উপস্থিত ব্যক্তিগণ:–জয়দীপ, লেখক (কোলকাতার) দেববাবু, ন”কাকা, মেজো কাকা (রমাপ্রসাদ বাবু), তপি মা, রেবা মা, রীতা দি(সিঙ্গুর) প্রমুখেরা।
জিজ্ঞাসু(গুরু মহারাজের পিছনে বসে থাকা মেয়েদের মধ্যে থেকে একজন):—আগামীকাল পয়লা জানুয়ারি ! এই দিনে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ কল্পতরু হয়েছিলেন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে ! আমরাও তাই আগামীকালের প্রতীক্ষায় রয়েছি, কি ঘটে তা দেখার জন্য ?
[ গুরু মহারাজ এই জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন। আজ তার পরবর্ত্তী অংশ]
……. সে যাই হোক, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কল্পতরুর দিন সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারীদের কেউই ওখানে উপস্থিত ছিল না ! কিন্তু বল্ তো_তাই বলে ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানেরা কি ঠাকুরের কৃপা কিছু কম পেয়েছিলেন ? ঠাকুর যেদিন কল্পতরু হয়েছিলেন, সেদিন উপস্থিত ব্যক্তিদেরকে__ ঠাকুর নিজে থেকেই “তোদের চৈতন্য হোক”-এই বলে আশীর্বাদ করেছিলেন ! এটাই তো মানব-জীবনের সবচাইতে বড় পাওয়া ! কিন্তু ঠাকুরের মৃত্যুর পরে এই মানুষগুলোই অর্থাৎ ঠাকুরের বেশিরভাগ গৃহীভক্তেরা ঠাকুরের মৃতদেহ সৎকারের পর অস্থিভস্ম অর্থাৎ খানিকটা ছাই নিয়ে সন্ন্যাসী ভক্তদের সাথে চরম গণ্ডগোল বাধিয়ে দিয়েছিল ! শ্রী শ্রী মা সারদাদেবীর কাছে ঝগড়াঝাঁটির খবর যখন এসে পৌঁছালো, তখন তিনি ঠাকুরের ত্যাগী ভক্তদেরকে ডেকে বললেন_” এমন সোনার মানুষটাই চলে গেল, আর তোরা ছাই নিয়ে ঝগড়া করবি ?” ব্রহ্মচারীরা মায়ের কথা মেনে নিয়ে চুপ করে গেছিলো ।
তাহলে বলোতো, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কল্পতরু হয়ে কৃপা করার পরেও ঐ শিষ্যগুলির কি এমন বেশি আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়েছিলো ? তারা কি সবাই ব্রহ্মিষ্ট হয়ে গেছিলো নাকি ? দ্যাখো বাবা, ওইসবে বিশেষ কিছু হয় না ! “যার হেথায় আছে, তার সেথায় আছে ! যার হেথায় নাই, তার কোথাও নাই!” জীব স্বরূপতঃ ব্রহ্ম, কিন্তু সে নিজেকে ‘জীব’ ভেবে বসে আছে বলেই তো সে জীবরূপে প্রতীয়মান হোচ্ছে । তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, সবকিছুর জন্য দায়ী হোলো জীবের “ভাবনা” ! মানুষ যদি নিজেকে পরিবর্তন করতে চায়, তাহলে তাকে প্রথমে তার ‘ভাবনা’-র পরিবর্তন করতে হবে, তাহলেই ধীরে ধীরে সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে যাবে । এমনকি মানুষ তার অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছাতেও সমর্থ হবে ! শ্রীমদ্ভগবদগীতায় রয়েছে_ “যাদৃশি যস্য ভাবনা সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশি” ! মানুষ যদি একদমই ‘ভাবনা মুক্ত’ হোতে পারে, তাহলে সে ‘যে কে সেই’ হয়ে উঠতে পারে অর্থাৎ তার ‘আত্ম সাক্ষাৎকার’ হয়ে যেতে পারে ! ‘আত্ম সাক্ষাৎকার’– হওয়া মানে সাধকের জীবনে নতুন কিছু যোগ হওয়া নয়, সে ‘যা’– ‘তা’-ই হয়ে ওঠা !
এই যে কথাগুলো বললাম এটা জানাই প্রকৃত ‘জ্ঞান’ !
তোমাদের ‘ভাবনা’-য় দৃঢ়তা নাই, তাই সংশয় জাগে ! তুমি যদি কাউকে ‘ভগবান’ বলে দৃঢ়ভাবে ভেবেই থাকো, তাহলে আবার জপ-ধ্যান করো কেন ? অন্যান্য কোনোরূপ কর্মের তো তোমার আর কোনো প্রয়োজন নাই_ কারণ ভগবান লাভ তো তোমার হয়েই গেছে ! কিন্তু সর্ব অবস্খাতেই এইটা ভাবতে পারো কি ? এই বিশ্বাসের দৃঢ়তা ক’জনের আছে ?
সেইটা অনেকটাই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্ত গিরিশ ঘোষের ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সম্বন্ধে তার ছিল ‘পাঁচসিকে পাঁচআনা’ বিশ্বাস ! সেই অর্থে দেখতে গেলে, প্রথম জীবন থেকে গিরিশের বিশেষ সাধন-ভজন ছিল না ! শুধুমাত্র বিশ্বাসের জোরেই গিরিশের ভগবত-কৃপালাভ হয়েছিল । স্বামী বিবেকানন্দও এই ব্যাপারটা জানতেন __ তাই তিনি একবার গিরিশকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন_” জি.সি. বেদান্ত-টেদান্ত মানে না কিন্তু ও এসবের ঊর্ধ্বে রয়েছে !” সাধারণ মানুষের বিশ্বাস পাকা বা দৃঢ় হয়না বলেই মনে সংশয় উৎপন্ন হয় ! শুধু সাধারণ মানুষেরই নয়, বড় বড় যোগী-সাধক-আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের মধ্যেও সংশয় কাজ করে এবং এইজন্য তারাও চেতনার একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত গিয়ে আটকে পড়ে ! কোনো উচ্চ আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন গুরুর সান্নিধ্য ছাড়া ওই সংশয় কাটতে চায় না ! উপযুক্ত গুরু, ঐরকম অবস্থায় আটকে থাকা সাধকের চেতনায় মারেন চাবুক ! আচমকা দু-এক ঘা চাবুক লাগাতেই ঘোড়া বা গাধা যেমন অতর্কিতে ছুটতে শুরু করে দেয় ! অকস্মাৎ আঘাতে যেমন কোনো বস্তুতে ধুলো-ময়লা ঝরে পড়ে যায়, লোহার জং ঝরে যায়__ তেমনি ওইসব সাধকের চেতনায় গুরু-প্রদত্ত ঘা লাগলে, আবার তার অগ্রগতি শুরু হয়ে যায় ! আর সদগুরুর কৃপায় সাধক একবার অসংশয়(নিঃসংশয়েরও ঊর্দ্ধে) হয়ে গেলে আর তার কোনো বাধা থাকে না ! একেবারে তরতর করে অগ্রগতি হয়__ যতক্ষণ পর্যন্ত না তার চূড়ান্ত লক্ষ্য প্রাপ্তি ঘটে ! …… (ক্রমশঃ)
স্থান:–বনগ্রাম মুখার্জি বাড়ি। সময় _ ৩১-শে ডিসেম্বর,১৯৯১।