জিজ্ঞাসু:–আচ্ছা গুরু মহারাজ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে তো ভগবান বলা হয় ! দক্ষিণেশ্বরে আসার পর মথুরবাবু, রানী রাসমণি, নরেন্দ্রনাথ সহ অন্যান্য ভক্তরা না হয় ঠাকুরকে অনেকটাই চিনতে পেরেছিল ! কিন্তু ছোটবেলায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে যেমন ভগবানত্বের প্রকাশ পেয়েছিল, ঠাকুরের মধ্যে তেমন কিছু প্রকাশ পেয়েছিল কি ?
(এই জিজ্ঞাসার আজ পরবর্ত্তী অংশ….)]
……… ঠাকুরের খুব শিশু অবস্থায় মা চন্দ্রমনি দেবী অনেককিছুই দর্শন করেছিলেন । তবে গর্ভধারিণী জননীর কাছেবাৎসল্য-রসই প্রাধান্য পায়, সেখানে দর্শনাদি অতোটা পাত্তা পায় না ! তাছাড়া বালক অবস্থায় গদাধর দু-এক জনকে কৃপা করে চেনা দিয়েছিলেন । একদিন বন্ধুদের সঙ্গে উনি কামারপুকুরের হালদারপুকুরে স্নান করছিলেন ! তখন তাঁর আর কতো বয়স হবে এই ধরে নাও 7/8 বছর বয়স ! চিনু শাঁখারী বা ভক্ত চিনিবাসও তখন স্নান করবে বলে_ ঐ পুকুরেই গেছিলো । পুকুর-ঘাটে তখন বালকের দল স্নান করছে মানেই হোলো তারা জলে একেবারে দাপাদাপি করছে ! এইটা দেখে চিনিবাস পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের স্নান শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিল ! ওর দৃষ্টি ছিল বালক গদাই-এর দিকে ! কারণ ছোটো থেকেই ওর সাথে গদাইয়ের একটা সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ! হটাৎ ওর মনে হোলো, “বালকৃষ্ণ” যেন ওর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে, আর জলক্রীড়া করছে ! ভক্ত চিনিবাস বাল-গোপালের একনিষ্ঠ সেবক ছিল ! জলের মধ্যে ওর ঈষ্ট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে ভেবে ও জলে নেমে পড়ে বালককে ধরে ফেলতেই দেখে_ ও মা! এতো গদাই ! ওর চোখের সামনে থেকে বাল-কৃষ্ণরূপ তখন অন্তর্হিত ! ভক্ত চিনিবাসই বা ছাড়বে কেন ? ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ও ভালো করে গদাইকেই চেপে ধরলো, বললো “বলো তুমি কে ? নিশ্চয়ই তুমি আমার ঈষ্ট ! কারণ তোমার মধ্যে এইমাত্র আমি তাঁকে চাক্ষুষ করলাম !” জলের মধ্যে তখন চলছে, ভক্ত-ভগবানের লীলা ! বাকি উপস্থিতজনেরা নিজেদের জল-খেলাতেই মত্ত ছিল ! তারা কেউ কিছুই জানতে পারলো না ! অথচ ভক্তের আকুল ক্রন্দনে ও ব্যাকুল প্রার্থনায় সেই দিন সেই অবস্থাতেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন বালক গদাধর ! তবে তিনি চিনুকে প্রতিশ্রুতি করে নিয়েছিলেন যে, সে যা দেখেছে, তা যেন বাইরে কারো কাছে কিছু প্রকাশ না করে ! এরপর থেকে গদাধর যতদিন কামারপুকুরে ছিলেন, ভক্ত চিনিবাস ঠাকুরকে বালকৃষ্ণ জ্ঞানেই পূজা কোরতো, ভক্তি কোরতো ! ঠাকুরও ঐ বৃদ্ধের কাছে গিয়ে “এটা খাবো- ওটা খাবো”_ বলে খুবই জ্বালাতন করতেন ! ভক্ত চিনিবাসও শতকষ্টের মধ্যেও, তাঁর ইষ্টের এই লীলার মজা নিতেন। এছাড়াও ওই গ্রামে বসবাসকারী ধনি কামারনী নামে একজন গ্রাম্য মহিলাও ঠাকুরকে ছোটবেলাতে তার ইষ্টরূপে দর্শন করেছিল। যাইহোক, এইভাবেই কিছু কিছু লোক চিনতে পারে বৈকি ! যার ওপর ঈশ্বরের কৃপা হয়, সেই চিনতে পারে ! ঈশ্বরের কৃপা কারো উপর বর্ষিত হোলে কি না হয়, সবই তো হোতে পারে ! তবে “কৃপা” মানে কি বলো তো_ ‘করে পাওয়া’ ! তাই ‘উপযুক্ত’ হয়ে ওঠার নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে ! সেই জন্যই বললাম_ সবাই না পারলেও কেউ কেউ পারে ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তর্ধানের অনেক পরে কোনো এক রামকৃষ্ণ-ভক্ত ঘুরতে ঘুরতে তিরুভান্নামালাই পাহাড়ে রমণ মহর্ষির সাথে সাক্ষাৎ করেন । কথায় কথায় শ্রীরামকৃষ্ণের কথা উত্থাপন হয় ! সেই ভক্তের কাছে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের একটি ফটোকপি ছিল, সেটা তিনি রমণ মহর্ষিকে দেখাতেই উনি একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ সেই ফটোটির দিকে চেয়ে বলেছিলেন–“এই ফটোকপিটি যাঁর, তিনি এমন একজন মহাপুরুষ_ যাঁর ছবি ঘরে রাখলে যে কোনো ধর্মমতের বা যে কোনো পথের মানুষের কল্যাণ হবে”!
আরও একটা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের ঘটনার কথা উল্লেখ করছি শোনো যেটা কালনায় ঘটেছিল ! তৎকালীন যুগে বৈষ্ণব বাবাজিদের মধ্যে ভগবানদাস বাবাজী ছিলেন সিদ্ধপুরুষ ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবস্থ অবস্থায় কলকাতার পানিহাটিতে কোনো এক উৎসবে মহাপ্রভুর জন্য রাখা নির্দিষ্ট আসনের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন ! এই ঘটনা ছাড়াও তখন “শ্রীরামকৃষ্ণই ভগবান”, উনি “রাম এবং কৃষ্ণের অবতার” এই ধরনের প্রচারও ছিল (যেহেতু মথুরবাবু পন্ডিতদের সভা ডেকে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন)! এই কথাগুলো বাংলার সমগ্র বৈষ্ণবসমাজ সহ ভগবান দাসজীর কানেও পৌঁছে ছিল । প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন বৈষ্ণবসমাজের নেতারা__ সিদ্ধপুরুষ বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ ভগবান দাস বাবাজির কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের নামে নানা রকম complaint করেছিল ! কারণ তখন পূর্ব ভারতের(পূর্বাঞ্চলের) বৈষ্ণব সমাজের শিরোমনি করা হয়েছিল কালনার ভগবানদাস বাবাজিকে ! তাই তাঁর ক্ষমতা ছিল অন্যান্য বৈষ্ণব-অপরাধে অভিযুক্তদের উপর কর্তৃত্ব করার !
সেইজন্য তৎকালীন বৈষ্ণবসমাজ, ওনার কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের বিরুদ্ধে এই complaint করেছিলো যে, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আসনে দাঁড়ানোর অপরাধে যেন তার শাস্তি-বিধান করা হয় ! ….. (ক্রমশঃ)