জিজ্ঞাসু : আপনার শিশুকালের কথা যত শুনছি, ততই অবাক হচ্ছি, আচ্ছা শিশু অবস্থায় আপনার বাবার ভূমিকা কি ছিল ?
গুরুমহারাজ : আমার বাবা চিরকালই এক আপনভোলা উদাসীন মানুষ ছিলেন। তাঁর সংসার ছিল, জমিজমাও ভালই ছিল কিন্তু তিনি নিজে খুব একটা হিসেবী বা সংসারী ছিলেন না, ফলে খুব অভাবও হয়েছিল সংসারে। বাবা তাঁর পিসিমাকে খুবই মান্য করতেন। তাঁর ভয়ে যতটা সম্ভব তিনি বাড়ীতে থাকতেন কিন্তু সুযোগ পেলেই বিভিন্ন আখড়া বা হরিবাসরে কিংবা যাত্রাপালায় গানবাজনা করতে চলে যেতেন।
আমার জন্মের আগে থেকেই যে কোন ভাবে আমার সম্বন্ধে বাবার ধারণা পাকা হয়ে যায়। ফলে আমার জন্মাবার পর থেকেই আমি দেখেছি, অন্য সবার থেকে বাবা আমাকে বেশী প্রাধান্য দিতেন। তিনি সকলকেই—এমনকি মাকেও বলে দিয়েছিলেন—যাই করুক না কেন, রবিকে যেন কেউ কিছু না বলে। আমার মনে আছে—আমাদের এক গৃহশিক্ষক একবার পড়াতে এসে আমাকে মেরেছিলেন। এটা জানতে পেরে রাত্রেই বাবা তাঁর বাড়ী গিয়ে তাঁকে জবাব দিয়ে আসেন এবং অন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন।
এছাড়া বাবা কোথাও গেলেই সুযোগ পেলে আমাকে কাঁধে করে নিয়ে যেতেন। নিভূজী বাজারের বিভিন্ন গদিতে বাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সীতারামদাস ওঁকারনাথ এসেছিলেন একবার, বাবা আমাকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে দেখাচ্ছেন, ‘দ্যাখো বাবা, ঐ যে বসে আছেন—উনি সীতারামদাস বাবা।” আমি দেখেই ওনার পূর্বজন্মের রূপটা বাবাকে বলে দিচ্ছি। বাবা তো তাড়াতাড়ি আমাকে ভিড় থেকে বের করে নিয়ে এলেন। ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে আমার একটা দারুণ friendship ছিল।
বাবাও আমাকে বুঝতেন আর আমিও তাঁকে বুঝতাম, ফলে বাবা কখনই আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন নি। শুধু রাত্রে যখন তখন উঠে পালাতাম, এইটা বাবা ভয় করতেন এবং মাঝে মাঝে আমাকেও ভয় দেখাতেন। এই জন্য আমাকে শুতে নিতেন নিজের কাছে, আর জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতেন পাছে পালিয়ে যাই। কিন্তু বাবা ঘুমিয়ে গেলেই রোজ রাত্রে পালাতাম।
বাবা মাঝে মাঝে আমাকে খুশি করার জন্য পয়সা দিতেন। চার আনা পয়সা প্রায়ই দিতেন। তখনকার দিনে চার আনা পয়সা একটা শিশুর কাছে অনেক। ২ নয়া পয়সায় ঘুড়ি বা একটা বড় বেলুন পাওয়া যেত। আইসক্রীম ২ নয়া, চার আনায় ৪টে বড় রসগোল্লা—ভাবো তো ! তবে আমি কিছু কিনলে সবাইকে দিয়ে খেতাম, না হলে মাকে পয়সা ফেরত দিয়ে দিতাম। একবার মনে আছে, নিভৃজীতে বিশ্বকর্মা পূজার মেলায় দিদিদের সাথে গেছি, বাবা তো চার আনা আমাকে আলাদা দিয়েছেন, সেটা পকেটে রয়েছে। হঠাৎ একটা আমার বয়সী ছেলে (৩/৪ বছর বয়েস তখন আমার) ঘুড়িওয়ালার দোকানের সামনে খুবই কাঁদছে, তার হাতে ছেঁড়া ঘুড়ি। ব্যাপারটা হয়েছে কি, ঘুড়ির দাম ২ পয়সা অর্থাৎ তিন নয়া, কিন্তু ছেলেটি দিয়েছে ২ নয়া, ফলে দোকানদার একটু ছেঁড়া ঘুড়ি দিয়েছে। এবার ছেলেটি সেটি ফেরত দিতে চাইছে, দোকানদার তাও নেবে না। ঐ বয়সেই বাচ্ছা ছেলেটির আকুল-করা কান্না আমাকে স্পর্শ করল এবং আমার মনে হল—আমি তো অনেক বড়, আমার অনেক কিছু করার আছে। আমি এগিয়ে গেলাম দোকানদারের দিকে, তাকে বললাম ঐ ছেলেটিকে ভাল ঘুড়ি ২-টো দাও—পয়সা আমি দেবো। দোকানদার আমার বলার ভঙ্গি দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ওকে ২-টো ভালো ঘুড়ি দিল ছেঁড়া ঘুড়িটার বদলে, ২ নয়া ফেরতও দিল। আমি ওর ঘুড়ির পয়সা দিয়ে দিলাম। ছেলেটির মুখে পরিতৃপ্তির হাসি আমাকে খুবই আনন্দ দিয়েছিল। তখন থেকেই বুঝলাম, মানুষের দুঃখমোচন করে—মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারলেই জীবনে আনন্দের আস্বাদ পাওয়া যায়।
এখন ঘটনা ঘটেছে কি, সেই ছেলেটি তো এখন আর ছোট নেই, বড় হয়েছে, পয়সা-কড়িও করেছে। কিছুদিন আগে ও এখানে এসে হাজির। ওকে দেখেই তো আমার স্মৃতিতে ফুটে উঠল সেই ছোটবেলায় ঘুড়ির দোকানের সামনে ক্রন্দনরত বালক। ও হয়তো সেদিনের কথা ভুলে গেছে, কিন্তু আমার মনে আছে। এরকম সব মানুষেরই জীবনে এমন কিছু ছোট-খাটো ঘটনা ঘটে, সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলে দেখা যায় যে, জীবনের ধারাটাই পাল্টে গেছে। জানো তো কথা আছে, ‘স্বভাব যায় না মলে, ইল্লত যায় না ধুলে’, কিন্তু স্বভাব বদলায় আর তা বদলায় একমাত্র সাধুসঙ্গে, বিবেক জাগ্রত হলে। স্বামী পরমানন্দ কি করছে বা কি করবে বলতো ? মানুষগুলোকে সব রাতারাতি বদলে দেবে, না তাদের শিং গজাবে ! প্রতিটি মানুষেরই স্ব-ভাব রয়েছে, আর সেই অনুযায়ী রয়েছে তার বিচারের ধারা। পরমানন্দ শুধু সেই বিচারের ধারাটা বদলে দেবার চেষ্টা করে। কোন মানুষকে যতই জ্ঞান দাও, যতই লেখাপড়া শেখাও, তার স্বভাব পরিবর্তন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার বিচারের ধারাটি বদলে যাচ্ছে। এটাকেই বিবেকের জাগরণ বলা হচ্ছে।
যাইহোক বাবার কথা বলতে গিয়ে আরও অনেক কথা বলা হয়ে গেল। এইভাবে ছোটবেলায় বাবা যে আমাকে বেশী প্রাধান্য দিতেন তার কারণটা বোধহয়—বাবার কিছু দর্শন হয়েছিল। আর … তাছাড়া বিভিন্ন সাধুসঙ্গে বাবা আমার সম্বন্ধে কিছু পূর্ব অনুমান বা পূর্বাভাস পেয়েছিলেন পরে অনেকে আমার কাছে এসে বলেছে যে, আমার ছোটবেলায় বাবা যাদের সঙ্গে মিশতেন, তাদের কাছে তিনি আমার সম্বন্ধে খুব গল্প করতেন। ফলে তাদের বাড়ীর ছেলেরা আমাকে চিনতো না কিন্তু রবি নামটা জানতো
বাবা কখনই আমাকে শাসন করেননি। বরং আদর করে ‘রবিঠাকুর’ বলে সম্বোধন করতেন। আমার বাবার নাম ছিল ফকিরচন্দ্র। আমার মনে হয় কি জানো–হয়তো দাদু ঠাকুরমার ছেলে-মেয়ে মারা গিয়েছিল বা ঠিক সময়ে হচ্ছিল না—তাই ফকির সাহেবের কাছে মানত করে তখন ছেলে হয়, তাই ঐরূপ নামকরণ হয়েছিল। তবে আমার ক্ষেত্রে নামটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ আমি গর্ব করে সবাইকে বলতে পারি—আমার পিতা ছিলেন ফকির। বাবা ছোটবেলায় আমাকে ‘ভোলানাথ’ও বলতেন। কোন ন্যায়-অন্যায় করলে বা কেউ কোন অভিযোগ করলে বাবা বলতেন, ‘ও ভোলানাথ, ওকে তোমরা কেউ কিছু বোলো না।’