারে ? ওইজন্য বাউল গানে রয়েছে–‘শিব জানে না যে সব তত্ত্ব জীবে জানবে কি করে ?’ শিবস্থিতিতে পৌঁছালে তবেই মহাপ্রকৃতির রহস্য উদঘাটন করা যায় । যাইহােক ওখানে মায়ের রূপ অপূর্ব, দেবী অষ্টভূজা, ভীমা ভয়ঙ্করী । অষ্টভুজার অর্থ যিনি অষ্টপাশ মােচন করেন । এখানে বহুকাল ধরে বহু যোগী, ঋষি-মহাত্মারা মায়ের আরাধনার জন্য আসেন। শােনা যায় ভগবান রামচন্দ্রও মাতৃদর্শনের জন্য এখানে এসেছিলেন । ঐ স্থানের খুব মাহাত্ম্য, নিষ্ঠাভরে ধ্যান-জপ করলে মায়ের তত্ত্বময়ীরূপ দর্শন হয়।”
এরপর ওনাকে আবার জিজ্ঞাসা করা হল, ‘তাহলে ওখানে তােমার কি অনুভূতি হল—তা একটু বল ?’ উনি বলতে লাগলেন—“দেবেন্দ্রনাথ সেখানে পৌঁছানাের পরই বলল যে, সে কোন বিশেষ কাজে সেদিনই চলে যাবে। ফলে আমি তাকে বললাম—’দ্যাখো দেবেন্দ্রনাথ, এই স্থানের বাতাবরণ আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করছে, আমি কিছুদিন এখানে থাকবো। দেবেন্দ্রনাথ এতে রাজি হয়ে চলে গেল এবং কয়েকদিন পরে ফিরবে তাও বলে গেল। আমি মনে মনে ভাবলাম হয়তাে মায়ের কোন ইচ্ছা আমার উপর ক্রিয়াশীল তাই স্থানটি আমার এত ভাল লাগছে। যাইহােক মায়ের যা ইচ্ছা তাই হবে ! এরপর আমি ওখানকার মন্দিরের পুরােহিতদের সঙ্গে আলাপ করলাম । ওনাকে আমার অভিলাষ জানাতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন, তবে বললেন দেখুন আপনি মন্দির প্রাঙ্গণে ২/১ রাত্রির বেশী থাকতে পাবেন না, তবে যদি আপনি বেশকিছুদিন এখানে থাকতে চান তাহলে আমি তার ব্যবস্থা করে দিতে পারি । কেননা এখান থেকে কিছুটা দূরে নদীর ধারে নামদেবের আশ্রম রয়েছে, সেখানে আপনি থেকে সাধন-ভজন বা জপ-ধ্যান করতে পারেন। একথা শুনে আমার মনে খুবই আনন্দ হ’ল ।
সব ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ায় সে রাত্রি মন্দিরেই থাকতে পেলাম। দেবীতীর্থে রাত্রিবাস সবসময়ই খুব আনন্দের। গভীর রাত্রে মায়ের তত্ত্বময়ীরূপ দর্শন হল। দেবী দশদিক আলােকিত করে আমার কাছে দিগতত্ত্ব এবং স্থান-মাহাত্ম্যের রহস্য সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন । বললেন, ‘এই স্থানে আমি যুগ যুগ ধরে অবস্থান করছি । যারা শক্তিসাধক তাদের অভীষ্ট পূরণের জন্য এবং তাদের সাধনার সিদ্ধি প্রদানের জন্য আমি এখানে বর্তমান। আমি সকলকে আশীর্বাদ করি যেন তারা এই ত্রিতাপজ্বালা থেকে নিষ্কৃতি পায়।’ মায়ের ঐ অনির্বচনীয় রূপ দর্শনে এবং তাঁর আশীর্বচন শ্রবণে আমার শরীর-মন যেন জুড়িয়ে গেল ।
পরদিন সকালে মাকে প্রণাম করে এবং পূজারীর অনুমতি নিয়ে অদূরে নামদেবের কুঠিয়ার দিকে অগ্রসর হলাম। পাহাড়ি নদীর ধারে ধারে বিচিত্র ফুলের সম্ভার দেখতে দেখতে মনের আনন্দে পথ চলতে লাগলাম । কোথাও চড়াই—কোথাও উতরাই, এইভাবে প্রায় তিনঘণ্টা চলার পর নামদেবের কুঠিয়ায় পৌঁছালাম। ওখানে আগেই খবর দেওয়া ছিল তাই যাওয়ামাত্রই ওখানকার একজন ব্রহ্মচারী আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গেল । প্রাথমিক কুশল বিনিময় ও সাময়িক বিশ্রামের পর আমি ওনাদের নামদেব এবং তাঁর এই আশ্রম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলাম । উনাদের মধ্যে একজন প্রবীণ ব্রহ্মচারী যা বললেন তাতে বােঝা গেল–ওটা নামদেবের সিদ্ধ আশ্রম । ওখান থেকেই নামদেব ভক্তিভাব প্রচার শুরু করে সমগ্র দক্ষিণ ভারতকে উজ্জীবিত করেছিলেন। ব্রহ্মচারীজী নামদেবের জীবনের নানা ঘটনাও বলেছিলেন, তাতে জানা গেল যে, নামদেবের দাদুর নাম ছিল বামদেব । তিনি কৃষ্ণভক্ত ছিলেন । প্রত্যহ নিজের হাতে ভগবান কৃষ্ণের পুজার্চনা এবং ভোগ-রাগ করতেন । নামদেবের মা ছিলেন বাল্যবিধবা । ফলে বাবা ও মেয়ের সারাদিন কাটত ভগবান কৃষ্ণের পুজার্চনায়। মেয়েটি ভক্তিভরে ঠাকুরকে ফুল-মালা দিয়ে সাজাতেন, গুন গুন করে গান গাইতেন অার চরম ব্যাকুলতা নিয়ে ভগবানের চরণে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা নিবেদন করতেন। তাঁর আকুল আহ্বানে একদিন ঐ বিগ্রহমূর্ত্তি থেকে ভগবান প্রকট হয়ে তাকে ‘বর’ প্রার্থনা করতে বললেন। মেয়েটি ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে ‘বর’ প্রার্থনা করলেন–যেন তাঁর একটি সুসন্তান হয় । ভগবান ‘তথাস্তু’ বলে অন্তর্ধান হলেন ।
কিন্তু এরপরই মেয়েটির সম্বিৎ ফিরে এল–একি বর যাচঞা করলেন তিনি! বিধবার সন্তান কি সমাজ মেনে নেবে ? আবার আকুল হয়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন বাবা ও মেয়ে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অাবার প্রকট হয়ে ওঁদেরকে বলেন যে, তােমার ছেলে পরমযােগী হবে। জগতের কাজ করার জন্য মানবকল্যাণার্থে ওকে পাঠানো হচ্ছে, এতে তােমাদের কোন ক্ষতি হবে না—বরং মঙ্গলই হবে। ভগবানের আশ্বাসবাণী পেয়ে তাঁরা নিশ্চিন্ত হলেন। এরপর কালক্রমে পুত্রসন্তান জন্মাল, নাম রাখা হ’ল নামদেব। ছোটবেলা থেকেই নামদেব অত্যন্ত মেধাবী ছিল এবং ছিল ভক্তিপরায়ণ। বাল্যকাল থেকেই ছেলেটি ছিল অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ এবং দাদুর কাজকর্মে একান্ত সহযােগী। দাদু বৃদ্ধ হয়েছেন ফলে নিত্যসেবার অনেক কাজই তিনি আর সবদিন করে উঠতে পারেন না, ফলে বালক নামদেব নিষ্ঠার সঙ্গে সে সব কাজ করে দেয়। এসব দেখে দাদুও পরম নিশ্চিন্ত বােধ করেন এবং ভগবানের করুণার কথা ভেবে আনন্দে চোখের জল ফেলেন। একদিন কোন এক কর্মোপলক্ষে দাদুকে তিনদিনের জন্য বাহিরে যেতে হ’ল । দাদু পরম নিশ্চিন্তে পূজার্চনার ভার বালকের হাতে দিয়ে কার্যক্ষেত্রে চলে গেলেন ।
এই কাজের ভার পেয়ে বেজায় খুশি নামদেব। সকাল থেকেই তার আর উৎসাহ ধরে না। অতি প্রত্যুষে স্নান সেরে পূজার ঘর ধােয়া-মােছা থেকে অারম্ভ করে ফুল তোলা, মালা গাঁথা সমস্ত কাজ একাই সেরে ফেলল। তারপর পূজার আসনে বসে একান্ত ভক্তি ভরে ভগবানকে আপনজন জ্ঞানে পরম নিষ্ঠায় পূজা করতে লাগল । তার মনে হতে লাগল যেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ তার সামনে বসে বসে পূজা গ্রহণ করছেন। এরপর ভোগ নিবেদনের পালা। ভক্তিমতী মা অন্যান্য দিনের ন্যায় সেদিনও ভোগ রেঁধেছেন এবং বাটিতে সাজিয়ে ঢাকা দিয়ে রেখেছেন। বালক নামদেব ভােগের ঢাকা খুলে আকুল হয়ে ঠাকুরকে প্রার্থনা করতে লাগলেন, “হে ঠাকুর তুমি তাড়াতাড়ি ভােগটা খেয়ে নাও, নাহলে মা রাগ করবে।” কিন্তু পাথরের ঠাকুর ভােগ যে খায় না সরলমতি বালক তা জানে না । সে দেরি হচ্ছে দেখে ঠাকুরকে বলতে লাগল,-“ও ঠাকুর তুমি রােজ রােজ দাদুর দেওয়া ভােগ খাও, তাহলে আজ আমার হাতে খাবে না কেন? আমার ক্ষিদে পেয়েছে—তুমি না খেলে আমিই বা উঠি কি করে–তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও!” সরলমতি বালকের একান্ত আকুল আহ্বানে ঠাকুরের আসন টলে গেল। তিনি আর স্থির থাকতে না পেরে বালকের বেশে প্রকট হলেন এবং আকুল ক্রন্দনরত বালক নামদেবকে বললেন– “আর কঁদিস না, এই তো আমি খাচ্ছি।” এই বলে ভগবান চেটে-পুটে সমস্ত ভােগ খেয়ে নিলেন। ভােগ নিবেদন শেষে ঠাকুর আবার অন্তর্হিত হলেন। ঠাকুরঘর থেকে ছেলের চেঁচামেচি শুনে মা ছুটে এলেন, বললেন–‘কিরে নামদেব হয়েছেটা কি ?’ নামদেব বললেন,“দ্যাখােনা মা, কেষ্টঠাকুরটা কি রকম দুষ্টু, রোজ রােজ দাদুর দেওয়া ভােগটা চট্ করে খেয়ে যায় আর আজকে আমি ভােগ দিয়েছি, ভাল মন্ত্র জানিনা বলে অনেক দেরি করে এল, তবে দ্যাখাে সব ভােগটা খেয়ে নিয়েছে।” মা তো ভােগের পাত্র খালি দেখে একেবারে অবাক ! চোখের জলে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে দুইজনে সেই ভােগের বাটির অবশিষ্টটুকু প্রসাদ হিসাবে মুখে দিয়ে দেখলেন কি অপূর্ব তার আস্বাদ ! এইভাবে পরপর তিনদিন একই ঘটনা ঘটতে থাকল।