শ্রী শ্রী গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের সাথে মেমারীর (শ্রীধরপুর) আশীষ মাস্টারমশাইয়ের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার উল্লেখ এখানে করা হচ্ছিলো ৷ একদিন বনগ্রাম আশ্রমে সিটিং চলাকালীন সামন্তীর একটি যুবক ছেলে (যাকে বিষধর গোখরো সাপে দংশন করেছিল)-কে নিয়ে তার বাড়ির লোকজন গুরুজীর চরণপ্রান্তে নিয়ে এসেছিল ৷ ছেলেটি তখন unconscious অবস্থায় ছিল এবং তার মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছিল ৷ এই অবস্থায় করুণাময় ভগবান পরমানন্দ ছেলেটির বাবা-মায়ের কাতর আর্তিতে আদ্র হয়ে — ছেলেটিকে তাঁর ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে সকলকে বাইরে চলে যেতে বলেছিলেন ৷

এরপরেই গুরুজী সিটিং ছেড়ে যখন ওনার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন — আশীষ মাস্টারমশাই তখন সিটিং-এ বসে বসে ভাবছিলেন – ‘গুরুজীর পক্ষে ওই ছেলেটিকে বাঁচানো অসম্ভব ! কারণ, যে ছেলেটির গোখরো সাপের বিষের প্রভাবে মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে — সেই ছেলেটি ঝাড়ফুঁকের (হয়তো তখনও পর্যন্ত মাস্টারমশায়ের গুরুজী সম্বন্ধে ধারণা অতোটা পোষ্টাই ছিল না, উনি ভেবেছিলেন গুরুজী হয়তো কোনরকম মন্ত্র তন্ত্র বা ঝাড়-ফুঁক ওই ছেলেটির উপর প্রয়োগ করবেন।) দ্বারা সুস্থ কি করে হোতে পারে ?’

কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের সমস্ত ধারণা ভ্রান্ত হয়ে গেল, কারণ ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই গুরুমহারাজ ঘর থেকে বেরিয়ে তৃষাণ মহারাজ এবং ছেলেটির বাড়ির লোকেদেরকে কিছু নির্দেশ দিলেন এবং পুনরায় এসে সিটিং-এ বসে পড়লেন । ওরা ছেলেটিকে ঘর থেকে বের করে মনের আনন্দে বাড়ি নিয়ে চলে গেল ৷ যাবার সময় সবাই দেখলো যে, ছেলেটি অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেছে। এই ঘটনাটা চোখের সামনে দেখে আশীষ মাস্টারমশাইয়ের মনে মনে হয়েছিল যে,— ‘এটা নিশ্চয়ই কোনো বিদ্যা বা বিজ্ঞান__ যেটা জানতে পারলে তো ওনার নিজের এলাকার (শ্রীধরপুর, মেমারী) বহু সাপে-কাটা রোগীর উপকার করা যাবে ! তাহলে তো এই বিদ্যাটা গুরুজীর কাছ থেকে শিখে নিতে হবে !’

এই ভাবনা মাথায় নিয়ে সিটিং এর শেষে খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই যখন গুরুজীর ঘরের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে একা একা দেখা করতে যেতো — উনিও সেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে ওনারও ঘরে যাবার পালা এলো ৷ উনি গুরুজীর ঘরে ঢুকে দেখলেন যে, গুরুজী ওনার ঘরে মাটির বেদী-তে বসে রয়েছেন (ওই বেদীতেই একটা বেতের বা শীতলাপাটির উপরে একটা গেরুয়া চাদর পাতা থাকতো এবং একটা গেরুয়া ঢাকনা দেওয়া বালিশ থাকতো। গুরুজী ওইখানেই রাত্রির বিশ্রামও নিতেন ৷) ৷ মাস্টারমশাই ঢিপ্ করে একটা প্রণাম করেই ওনাকে বলে বসলেন – “গুরুজী আমাকে সাপে কাটা রোগীকে বাঁচানোর কৌশল (অর্থাৎ সাপে কাটার ফলে মানুষের শরীরে যে বিষক্রিয়া হয় – সেইটা কিভাবে কাটানো যায় তার কৌশল বা বিজ্ঞান)-টা শিখিয়ে দিন !”

গুরুমহারাজ ওনার কথা শুনে তাঁর ভুবনভোলানো হাসি হেসে মাস্টারমশাইকে বলেছিলেন – ” তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলে, এখনও ওই বিষয়েই ছাত্রদেরকে পড়াও_ তুমি তো শক্তি transfer-এর ব্যাপারটা বোঝো ! বোঝো না কি ? জল যেমন উঁচু level থেকে নিচের level-এর দিকে সতত প্রবহমান হয় – ঠিক তেমনি উচ্চ বিভব (potential) থেকে শক্তিকে নিম্ন বিভব (potential)-এর দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় ৷ মাঝখানে শুধু প্রয়োজন হয় ভালো conductor-এর ৷ তাই না ? এক্ষেত্রেও তাই করা হয়েছে ৷ আমার শরীরে সবসময় উচ্চ potential-এর positive energy ক্রিয়াশীল থাকে — আর সাধারণ মানুষ যেন negative field ! উচ্চ potential-এর শক্তিকে নিম্ন potential-এর শক্তিতে transfer-ও করা যায়।” আমরা আগেও গুরুজীর কাছে শুনেছিলাম — যে কোনো যোগীপুরুষের মধ্যেই উচ্চ আধ্যাত্মিক শক্তি বা positive energy-র field বর্তমান থাকে ৷ তাই তো তাঁরা যখন কারুকে মস্তকে হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, অথবা কোনো ব্যক্তি যখন তাঁদের পাদস্পর্শ করে প্রণাম করে – তখন ওই শক্তির transfer হয় ৷ প্রকৃতপক্ষে প্রণাম করা বা আশীর্বাদ দানের এইটাই রহস্য ৷ বাকি যে প্রনাম ক্রিয়াগুলি অহরহ ঘটে চলেছে — সেগুলি নিছকই নিয়মতান্ত্রিক দায়সারা গোছের একটা ব্যাপার ৷

সে যাইহোক, গুরুজী মাস্টারমশাইকে বলেছিলেন যে,— ‘এই ক্ষেত্রে (সাপে কাটা রোগীটিকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে) গুরুজীর অভ্যন্তরে করুণার উদ্রেক হওয়ায় তাঁর ইচ্ছাশক্তি, ওই ছেলেটির তীব্র বিষের প্রভাবে ফুরিয়ে যাওয়া জীবনীশক্তি পুনরায় ফিরে পাওয়া-রূপ ‘ক্রিয়াশক্তি’তে রূপান্তরিত হয়েছিল ৷ ওই ক্রিয়াশক্তি-ই ছেলেটির জীবনীশক্তিকে বাড়িয়ে তুলেছিল, আর তার ফলে সে নিজের উজ্জীবিত জীবনীশক্তি দিয়ে রক্তে মিশে যাওয়া সাপের বিষের ক্রিয়া নিজে নিজেই কাটিয়ে তুলতে পেরেছিল ৷

এটাই অধ্যাত্ম্যবিজ্ঞান ! আপাতভাবে এইসব ঘটনা দেখে magic-এর মতো মনে হোলেও বা অলৌকিক ঘটনা বলে আখ্যায়িত হোলেও – এর মধ্যেও বিজ্ঞান রয়েছে, এর মধ্যেও একটা ঘটনা প্রবাহের পারস্পর্য্য রয়েছে !
তবে আশীষ মাস্টারমশাইয়ের পক্ষে ওই বিদ্যা অধিগত করা সম্ভব হয়নি ৷ কারণ যতটা উচ্চ বিভব বা high potentiality(অধ্যাত্ম শক্তি) অর্জিত হোলে, তা অপর সাধারনকে দেওয়া যায় – ততোটা সাধনভজন করা বা অন্যান্য শর্তপালন তো আর করে ওঠা হয়নি। তাই এই জীবনে মাস্টারমশাইয়ের মানবকল্যাণের অন্ততঃ ওই দিকটা অর্থাৎ সাপে কাটা রোগীদের সুস্থ করে তোলাটা আর সম্ভব হয়নি !!