গুরুমহারাজ, তপিমা ও অঞ্জুমা – এই তিনজন ডিঙি থেকে নামার পর কাদায় কাদায় গিয়ে জম্বুদ্বীপের পাড়ে (ডাঙায়) উঠে সোজা এক থেকে দেড় কিলোমিটার হেঁটে দ্বীপটির প্রায় অপর প্রান্তে এমন একটি স্থানে পৌঁছেছিলেন, যেখানে মাত্র ১০/১৫ ঘর মেছুয়ারা বাস করে ৷ সেখানে একটি টিউবওয়েল ছিল ৷ গুরুমহারাজ সেই টিউবওয়েল পাম্প করে হাত-পায়ের কাদা ধুয়ে ফেলেন এবং কাপড়ের নিম্নঅংশের জল-কাদাও খানিকটা পরিষ্কার করে নিয়েছিলেন। ওনার সাথে যারা ছিল তারাও ওই টিউবয়েলের জলে নিজেদেরকে পরিষ্কার করে নিয়েছিল ৷ গুরুমহারাজসহ সকলে ওই টিউবওয়েলের জল খানিকটা করে পানও করেছিলেন। জলটা নিশ্চয়ই স্বাদু ছিল – তাই পান করতে অসুবিধা হয়নি।
ইতিমধ্যেই বাকি লোকেরা (অর্থাৎ যারা গুরুজীর সাথে লঞ্চ থেকে ডিঙিতে নেমে জম্বুদ্বীপে এসেছিল, যেমন – বর্ধমানের হিরুদা, বড়বেলুনের ধীরেনদা, রায়নার সন্ধ্যামা, সিঙ্গুরের আনন্দ প্রমুখ)-ও একে একে ওখানে এসে যোগদান করতে শুরু করেছিল। সবার শেষে ওখানে join করেছিলেন সন্ধ্যামা ৷ উনি একে তো বয়স্কা মেয়েমানুষ (শিক্ষয়িত্রী), তার ওপর শারীরিকভাবে একটু অপটু ছিলেন – তাই অতটা জল-কাদা ভেঙে পাড়ে ওঠায় এবং তারপরে আবার টানা এক থেকে দেড় কিমি হেঁটে গুরুজীর কাছে পৌঁছানোয় যথেষ্ট দেরি হয়েছিল এবং উনি খুবই ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্তও হয়ে পড়েছিলেন ৷ ওনার এই অভিজ্ঞতার কথা সন্ধ্যামা লিখে রেখেছিলেন, যেটা চরৈবেতি (বনগ্রাম আশ্রম থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা) পত্রিকার কোনো এক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ৷
যাইহোক, গুরুজী ওইখানে ছোট্ট একটা ঘরের মতো স্থানে (মন্দির)_ যেখানে কিছু দেবদেবীর মূর্তি ছিল, সেখানে বসে বেশ মৌজ করে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন। ডিঙি থেকে জল-কাদায় নামার সময় উনি পাঞ্জাবীর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটারটি (যেহেতু পাঞ্জাবীর নিম্নঅংশ পর্যন্ত জল কাদা স্পর্শ করেছিল) অঞ্জুমাকে ধরতে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন – ” যত্ন করে রাখবি, যেন জলে কাদায় পড়ে ভিজে না যায় !” অঞ্জুমা যত্ন করে ওই দুটো ধরে রেখেছিল এবং গুরুজী চাওয়া মাত্র কাপড়ের খুঁট খুলে তা দিতে পেরেছিল ৷
ঐরকম নির্জন দ্বীপে যেখানে মানুষেরই দেখা পাওয়া যায় না – সেখানে একজন সন্ন্যাসী, একজন সন্ন্যাসিনী ও ব্রহ্মচারিণীসহ কয়েকজনকে দেখে মেছুয়াদের ঘরের মহিলারা একে একে এসে ওখানে উপস্থিত হোতে শুরু করেছিল ৷ গুরুজী ওদের সাথে কথা বলতে শুরু করে দিলেন। সম্ভবতঃ ওরা বাঙালি ছিল না – দেহাতি হিন্দির সাথে বাংলা মিশিয়ে কথা বলছিল ৷ কিন্তু গুরুমহারাজের তাতে কি অসুবিধা ? উনি ওদের মতো করে ওদের ভাষাতেই Communication চালিয়ে যাচ্ছিলেন ৷ ওই মহিলারা ওদের দুঃখময় জীবনের কথাই গুরুজীকে জানাচ্ছিল – ‘ওদের পুরুষেরা বেশিদিন বাঁচে না, যারা রয়েছে তারা নৌকা নিয়ে(অত্যাধুনিক লঞ্চ বা অন্যান্য সরঞ্জাম ওদের ছিল না)গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায় ৷ সেই মাছ ওরা শুকিয়ে রাখে এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডিঙ্গি করে বকখালি (যেখানে যেতে লঞ্চেই কয়েক ঘন্টা লেগে যায়)-তে বেচে আসে অথবা দালালরা এসে স্বল্পমূল্যে ঐ শুকনো মাছ নিয়ে যায় ৷ বিনিময়ে তারা ওদেরকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী এবং খাদ্যসামগ্রী (চাল, ডাল, আটা, নুন, তেল ইত্যাদি) দিয়ে যায় ৷
যাই হোক, দু-একজন করতে করতে ওই স্থানে উপস্থিত মানুষেরা যখন প্রায় সবাই চলে এসেছিল – তখন গুরুজী সকলকে নিয়ে সৎসঙ্গ শুরু করে দিয়েছিলেন। রাম-সীতা-বজরংবলী ইত্যাদি নানাবিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো ৷ ওখানকার স্থানীয়রা ছাড়াও গুরুজীর সঙ্গে থাকা ব্যক্তিরা সকলেই ঐ সৎসঙ্গে খুবই আনন্দ লাভ করছিলো। কিন্তু গুরুজীর কথায় হঠাৎ করে ছেদ পড়েছিল কারণ দু-একজন ভক্ত(যারা একেবারে শেষে পৌঁছেছিল) গুরুজী কোন্ দিকে গেছেন তা নির্ধারণ করতে না পেরে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তারপর অবশেষে অনেক কষ্টে এবং অনেকটা পরে গুরুজীর দর্শন পেয়েছে – তাই তারা খুব রেগে গেছিলো। ওরা গুরুজীর কাছে পৌঁছেই চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিল ৷ – কেন গুরুজি ওদেরকে হাত ধরে ধরে সঙ্গে করে আনেনি ? – সেই নিয়ে অভিযোগও তুলেছিল ৷
বেচারা গুরুজী (ভগবান) আর কি করেন ! তিনি পূর্বেই সকলকে নিষেধ করেছিলেন যাতে কেউই তার সাথে ঐ দ্বীপে না যায় – অর্থাৎ উনি একাই যেতে চেয়েছিলেন। লঞ্চের ১২০ জন লোকের মধ্যে ওই ৮/১০ জন ছাড়া সকলেই ওনার কথা মেনে লঞ্চেই থেকে গেছিলো। যারা গুরুজীর সঙ্গ ধরেছিল – তাদের মধ্যে যাদের গুরুজীর প্রতি প্রেম-ভক্তি-ভালোবাসা ছিল – তাদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি। আর অসুবিধা হোলেও তারা কিছু মনে করেনি। কিন্তু ওই যে__ দু-একজন ভক্ত সহিষ্ণু থাকতে পারলো না_reaction করে ফেললো !
আসলে ওরা কাদায় কাদায় কষ্টে-সৃষ্টে পাড়ে উঠে আর গুরুজীকে দেখতে পায়নি। ফলে এদিক ওদিক ঘুরে ঘর্মাক্ত কলেবর, তৃষ্ণাকাতর হয়ে অবশেষে গুরুজীর দেখা পেয়েছিল ৷ কিন্তু এতো কষ্টের পর পরমানন্দ পেয়ে আনন্দ করবে কি – গুরুজীকে উদ্দেশ্য করে নানারকম ক্ষোভ উগরে দিতে শুরু করেছিল ৷ ফলে সেই মেছুয়া মহিলাদেরকে উদ্দেশ্যে গুরু মহারাজের করা নানান প্রসঙ্গ অর্থাৎ ‘গুরুজীর সিটিং’ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং এরপরেই উনি স্থানীয় সকলকে বিদায় জানিয়ে,আসন ছেড়ে উঠে লঞ্চে ফেরার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে দিয়েছিলেন ৷৷