জিজ্ঞাসু:–ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে যে সমস্ত বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, সেগুলির বয়স বিচার করে এটা বোঝা যায় যে, এদেশের কোনো হিন্দু মন্দির‌ই অতোটা প্রাচীন নয় ! এমনটা হওয়ার কারণ কি_ গুরুজী ? গুরু মহারাজ:— এই তথ্য তুমি কিভাবে জোগাড় করলে ? এটা কিন্তু যথার্থ তথ্য জানো তো ? আর্য সংস্কৃতিতে অর্থাৎ ভারতবর্ষের তথাকথিত হিন্দু ধর্মমতে ‘মন্দির তৈরি’-র ব্যাপারটা মোটেই ছিল না ! এই পরম্পরাটা এসেছে বৌদ্ধদের পর থেকে_ এটা একেবারেই সঠিক তথ্য ! বৌদ্ধরা যখন থেকে বিহার বা বৌদ্ধস্তুপ বানানো শুরু করলো, তারপর থেকেই তথাকথিত হিন্দুদের মধ্যে মন্দির বানানোর ধুম পড়ে গিয়েছিলো ! বৈদিক যুগে অর্থাৎ আর্যসংস্কৃতিতে সনাতনপন্থীদের বা তথাকথিত হিন্দুদের ছিল যজ্ঞবেদী। আকাশ-বাতাস, জীবজগৎ সকলের মঙ্গলের জন্য সাম-গান করা হোতো, আর সকলের মঙ্গল ও শান্তির জন্য করা হোতো যাগ-যজ্ঞ, হবন বা হোম ! তাছাড়া প্রাচীনকালে শাক্তদের সাধনার জন্য ছিল তন্ত্রপীঠ ! এখন হয়তো, সেইসব স্থানে বিশাল বিশাল মন্দির হয়েছে, কিন্তু আগে সেইসব স্থানে কোনো মন্দির ছিল না, শুধু পীঠ ছিল– সিদ্ধ আসন ছিল ! সেইসব স্থানে পরম্পরাগতভাবে বিভিন্ন তন্ত্রের সাধন হোতো, তাছাড়া সেই সব স্থানে তন্ত্রের দুস্প্রাপ্য হাতে লেখা পুঁথি এবং যন্ত্র (তন্ত্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয়) সুন্দরভাবে সংরক্ষিত রাখা হোতো ! তবে জানো, বৌদ্ধরাও বিহার নির্মাণ করেছে বুদ্ধের মহাপ্রয়াণের অনেকটাই পরে ! বুদ্ধ যতদিন শরীরে ছিলেন ততদিন কোনো ‘বিহার’ সেভাবে নির্মিত হয়নি ! ভগবান বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় যখন যেখানে অবস্থান করতেন সেই স্থানকেই ‘বিহার’ বলা হোতো ! যেমন ‘জেতবন বিহার’, ‘বাঁশবন বিহার’ ইত্যাদি ! বৌদ্ধগ্রন্থগুলিতে এইসব ‘বিহারে’র উল্লেখ আছে । এই নামগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, ভগবান বুদ্ধ কোনো রাজা বা জমিদারের প্রাসাদে কখনোই থাকতে চাইতেন না ! আর চাইবেনই বা কেন_ তিনি তো রাজ্য, রাজকুমার‌ত্ব ইত্যাদি ত্যাগ করে ত্যাগব্রত অবলম্বন করেছিলেন ! রাজপ্রাসাদ ছেড়ে একবার যখন তিনি প্রকৃতির কোলে এসে আশ্রয় নিয়েছেন_ তখন আবার তাঁর প্রাসাদের প্রলোভন থাকবেই বা কেন ? এইজন্যই তিনি পরিভ্রমণকালে তাঁর সাথে থাকা সাঙ্গোপাঙ্গ এবং ভক্তদেরকে নিয়ে নগরের প্রান্তে কোনো না কোনো বনাঞ্চলে গাছতলায় রাত্রি কাটাতেন ! এখানে ‘বনাঞ্চল’ কথাটি বলা হোলো–জঙ্গল বা অরন্য বলা হোলো না । কারণ, বন এবং অরণ্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে ! ‘অরণ্য’ হোচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট জঙ্গল, যেখানে বহুকাল ধরে গাছগাছালি আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়ে রয়েছে ! আর ‘বন’ হোলো man-made_যা plan করে লাগানো হয়েছে ! এইজন্যেই দেখবে এখনো বলা হয় তালবন, বাঁশবন, শালবন ইত্যাদি ! বোঝাই যাচ্ছে যে, এগুলো কেউ না কেউ লাগিয়েছেফলে এক একস্থানে এক একধরনের বনাঞ্চল সৃষ্টি করেছে ! সেই অর্থে শাশ্ত্রোক্ত মুনি-তপোবন‌গুলিও ছিল ও man-made_আর সেইজন্যই তো নামকরণ করা হয়েছে’তপোবন’ !
যাই হোক, আমরা মূল আলোচনায় ফিরে আসি ! ভগবান বুদ্ধ তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়েই পরিব্রাজন করেই কাটিয়েছিলেন অর্থাৎ একস্থান থেকে অন্যস্থানে হেঁটে হেঁটে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে তিনি ধর্মশিক্ষা এবং ধর্মপ্রচারের কাজ করতেন । রাজা-রাজড়া বা ধনী শ্রেষ্ঠীরা সহ সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের সাথে তিনি এই ভাবেই যোগাযোগ স্থাপন করতেন ! এই পরিব্রাজনকালে উনি রাত্রিটা কাটাতেন কোনো না কোনো বৃক্ষতলে অথবা এই ধরনের বনাঞ্চলে । কিন্তু এইভাবে থাকার ক্ষেত্রে_ প্রচন্ড অসুবিধা দেখা দিতো বর্ষাকালে ! কারণ বর্ষার সময় সারারাত ধরে বৃষ্টি হয়ে থাকে, ফলে ঐ বৃষ্টির মধ্যে ফাঁকা জায়গায় অথবা গাছতলায় বিশ্রাম নেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই অসুবিধা হোতো ! ভগবান বুদ্ধের হয়তো নিজের কোনো অসুবিধা হোতো না, কিন্তু তাঁর শিষ্য-ভক্তদের এতে চরম অসুবিধা হোতো ! এই অসুবিধা দূর করার জন্য ভগবান বুদ্ধ “চাতুর্মাস্য” প্রথা চালু করেছিলেন । ‘চাতুর্মাস্য’ অর্থাৎ বর্ষার চারটে মাস কোনো না কোনো শ্রেষ্ঠী, জমিদার বা রাজার কোনো খামারবাড়ি, বাগানবাড়ি এইরকম কোনো নির্জনস্থানে সকলে মিলে কাটিয়ে দিতেন ! স্থায়ী বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের প্রয়োজন কেন হয়েছিল এবার তার কারণটা বলছি শোনো ! বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই তৎকালীন ভারতের উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব অংশের প্রায় সমস্ত অংশেই তাঁর প্রভাব ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল ! বুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আরো বেশি বেশি মানুষ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হোতে শুরু করেছিল । আর এর প্রধান কারণ ছিল_ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ধর্মচর্চায় অধিকার প্রদান ! বৈদিক ব্রাহ্মণ্যপ্রথায় ছিল নানান বিধি নিষেধ ! বিশেষত শুদ্র ও নারীদের বেদপাঠ করা, পূজা-পাঠ করা, ধর্ম চর্চা করা ইত্যাদির কোনো অধিকারই দেওয়া হয়নি । এমনকি দেবস্থানে(তখনকার যজ্ঞস্থানে) প্রবেশ করতেই দেওয়া হোতো না। ভগবান বুদ্ধ এসে সকলকে এই অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই অধিকার পাওয়ার ফলে, সমাজের একটা বৃহৎ শ্রেণী তখন বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ।
আরো পরবর্তীতে অর্থাৎ সম্রাট অশোকের সময় থেকে বৌদ্ধধর্ম‌ই হয়ে গিয়েছিল ‘রাজধর্ম’ ! ফলে, আলাদাভাবে কারোর বৌদ্ধ হবার প্রয়োজন ছিল না, সেই সময় রাজ্যের প্রায় সকল মানুষই ‘বৌদ্ধ’ হয়ে গিয়েছিল ! ………. (ক্রমশঃ)