শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের কথা (লিখিত ও কথিত) এখানে আলোচনা করা হচ্ছিলো৷ গুরুমহারাজের (স্বহস্ত লিখিত) দুটি গ্রন্থ, বেশ কিছু নিবন্ধ এবং অনেক কবিতা নিজের হাতে লিখেছিলেন। গ্রন্থ দুটি যথাক্রমে সহজতা ও প্রেম এবং বাউলের মর্মকথা নামে উনি শরীরে থাকতেই বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনের চরৈবেতি কার্যালয় থেকে ছাপা হয়েছিল এবং এই বইগুলির ইংরাজি এবং একটির হিন্দি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। আর ওনার স্বহস্ত রচিত নিবন্ধগুলির মধ্যে বৈষ্ণবের ভক্তিভাব ও প্রেম বিষয়ক একত্র লেখাগুলিকে একত্র করে বাউল কথা– প্রথম খন্ড_ এবং ওনার নিজের লেখা Manuscript থেকে জ্ঞান ও তন্ত্র বিষয়ক লেখাগুলিকে এক জায়গায় করে বাউল কথা- দ্বিতীয় খন্ডবই দুটি প্রকাশ করা হয়েছিল।
আরো পরবর্তীতে চরৈবেতি কার্যালয় থেকে গুরুমহারাজের ছোটো ছোটো নিবন্ধগুলি (বেশিরভাগই চরৈবেতি পত্রিকায় প্রকাশিত) -কে একত্র করে বাউল কথা- তৃতীয় খন্ড_ প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও গুরুমহারাজ বিভিন্ন স্থানে যে সমস্ত সিটিং করতেন, সেগুলির অডিও এবং ভিডিও ক্যাসেট থেকে শুনে শুনে লিপিতে এনে পরমানন্দ কথামৃত- প্রথম খন্ড_ এবং পরমানন্দ কথামৃত- দ্বিতীয় খন্ড_ – পরমানন্দ মিশন ‘চরৈবেতি কার্যালয়’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সেই অর্থে উপরিউক্ত গ্রন্থগুলির বিষয়বস্তু গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের সরাসরি নিজের – সমগ্র মানবজাতির প্রতি এগুলি একান্তভাবে ভগবানের নিজস্ব অনুগ্রহ (অবশ্য এগুলির মধ্যে দু-একটি শব্দব‌ই প্রকাশনার সময় একটু-আধটু এদিক ওদিক হোতেই পারে। পরবর্তীকালে ঐ গ্রন্থগুলিকে আরো ভালো – আরো ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে নতুন কথার সংযোজন বা পুরোনো কথার পরিবর্তন ঘটতে পারে৷)। সেই অর্থে উপরোক্ত গ্রন্থগুলিকে বলা যেতে পারে – first hand ! এরপরে স্বামী পরমানন্দের ভক্তগণ যে সমস্ত গ্রন্থ লিখেছেন, সেগুলি হয় – second hand বা third hand ! আমাদের এখানে এই যে প্রচেষ্টা – সেটা শুধুমাত্র ঐ জন্যই অর্থাৎ গুরুমহারাজের স্বহস্ত লিখিত কথাগুলিকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার নিমিত্ত ! আর ওনার স্বহস্ত লিখিত লেখাগুলি তুলে ধরার পরে যে পুনরায় repeat করা হোচ্ছে সেটি শুধুমাত্র কথাগুলিকে ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করার জন্যই। যাইহোক, আমরা এখন আবার ফিরে যাই গুরুমহারাজের কথায় অর্থাৎ বাউলের মর্মকথা গ্রন্থের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের বাউল সাধনা বিষয়ক কথায় ! দেখি গুরুমহারাজ তারপরে আরো কি কি বলেছেন !
এরপরে উনি বলেছেন – ” সাধারণতঃ সকল বাউলকেই (অনুমান বা বর্তমান মতের সাধকেরা) প্রকৃতি-আশ্রয় করতে হয়। যাঁরা প্রকৃতি(হয় অন্তঃপ্রকৃতি, নাহয় বাইরের প্রকৃতি বা নারী) গ্রহণ করেন না, তাঁরা এককভাবে আপনাতে প্রকৃতিভাব আরোপ করে মধুরভাবে ও রাধাভাবে আরাধনা করেন। এঁরা উদাস বাউল বা শুদ্ধ বাউল নামে পরিচিত হোলেও এঁরা ‘বর্তমান’ সাধক। কিন্তু প্রকৃতি-আশ্রয় না করে স্বপ্রকৃতিতে প্রকৃতিভাব আরোপ করেন বলেই এঁরা বাহ্য-প্রকৃতি বর্জিত বিশুদ্ধ উদাস বাউল।৷
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামী অনেক বিশুদ্ধ উদাস বাউল বাংলায় আজও দেখা যায়। এঁরা প্রকৃতি-আশ্রিত বর্তমান ভজনায় রুচি রাখেন না, প্রকৃতি-বর্জিত বর্তমান ভজনায় রুচিশীল। এঁরা প্রকৃতি ভজনের দুরূহতায়, স্থূলক্রিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণাবশতঃ এবং ব্যভিচারের আশঙ্কায় প্রকৃতি (নারীসঙ্গ) পরিত্যাগ করেন।
উদাস বাউলগণ আনুষ্ঠানিক লোকাচারমুক্ত সহজ অনুভূতিজাত ঈশ্বরপ্রেমে মত্ত। মানবহৃদয়ের সহজাত প্রেম-ই হোলো ভগবৎ প্রেম এবং এটাই মানবধর্ম।৷”
প্রিয় পাঠকবৃন্দ ! গুরুমহারাজ এখানে এখন ‘বর্তমান’ সাধকগণের কথাই বলছেন। আমরা আগে দেখেছি যে, ‘বর্তমান’ মতের সাধনকারীরা নারী নিয়ে সাধন করেন, কিন্তু এখন গুরুমহারাজ বর্তমান মতের সাধকদের মধ্যেই আর একটি বিভাগের কথা উল্লেখ করলেন, যাঁরা বাহ্য-প্রকৃতি আশ্রয় করেন না – তাঁর অন্তঃপ্রকৃতিতে থাকা নারী(প্রতিটি পুরুষের মধ্যেই নারী এবং প্রতিটি নারীর মধ্যে পুরুষ রয়েছে)-র উন্মেষ ঘটান এবং আপনাতে প্রকৃতিভাব আরোপ করে মধুরভাবে বা রাধাভাবে সাধন করেন। এঁরাই হোলেন বিশুদ্ধ উদাস বাউল।
তাহলে আমরা দেখলাম__ অনুমান ভজনকারীরাও নারী বা প্রকৃতি-বর্জিত সাধন করেন এবং বর্তমান মতের মধ্যেও যাঁরা শুদ্ধ বাউল বা উদাস বাউল – তাঁরাও বাহ্য-প্রকৃতি বর্জিত সাধন করেন অর্থাৎ এঁরা ভিন্ন ভিন্ন মতের সাধক হওয়া সত্ত্বেও একটা জায়গায় এঁদের মিল রয়েছে, কারণ এঁরা কোনো বাহ্য সাধন-সঙ্গিনী গ্রহণ করেন না। তাহলে এঁদের মধ্যে ভেদ করা হয়েছে কেন – এই জিজ্ঞাসা আমার মতো আপনাদের মনেও নিশ্চয়ই উদয় হচ্ছে ! আশা করি, গুরুমহারাজ পরবর্তীতে এর উত্তর দিয়েছেন। তাই আমরা এখন ঐ বর্তমান মতের বিশুদ্ধ উদাস বাউলদের কথাতেই ফিরে যাই।
গুরুমহারাজ বললেন যে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামীদের মধ্যে এখনো অনেক বর্তমান মতের বাউল সাধক প্রকৃতি বর্জিত হয়ে সপ্রকৃতিতে নারীভাব আরোপ করে সাধন করেন। এর কারণ হিসাবে গুরুমহারাজ বলেছেন – এঁরা নারী নিয়ে সাধনের যে অসম্ভব দুরূহতা, সেটাকে এড়িয়ে চলেন। তাছাড়া নারী নিয়ে সাধনায় – প্রথম দিকে পতনের ভয় থাকে, ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই তাঁরা প্রকৃতি-সঙ্গ (নারীসঙ্গ) এড়িয়ে চলেন। এঁরা আনুষ্ঠানিক লোকাচার পালন করেন না, কিন্তু অন্তঃর্জগতের অনুভূতিজাত ঈশ্বরপ্রেমে সদাই মত্ত থাকেন। বাউল মতে মানব-হৃদয়ের সহজাত প্রেম-ই হোলো ভগবৎ প্রেম এবং সকল মানবের ধর্ম-ই হোলো এই ভগবৎ প্রেমলাভ।৷